শার্লক হোমসের মুখোমুখি

Spread the love

“Never trust to general impressions, my boy, but concentrate yourself upon details”.

১.
পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত ঠিকানাটা খুঁজে পেতে আমার খুব একটা সমস্যা হয়নি। তবে, শেষ মুহুর্তে একজনকে জিঙ্গাষা করা মাত্র হাত তুলে দেখালো আমি যেখানে দাঁড়িয়ে তার উল্টোদিকের বাসাটাই ২২১বি বেকার স্ট্রীট। ইংরেজরা ব্যাপক ভদ্রলোক। কীভাবে নক করবো সেটাও বলে দিলেন।
ঠিক ৯.৩১ মিনিটে আমি ছোট দরজাটাতে কড়া নাড়লাম। বিলাতে এসে এখানকার বাড়িগুলো সম্পর্কে ধারণা হয়েছে। ডেকরে রোডের যে বাড়িটাতে আমরা উঠেছি সেটার দরজা বরাবর সিঁড়ি।
দরজায় কোন কলিং বেল নাই। দেখলাম কড়ার ওপরে লেখা আছে কড়া বাজানোর জন্য। কড়া বাজাতেই ওপর থেকে কে যেন বললো – ইয়েস, মি. মুনির। দরজা খোলা আছে। ওপরে চলে আসুন।
এপয়েন্টমেন্ট করে এসেছি। কাজে ওপর থেকে আমার নাম শুনে অবাক হলাম না। যেমনটা ভেবেছি। দরজা খুলতেই এক চিলতে করিডোর, ফুট দুয়েক হবে। তারপরই সিড়ি। ধাপ গুনে গুনে ওপরে পৌঁছালাম। দুইটি দরজা। হাতের বামেরটা বন্ধ। কিন্তু নাক বরাবরটা খোলা। সেটা দিয়ে কাঙ্খিত ঘরে ঢুকলাম।
ছোট্ট একটা কক্ষ। ঢুকতেই বাঁপাশে একটা পড়ার ডেস্ক। ডেস্কের সামনে একটু চেয়ার ঘুরিয়ে বসে থাকা লোকটাই যে আমাকে নাম ধরে ডেকেছে বুঝতে পেরেছি। লোকটার সামনের ডেস্কে মেডিকেলের বই দেখে নিশ্চিত হলাম ওনার পরিচয়। ওনার হাতে একটা পত্রিকা। ওনার বামদিকে, ঘরের অন্য কোণায় একজন মনোযোগ দিয়ে মাইক্রোস্কোপে চোখ লাগিয়ে কী যেন দেখছেন। ডা. ওয়াটসনের দেখিয়ে দেওয়া চেয়ারে বসার সময় ঐ ভদ্রলোকের কণ্ঠ শুনতে পেলাম। “পায়ের ফোস্কাটা নিশ্চয়ই তেমন সিরিয়াস নয়। তারপর কেমন দেখলেন কেমব্রিজ আর ওয়েস্টমিনিষ্টার, লন্ডন আই। ”
বলতে বলতে আমার দিকে ঘুরে তাকালেন। কী আশ্চর্য আমার পায়ে যে ফোস্কা পড়েছে আর গত দুইদিন আমি কোথায় গেছি তা কেমন করে জানলেন? আমার মতো ডা. ওয়াটসন বরাবরের মতো বিস্মিত হয়ে তাঁর দিকে তাকালেন। তার দিকে ফিরে শার্লক হোমস বললেন – এলিমেন্টারি, মাই ডিয়ার ওয়াটসন!
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন – সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় আপনার পায়ের শব্দ শুনে বুঝেছি আপনি জুতা পরে আসেননি। দুই পায়ের শব্দের তারতম্য দেখে বোঝা যায় আপনার ডান পায়ের সমস্যাটা অনেক জটিল নয়। কাল আর পরশু আপনি দুইটি শহরে অনেক হাটাহাটি করেছেন এই গরমের মধ্যে। এ থেকে বুঝলাম পায়ে ফোস্কা পড়েছে।
আমার হতভম্ব অবস্থাটা উনি উপভোগ করছেন। বললেন – কেমব্রিজ আর এখানকার গরমে জুতা পরে হাটাহাটি করলে এটা হতেই পারে। গত পরশু কেমব্রিজে তো ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বেশি গরম ছিল। কাল এখানেও গরম কম ছিল না”।
তারপর ডা. ওয়াটসনের দিকে ঘুরে হোমস জানালেন – বুঝলে ওয়াটসন। বাংলাদেশ থেকে এখানে এসে কেউ কি এমনি এমনি জুতা না পরে আমার কাছে আসবেন? সমস্যা যে এখানে এসে হয়েছে সেটি ওনার পায়ের নতুন স্যান্ডেলের দিকে তাকিয়েই তুমি টের পেতে।
মরিয়া হয়ে আমি জিঙ্গেষ করলাম – কিন্তু আমি যে কেমব্রিজে আর লন্ডন আই-এ গিয়েছি সেটা আপনি জানলেন কেমনে?
“লন্ডনে আসলে সবাই ওখানে একবার যায়। এটা আন্দাজ করেছি।
“আর কেমব্রিজ?” আমার খটকা যায় না।

