নলিনী বাবু, শ্রডিঞ্জারের বিড়াল এবং সমান্তরাল মহাবিশ্ব
আজ হুমায়ুন আহমেদের জন্মদিন। হুমায়ুন আহমেদ আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখকদের একজন। প্রায় সব বই আমি পড়েছি। একটানে পড়ার যে মোহ তিনি তৈরি করতেন সেটি খুব কম লোকই পারে। আমার হিসাবে তারা তিনজন বাংলাভাষার সবচেযে সুন্দর এবং শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞান কল্পকাহিনী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়াতেন এবং জীবনের শেষ সময়গুলোতে সেখানেই ফিরে গিয়েছিলেন। তার লেখার একটি অংশ জুড়ে প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা আছে।
আমার মেয়ে, বিদুষী, সব সময় আর এক জগতের কথা বলে। আমি জানি এটি তার কল্পনাশক্তির প্রকাশ কিন্তু যখন সে বলে, সেখানে তারা তিনভাইবোন দোলনায় দোল খায়, বাবা ঘর সাফাই করে আর মা রান্না করে তখন আমার প্যারালাল ইউনিভার্সের কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। মনে মনে এক গভীর স্বান্তনা পাই যে, আমাদের জাওয়াদ ঔ জগতে বেড়ে উঠছে রুবাই আর বিদুষীর সঙ্গে।
১৪ তারিখের প্রথম আলোতে হুমায়ুন আহমেদের কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়ার অভিজ্ঞতা ছাপা হয়েছে। সেটি আবার পড়ে প্রিয় লেখকের কথা খুব মনে পড়ছে। লেখকেরমৃত্যুবার্ষিকীতে এই আমার ছোট্ট নিবেদন। লেখাটা লিখেছি যে বছর তিনি মারা যান, প্রথম আলো অফিসে বসে, বিজ্ঞান প্রজন্মের জন্য।
এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে অবোধ্য বিষয় কী? আইনস্টাইন বলতেন ‘এটি বোধগম্য’!
পদার্থবিজ্ঞানের মাজেজাই এমন যে জানা দুনিয়ার সর্বত্র এর নিয়মকানুনগুলো একই। দুনিয়াজুড়ে প্রোটনের ভর একই,
হাইড্রোজেনের কেন্দ্রে একটি প্রোটন আর তাকে ঘিরে ঘুরছে একটি ইলেকট্রন। সাদা আর কালো বাইরে যা-ই হোক না কেন, ভাঙলে সব কোয়ার্ক, লেপটন। কিন্তু এমনকি হতে পারে, অন্য কোনো মহাবিশ্ব আছে, যেখানে নিয়মকানুনগুলো সামান্য এদিক-ওদিক। বস্তুকণা এই মহাবিশ্বের মতো ঘড়ির কাঁটার দিকে না ঘুরে এর উল্টো দিকে ঘোরে! তাহলে সে দুনিয়াটা কেমন হবে? সে মহাবিশ্বে কী জ্যোছনা আর জননীর গল্প বলার একজন কথক থাকবেন? তিনি কি কর্কটব্যাধিতে আক্রান্ত হবেন? তাঁর কী অপারেশন হবে? তিনি কি আবার ফিরেআসবেন তাঁর পাঠকদের মধ্যে?