“ফেসবুক, মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড, ফেসবুক। কালকে আপনার সঙ্গে কথা হওয়ার পর পরই ফেসবুকে আপনাকে খুঁজে নিয়েছি।”
বলতে বলতে আমার সামনে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিলেন। “পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।”
প্রথম পরিচয়ের ঘোর কাটিয়ে আমি কিছুই বলতে পারলাম না। আমার হাত ধরে ওয়াটসনের দিকে তাকিয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা, আমার ছোটবেলার নায়ক একটু মাথা ঝুঁকে বললেন – তুমি কি মুনিরকে এ বাড়িটা একটু ঘুরিয়ে দেখাবে, প্লিজ।

২.
“লেডিস এন্ড জেন্টেলম্যান। ওয়েলকাম টু দ্যা শার্লক হোমস মিউজিয়াম। আই এম হেয়ার টু হেল্প ইউ ইন দ্যা জার্নি অব দ্যা মোস্ট এক্সাইটিং এন্ড দ্যা মোস্ট ফেমাস হাউস অব দ্যা ওয়ার্ল্ড!”
একটি ভরাট কণ্ঠস্বরে আমার তন্দ্রাটা কেটে গেল। খেয়াল করলাম আমার আশেপাশে আরও কয়েকজন। বুঝতে পারলাম আমি দাড়িয়ে আছি ২২১বি বেকার স্ট্রীটের দোতলায়, শার্লক হোমসের স্টাডিতে। আজ এখানে আসার জন্য আমি কতরকম পরিকল্পনা করেছি।
গতকাল রাতেই লোকজনের কাছ থেকে শুনে নিয়েছি। ভেবেছিলাম সকাল সাতটায় রওনা দেবো। দেই নাই ভাল হয়েছে। কারণ মিউজিয়ামটা খুলেই সাড়ে নয়টায়।
এপটন টাউন রেলস্টেশনের সাহায্যকারী লোকটাকে জিঙ্গেষ করে সাড়ে নয় টাকা দিয়ে একটা আপ-ডাউন টিকেট কাটলাম, টিউবের। আমি আগেই জানতাম হ্যামারস্মিথে, মানে পিংক লাইনে আমাকে উঠতে হবে। স্টেশনের সাহায্যকারী আমাকে বলে দিল ১৬ স্টেশন পরেই বেকার স্ট্রীট।
এ কদিনে আমার টিউবের অভিজ্ঞতা ভালই হয়েছে। এর আগে প্যারিসে, মাদ্রিদে টিউবে চলেফেরা করেছি। তবে,লন্ডনের পাতাল রেল এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। ১৫০ বছর আগে যে লোকেরা চিন্তা করেছে তাদেরকে মাটির নিচে চলাফেরা করতে হবে, তাদের সঙ্গে বিদ্যাবুদ্ধিতে আমাদের পেরে উঠতে ঢের সময় লাগবে। এতে কোন সন্দেহ নেই। ঐ ঘটনার ১৫০ বছর পরে মাটির ওপরে দৃশ্যমান মেট্রোরেল বানাতে গিয়ে আমাদের কতোই না গর্ব!
আমি পুরানো দিনের লোক বলে আমার পকেটে একটা টিউবের ম্যাপ। তবে, এবছর খেয়াল করলাম আইএমওতে আমাদের কোন ম্যাপ দেওয়া হয়নি। কারণ গুগল ম্যাপ! যে কোন ঠিকানা দিলেই সেটি কোথায় জানা হয়ে যাচ্ছে।
আমি মহানন্দে এপটন টাউন থেকে উঠে পড়লাম আমার গন্তব্যে। দুই স্টেশন পড়েই বসার জায়গা পেয়ে গেলাম। যাক, আজকে কেউ অবশ্য আমাকে দেখে উঠে দাড়ায়নি। কাল টিউবে একটি চ্যাংড়া মতো ছেলে দাড়িয়ে আমাকে বসতে বলেছিল। তার মনে হয়েছে আমি ‘সিনিয়র’ সিটিজেন!
যাকগে। ১৬ স্টেশন পরে, গুগলে দেখানো সময়মতো আমি বেকার স্ট্রীট স্টেশনে পৌছালাম। নেমেই দ্রুত উঠে আসলাম রাস্তায়, মাটির ওপরে। রাস্তায় বের হয়ে প্রথমেই অবাক হয়ে গেলাম কারণ আমার হাতের ডানেই মাদাম তু’জ-এর মিউজিয়াম। গুগলের শরণাপন্ন হলাম। দেখলাম আমাকে যেতে হবে উল্টোদিকে, অর্থাৎ বামে। ম্যাপ খুলে রেখে রাস্তা পার হয়ে এসে পড়লাম কাঙ্খিত রাস্তায়।
আমি যে দিকে সে দিকের বাড়িগুলো দেখলাম জোড়া নম্বরের। বুঝলাম কোথাও গিয়ে আমাকে রাস্তা পার হতে হবে। ম্যাপে চোখ রেখে হাটতে থাকলাম। দোকানপাট তখনও খুলেনি। একজনকে দেখলাম শাটার খুলছেন মাত্র। আর একজন ভিতরের জিনিষপত্র বের করে রাস্তার ধারে সাজাচ্ছেন। কয়েক মিনিট হাটার পর গুগল দেখালো আমি আমার গন্তব্যের ঠিক উল্টো পাশে আছি। দোকানগুলোর নম্বর দেখলাম ২৩৬. ২৩৮ ও ২৪০!!!
হায় হায়। ভুল জায়গায় আসছি তো। আমি তো বিলাতের রোডের দুপাশের বাড়ির নম্বর ধরে ফেলেছি। এর একদিকে থাকে জোড়া নম্বর অন্যদিকে বেজোড় নম্বর। তবে, জেড সিকুয়েন্স মেইনটেইন করে। সেই হিসাবে ৩৬, ৩৮, ৪০ এর উল্টোদিকে ৩৫, ৩৭, ৩৯ বা ৪১ হওয়ার কথা। ২১ তো হওয়ার কথা নয়!
গুগল কি তাহলে ভুল বলে। মন খারাপ করে, যে ব্যাটা তার দোকানের জিনিষপত্র বাইরে সাজাচ্ছিল তার কাছে জানতে চাইলাম- ভাই, শার্লক হোমসের বাড়িটা কোনটা!
ব্যাটা আংরেজ আমার দিকে তাকালো। তারপর আঙ্গুল তুলে সামনের বাড়িটা দেখিয়ে দিল – ঐ যে।
আর আমিও গাধা দেখলাম ঐ বাড়িতে বড় করে লেখা আছে দ্যা শার্লক হোমস মিউজিয়াম