হতে পারে। জামাল নজরুল ইসলাম, পল ডেভিসের মতো বিজ্ঞানীরা এ রকম মহাবিশ্ব নিয়ে যতই আপত্তি করেন না কেন, বাঘা বাঘা কল্পবিজ্ঞানের লেখকেরা সমান্তরাল মহাবিশ্বের এই ধারণাকে সব সময় এগিয়ে নিয়ে গেছেন। স্টিফেন হকিং-এর অবস্থান এর মাঝামাঝি।
সমান্তরাল মহাবিশ্ব আমাদের মহাবিশ্বেরই প্রতিরূপ, সামান্য একটু এদিক-ওদিক। সেখানকার কোনো ছবি যদি দেখা যেত, কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানের, তাহলে হয়তো দেখা যেত মেয়েরা সব তাদের শাড়ির আঁচল টেনে দিয়েছে ডানকাঁধে, বাঁকাঁধে নয়। বেশির ভাগ লোকই বাঁ-হাতে লেখে—অনেকটা আমরা আয়নাতে যেমন দেখতে পাই। এ রকম মহাবিশ্ব যে শুধু দুটি হবে, তা নয়। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার আবির্ভাবের পর আমরা দেখেছি, বস্তুকণা যুগপৎ নানা কোয়ান্টাম দশাতে থাকতে পারে। কাজেই এমন মহাবিশ্ব হতে পারে অগুনতি! ১৮৯৫ সালে আমেরিকার দার্শনিক উইলিয়াম জেমস এ রকম বিশ্বগুলোকে একত্রে বহুবিশ্ব (মাল্টিভার্স) নামে অবহিত করেন। বহুবিশ্বের সব কটি মহাবিশ্বকে আমরা বলতে পারি সমান্তরাল মহাবিশ্ব।
বাংলা ভাষার কল্পবিজ্ঞানকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দেওয়ার নন্দিত শিল্পী হুমায়ূন আহমেদের বিজ্ঞান কল্পকাহিনীতে আমরা সমান্তরাল মহাবিশ্বের সবচেয়ে বেশি উল্লেখ দেখতে পায়। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ছাত্র হিসেবে বস্তুকণার দশাত্তোরের ব্যাপারটি ছিল তাঁর নখদর্পণে। আমরা যখন শ্রডিঞ্জারের বিড়ালটিকে খুঁজতে থাকি নানা কায়দায়, তখন তিনি অবলীলায় সেটির খোঁজ পেয়ে যান। কারণ, এক জগৎ থেকে অন্য জগতে স্থানান্তরের সময় বস্তুর ওয়েব ফাংশন কলাপস করে।
সমান্তরাল মহাবিশ্ব নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের ২০১০ সালের উপন্যাস নলিনী বাবু BSc।একই সময়ে ফাউন্টেনপেন ইত্যাদি ছোট ছোট নিবন্ধের সংকলনগুলোতে দেখা যাচ্ছিল, তিনি ইদানীং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নিয়ে ভাবছেন, লিখছেন। নর্থডাকোটাতে পড়ার সময় এই বিষয়টিতে তিনি সর্বোচ্চ নম্বর পেতেন। কাজেই যখন তিনি খুঁজতে শুরু করেন শ্রডিঞ্জারের বিড়ালকে, তখন সেটি তাঁর কাছে সহজে ধরা দেবে তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে!
পাঠকের নিশ্চয় মনে আছে, বিজ্ঞানী শ্রডিঞ্জার আজ থেকে প্রায় ৮৮ বছর আগে একটি ঘরে একটি বিড়ালকে আটকে রেখে দরজা বন্ধ করে দেন। সেই অন্ধকার ঘরে একটি তেজস্ক্রিয় বন্দুক আছে, যেটি বিড়ালের চলাফেরায় চালু হয়ে এমন কিছু করতে পারে, যাতে বিড়ালটি মারা যেতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, দরজা বন্ধ করার কিছুক্ষণ পর থেকে আমরা কি বলতে পারব বিড়ালটি জীবিত, না মৃত? অথবা বিড়ালের ওয়েবফাংশন কী? যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা দরজা খুলে খোঁজ না নিব, ততক্ষণ পর্যন্ত আসলে বলা মুশকিল বিড়ালটি মৃত না জীবিত। কোয়ান্টাম জগতের ভাষায় তখন আমাদের বলতে হবে, বিড়ালটির ওয়েব ফাংশন হলো জীবন্মৃত!
কিন্তু একটি বিড়াল কি কখনো এ রকম জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকতে পারে? পারেনা। আসলে দরজা খুললেই আমরা দেখব, বিড়ালটি হয় মৃত অথবা জীবিত। এ হলো ওয়েবফাংশনের কলাপস। এই উদাহরণকে আরেকটু টেনে নিয়ে গেলে আমরা দেখি, আলো বহনকারীকণা ফোটনের রয়েছে কণা এবং তরঙ্গধর্ম। সেটি তরঙ্গধর্মের জন্য ব্যতিচার তৈরি করে, আবার দায়ী ফটো ইলেকট্রিক ইফেক্টের জন্য যেখানে সেটি কণা। তবে, এখানেও একটি দরজা খোলার ব্যাপার রয়েছে। কারণ, পরীক্ষাটা যে ধর্মের জন্য করা হয়, ঠিক সেই ধর্মটি ধরা পড়ে। মানে, যদি আলো দিয়ে ব্যতিচারের ছবি আঁকতে চাই, তাহলে সেটিই আঁকা যায়। যেন বা মনে হয়, দর্শকই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে দুনিয়ার কোথায় কী হবে?