কিন্তু ঐটা তো ২৩৮ আর ২৪০ নম্বর বাড়ির উল্টো দিকে!
কী আর করা। বড় করে সাইনবোর্ডতো রয়েছে। কাজে হেটে ট্রাফিকলাইটের সামনে আসলাম। বিলাতে আমাদের মতো যে কোন জায়গায় রাস্তা পার হওয়া যায় না। আমাদের দেশের মতো দৌড়ও দেওয়া যায় না। নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে জেব্রাক্রসিং দিয়েই কেবল রাস্তা পার হতে হয়। তো সেভাবে আমি এসে পৌছালাম ছোটবেলার কাঙ্খিত বাড়ির সামনে। সকাল সোয়া নয়টা বাজে।আমার মতো আরও একটা বিদেশী পরিবার ওখানে দাড়ানো। ছবি তুলছে। আমিও তুললাম। দেখলাম দোতলার জানালার নিচে আলাদা একটা নাম্বার প্লেটও আছে যেখানে পরিস্কার করে লেখা 221B । আমার অবশ্য খটকাটা গেল না। সামনে পেছনে হেটে দুইটা বাড়ি দেখলাম। যা ভেবেছি তাই। একটা ২৩৭ আর একটা ২৪১। তার মানে এটা ২৩৯!!! তাহলে তো এটা ২২১বি  নয়!!!
তখনো প্রায় ১৫ মিনিট বাকী মিউজিয়াম খোলার। লাইনে দাড়ালাম। একটু পরই একজন লোক এসে আমার পেছনে দাড়ালো এবং জানতে চাইলো মিউজিয়াম কখন খুলবে। সময়টা জানিয়ে ভাবলাম গল্প করা যাক। তার কাছে জানতে চাইলাম এটা তো ২৩৯ মনে হচ্ছে আমার কাছে। ২২১বি কেমন করে হলো? ব্যাটা ব্রিটিশ বেশি কথা বলে না। বললো – সে এক বিরাট ইতিহাস! তারপর আমার স্মার্টফোনে বের করে দিল এ বাড়ির ইতিহাস।
আর্থার কোনান ডয়েলের হিসাবে ১৮৮১ থেকে ১৯০৪ সাল পর্যন্ত ওয়াটসন আর হোমস ২২১/বিতে থাকতেন। সে সময় এমন কোন ঠিকানা সেখানে ছিল না। কারণ হিসাব মতো যেখানে ২২১ থাকার কথা সেটি একটা বড় ব্লক মতো ছিল। ফলে আলাদা করে ২২১ নম্বর ছিল না। কেউ ভাবতোও না। ঝামেলা শুরু হলো পরে। ১৯৩০ সালে সেখানে এ্যাবে ন্যাশনাল বিল্ডিং সোসাইটির অফিস শুরু হয়। অফিস চালুর পরদিন থেকে ওনারা চিঠি পেতে শুরু করেন ২২১/বি বেকার স্ট্রীটের ঠিকানায়,শার্লক হোমসকে লেখা। অনেক চিঠি আসতে শুরু করলো। বাধ্য হয়ে ওরা একজন ফুলটাইম সেক্রেটারি নিয়োগ দিল, চিঠির জবাব দেওয়ার জন্য। বেশিরভাগ চিঠির জবাবে সেক্রেটারি লিখতো- “দু:খিত। হোমসের পক্ষে আপনার কেসটি নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনি এখন অবসর জীবন যাপন করছেন, সাসেক্সে। সেখানে তিনি মৌমাছি নিয়ে ব্যস্ত।”
এ ভাবে প্রায় ৬০ বছর কেটে যায়। এর মধ্যে অনেকেই ঐ এলাকার বাড়ি ঘরের খোঁজ নেয়ে বের করার চেষ্টা করেন আসলে কোনান ডয়েল কোন বাড়িটির কথা বলেছেন। তবে, তারা একমত হতে পারেননি। ১৯৯০ সালে এই মিউজিয়ামটা চালু করে শার্লক হোমস ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি,  ২৩৯ নং বাড়িতে (এটুকু জেনে আমি খুব স্বস্তি বোধ করলাম)। তারপর তারা ন্যাশনাল এ্যাবের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করলো। তাদের বক্তব্য হলো হোমসের কাছে আসা চিঠির মালিক তারাই। ওদেরকেই চিঠি দেওয়া হোক। কিন্ত  এ্যাবে ন্যাশনাল সেটা অস্বীকার করে। শেষ পর্যন্ত ২০০২ সালে এ্যাবে ন্যাশনাল যখন ঐ বিল্ডিং ছেড়ে অন্যত্র চলে যায় তখন থকে ব্রিটিশ রাজকীয় ডাকবিভাগ ২৩৯ নম্বরে হোমসের চিঠি এই মিউজিয়ামে ডেলিভারি করতে শুরু করে। এর মধ্যে সিটি অব ওয়েস্টমিনিস্টার শেষ পর্যন্ত বিশেষ ক্ষমতা বলে ২৩৯ বেকার স্ক্রীটকে ২২১বি বেকার স্ট্রীট হিসাবে ঘোষণা করে। আর এভাবে একটি কাল্পনিক ঠিকানা বাস্তব ঠিকানায় পরিণত হয়।
এসব জানতে জানতে দেখলাম নিচতলার দোকানের দরজা খুলে দেওয়া হলো এবং আমি ভিতরে ঢুকে টিকেট কিনে আনলাম। শপ থেকে বের হয়ে পাশের দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকেছি। ঐ বর্ণণা আগে দিয়েছি। তবে, আরও একটি কাজ করেছি। সিড়ি দিয়ে ওঠার সময় ধাপগুলো গুনেছি। এবং ডা. ওয়াটসনের মতো আমিও ১৭ ধাপ পেরিয়ে দোতলার স্পাডিতে পৌছেছি!!! (হয়তো ২৩৯ কে বেছে নেওয়ার এটাই কারণ!)
স্টাডি রুম দিয়ে শুরু করা যাক। ঢুকেই বামদিকে ওয়াটসনের ডেস্ক। ডেস্কটাতে মেডিকেলের কয়েকটি বই আছে। তবে, এটার ওপরে একটা দৈনিক পত্রিকা আছে ১৮৮১ সালের। ১৮৮১ সালের কেন? কারণ ১৮৮১ সালেই ডা. ওয়াটসনের সঙ্গে হোমসের এই বাড়িতে প্রথম দেখা হয়।
গাইডের কথার সঙ্গে মিল রেখে আমি হিসাব করে দেখলাম রুমটা অনেক বড় নয়। ছোট খাটো। ১০ বাই ৮ হতে পারে সর্বোচ্চ। বা আর একটু বেশি। দুটো দরজা। আমাদের অবশ্য বেশি ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হলো না। একটা অংশ দড়ি দিয়ে আটকে রেখেছে। তার মধ্যেই ওয়াটসনের টেবিল, হোমসের আরাম কেদারা আর হোমসের কোনার টেবিলটা।
এগুলো সব বামদিকে। যেখানটায় আমাদের আটকে দেওয়া হয়েছে সেখানে একটা ছোট টি-টেবিলও আছে। তার ওপর কিছু ব্যবহৃত জিনিসপত্র। কোনার দিকের ছোট টেবিলটা যেটাতে মাইক্রোস্কোপটা। ঐটার পাশেই আতশ কাঁচটাও আছে। ঠিক পাশেই হোমসের বিখ্যাত পাইপ। মনে হবে, এই মাত্র উনি গেলেন! স্তুপ করে রাখা পুরানো পত্রিকা, বই এবং কিছু টেস্ট টিউবও দেখলাম রাখা আছে।
এই রুমের দ্বিতীয় দরজাটা দিয়ে হোমসের বেড রুমে যাওয়া যায়। আবার বাহির থেকে যাওয়া যায়, সিড়ি দিয়ে ওঠে। হোমসের বেডরুমের দেওয়াল জুড়ে একগাদা লোকের ছবি। গাইড জানালো এগুলো সব সিরিয়াল কিলার বা বি(কু)খ্যাত সব অপরাধীদের। হোমসের বেডরুমের দেওয়ালে এর চেয়ে ভাল আর কী শোভা পেতে পারে! বিছানার ওপর একটা বাক্স। বাক্সটা খোলা। বাক্সের ডানার ওপরে একটা হ্যাট। হোমসের টুপি!  রুম জুড়ে আরও কিছু আছে।
ভাল কথা, হোমসের এসব জিনিষ কোথা থেকে আসলো!!!