আমি যদি আকাশে না তাকাই, তাহলে কি সেখানে চাঁদ থাকবে না?
কোয়ান্টাম জগতে চাঁদ থাকে না। দর্শক নিরপেক্ষ মহাবিশ্ব সেখানে নেই। নেই বলে দর্শক সাপেক্ষে মহাবিশ্ব হতে পারে অনেকগুলো (মাল্টিভার্স)। যেমনটি নলিনী বাবুতে লেখক বলছেন চারটি ভিন্ন ভিন্ন জগতে তার চার রকমের দায়িত্বের কথা। কোনোটিতে তিনি কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। লেখালেখিতে নেই। শান্তিপূর্ণ জীবন। কোনো জগতে ব্যর্থ লেখক ছেলেমেয়েদের পড়াতে পারেন না। তারা ড্রাগে আসক্ত। অন্য একজগতে সংসার থেকে বিতাড়িত হয়ে একাকী বাস করেন। আবার আরেক জগতে শাওনকে বিয়ে করে থিতু হয়েছেন। সমান্তরাল জগতের নানান বিষয় তাঁকে ভাবায়। তবে, লেখকজীবনের শুরুতে যেমনটি কল্পনা স্থান পেত, বিজ্ঞানের ওপরে পরিণত বয়সে এসে সেটার উল্টোটাও আমরা দেখতে শুরু করি। একটি লেখাতে বিয়ের অনুষ্ঠানের ছবির যে বর্ণনা দিয়েছেন, সেটা মিসির আলির পরামর্শে নায়ক অন্য জগৎ থেকে নিয়ে আসে। কিন্তু নলিনী বাবুর ডায়েরি যে অন্য জগৎ থেকে আসেনি, তা লেখক নিশ্চিত করছেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্স দুই জগৎ বা অসংখ্য জগৎ স্বীকার করে তবে এক জগতের বস্তুর অন্য জগতে স্থানান্তর স্বীকার করে না। স্থানান্তর মানেই ওয়েভ ফাংশনের কলাপস। জগতের বিলুপ্তি।
তবে, যেকোনো কল্পবিজ্ঞানের সমাপ্তির মতো এখানেও তিনি আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে যান এক ছড়ার মধ্যে
‘রাশেদ বাবাটিং
দরজা বন্ধ করছিং
আমি বই পড়ছিং
এবং মজা পাচ্ছিং।’
চিন্তাই কি তাহলে যুক্ত করে দুটি ভিন্ন জগৎকে? চিন্তা কি আসলেই সেই উষ্ণগহ্বর(ওয়ার্মহোল), যা স্থানকালের নানা অংশের মধ্যে সংযোগ ঘটায়?
আমরা জানি না, তবে, জানব একদিন। বিজ্ঞানের হাত ধরে কল্পবিজ্ঞানকে টেনে আনব আমাদের জগতে।
হুমায়ূন আহমেদের সাম্প্রতিক কালের বিজ্ঞান এবং কল্পবিজ্ঞানের লেখাগুলো পড়ার সময় আমি প্রায় ভাবতাম, আহা, স্যার যদি আমাদের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকগুলো লিখতেন? তাহলে নিশ্চয়ই এক দশক ধরে আমাদের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানে পড়ার আগ্রহ ৩৩ শতাংশ কমে যেত না! বরং সেটা বাড়ত। ভেবেছিলাম, একদিন সাহস করে তাঁর সামনে গিয়ে বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক লেখার দাবি নিয়ে দাঁড়াব। এই জগতে সেটি আর হলো না।
অথচ আমি নিশ্চিত জানি, অন্য এক জগতের মুনির হাসান অপারেশন শেষে দেশে ফিরে আসা হুমায়ূন
আহমেদকে রাজি করিয়ে ফেলেছে দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক লিখতে! নুহাশপল্লীর ছায়াঘেরা পরিবেশে রচিত হচ্ছে বোধগম্য মহাবিশ্বের চমৎকার বর্ণনা।
মহান রাব্বুল আলামিন আপনাকে বেহেস্ত নসীব করুন।
4 Replies to “নলিনী বাবু, শ্রডিঞ্জারের বিড়াল এবং সমান্তরাল মহাবিশ্ব”
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.
লোকটি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিল, মাঝে মাঝে হিংসে (!) হয়……….
etto etto banan vul ken, sir ? bujhte koshto hoy !!!
দু:খিত। এখন কিছুটা ঠিক করার চেষ্টা করলাম।