আমার প্রশ্নবোধক চাহনি দেখে গাইড হেসে দিলেন। বললেন – হোমসকে নিয়ে যে সব সিনেমা, নাটক হয়েছে সেগুলোর অভিনেতারা যেসব প্রপস ব্যবহার করেছে সেখান থেকে এগুলো যাচাই বাছাই করে এনে রাখা হয়েছে। খেয়াল করা হয়েছে যাতে কোনভাবে পাঠকরা অন্যরকম না ভাবে। বেশিরভাগ সিডনি পেইজের করা চরিত্র থেকে নেওয়া হয়েছে।
৪.
একটু ধাতস্থ হয়ে হোমসের বেড রুম থেকে বের হলাম। গাইড জানালো আরও দুই ফ্লোর আছে। তার মানে মোট চারতলা। গাইড না বললেও আমি যেতাম। যদিও আমার হাতে সময় খুবই কম।
প্রত্যেকটা রুমকে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। বেশিরভাগ রুমই ভিক্টোরিয়া আমলের ফার্নিচার। আর বিভিন্ন প্রপস! তিনতলার দুটো রুম চিনে নিতে তেমন কষ্ট হয় না। মিসেস হাডসনের রুমটাতে রাখা হয়েছে ভিক্টোরিয়া যুগের মেয়েদের ব্যবহৃত পোষাক। আর বাকী রুমটা আমাদের ডাক্তারের। ডা. ওয়াটসনের। ওখানেও বই-এর আধিক্য দেখলাম। দেওয়ালে ছবি, যথারীতি।
এর ওপরের তলাটা চমকে দেওয়ার মতো।  আর একটা রুম যেখানে  কিছু মোমের তৈরি ম্যানিকুইন রাখা হয়েছে। এ ঘরে আমার দেখা হয়ে গেল প্রফেসর মারিয়ার্টির সঙ্গে। সামনে যেতেই হাত নাড়ালো। বললাম – আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আমাদের দেশেও অনেক লোক তোমার নাম জানে”।
বললো – বাংলাদেশ মানে কবীর চৌধুরীর দেশ থেকে? ওর সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে? অনেক গুনী লোক।
বললাম – না, কবীর চৌধুরীর সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়নি।
শুনে প্রফেসর হাসলেন। বললেন – হোমস কিন্তু আমার সঙ্গে কখনো পারতো না। এখন এরা দেখো আমার পা ফ্লোরের সঙ্গে আটকে দিয়েছে। সেজন্য এখান থেকে বের হতে পারি না। আর মানুষ হোমসকে কেন ভালবাসে আমি জানি না। তুমিই বলো – প্রফেসর মারিয়ার্টি না থাকলে হোমসের কী দাম!
আমি ভাবলাম তাইতো। মনে পড়লো লেবাননের কবি খহলিল জিব্রানের কথা। তাড়াতাড়ি প্রফেসরের সামনে থেকে সরে গেলাম। এখানে আরও অনেকগুলো ম্যানিকুইন সাজানো।
বাড়ি এখানে শেষ। এখানেও হোমসের একটা ম্যানিকুইন রাখা আছে।
আরও একটা সিড়ি দেখলাম। যা দিয়ে সুন্দর সাজানো টয়লেটে যাওয়া যায়।
এক পাশেএকটা  স্টোর রুম! কিছু লাগেজ ফেলে দেওয়া আছে।
আর দশটা জাদুঘরের মতো নয় এই জাদুঘর।  খুব কম সংখ্যক নিদর্শনের সামনে কোন ব্যাখ্যা রাখা আছে। গাইডও আর ওপরে ওঠেননি। দুই তিন মিনিটের ছো্ট্ট ইন্ট্রো ছাড়া আর কিছুই বলেননি। নিচতলার শপটিতে অনেক স্যুভেনির বিক্রি করে তারা।

ওনারা জানেন দর্শকদের কল্পনাকে আটকানোর কোন মানে হয় না। বিশেষত যখন এখানে ঢুকতে মাত্র ১৫ পাউন্ড দিতে হয়!

মিউজিয়ামে তোলা ছবির এলবাম দেখতে পারেন

[কিশোর আলো’তে প্রকাশিত]

[আমার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন টুইটার, লিংকডইন, ইউটিউব বা ফেসবুকে]

Leave a Reply