শুভ জন্মদিন সায়ীদ স্যার
চট্টগ্রাম টেলিভিশন পুন: সম্প্রচার কেন্দ্র চালু হয় ১৯৭৬ বা ১৯৭৭ সালে। তখন থেকেই সন্ধ্যার পর টেলিভিশনের সামনে বসে পড়ার একটা পায়তাড়া ছিল। এ জন্য কোনো কোনো দিন বিকেলেই হোমওয়ার্ক করে ফেলতাম। টেলিভিশনে যে অনুষ্ঠানগুলো আমি দেখতাম তার মধ্যে একটা ছিল ফজলে লোহানীর ‘যদি কিছু মনে না করেন”। ফজলে লোহানী ছিলেন কেতাদুরস্ত ইংরেজ। স্যুট-বুট পরেই তিনি অনুষ্ঠান করতেন। যদি কিছু মনে না করেন ছিল বিটিভির দ্বিতীয় ধামাকা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান। আগেরটা ছিল সৈয়দ শামসুল হকের ম্যাগাজিন‘৭৬। ধামাকা অনুষ্ঠানের বাইরে স্নিগ্ধ, মোলায়েম এবং জ্ঞানমূলক দুইটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতেন পাজামা পাঞ্জাবীর একজন উপস্থাপক। এতো সুন্দর বাংলা বলতেন। আমরা হা হয়ে বসে থাকতাম। তখন শুনেছি এই অধ্যাপক ঢাকা কলেজের শিক্ষক। বাংলা পড়ান। এবং তাঁর ক্লাসে সিটি কলেজের ছেলেরাও এসে বসে থাকে! স্যারের নাম আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।
তার অনুষ্ঠানগুলো দেখার জন্য আমাদের বাসার সবাই বসে থাকতাম। কিছুদিন পরে, তিনি মানচিত্র নামে একটি অনুষ্ঠান করতে শুরু করেন। সম্ভবত প্রতি শনি ও মঙ্গলবার রাত আটটার বাংলা খবরের পর সেটা দেখাতো। এই অনুষ্ঠান দেখার জন্য বসে থাকতাম কারণ বিশ্বের জ্ঞানভান্ডারের নানা অংশ দিয়ে এটি সাজানো হতো। অনুষ্ঠানে জুয়েল আইচ একটি জাদু দেখাতেন এবং বলতেন জাদুর গল্প। (বরিশালের স্কুলের প্রধান শিক্ষককে বরেণ্য জাদুকর জুয়েল আইচ বানান স্যা্র)। স্যার সূত্রধরের কাজ করতেন। মুগ্ধ হয়ে দেখতাম।
বুয়েটে পড়ার জন্য ঢাকায় এসে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ঘোরাঘুরি শুরু করি। আমার নিজের স্থির বিশ্বাস আমার এখনকার আমি হয়ে ওঠার পেছনে ঐ সময় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের একটা বড়ো ভূমিকা আছে। বুয়েট থেকে হেটে আমি বাংলা মোটরের বিসাকে-তে যেতাম। সেখানে বসে দেশ পত্রিকা ও অন্যান্য পত্রিকা। আসার সময় দুইটি বই নিয়ে আসতাম (বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অভিজ্ঞতা আমার আত্মজীবনীর প্রথম খন্ড পড়ো পড়ো পড়ো-তে বিস্তারিত লিখেছি)।
তো, এর অনেক পরে স্যারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রেও যাওয়া হয়েছে। স্যারের লেখাও পড়েছি। স্যারের অনেক বক্তৃতাও শুনেছি।
ডাচ বাংলা ব্যাংক প্রথম আলো গণিত উৎসব শুরু হওয়ার পর আমার একটা কাজ হলো উৎসবে খাতা দেখার সময় শিক্ষার্থীদের ব্যস্ত ও এনগেজ রাখা। এই সময় আমি প্রথম টের পাই গল্প বলাটা হচ্ছে সবচেয়ে ভাল। কাজে আমি শুরু করি গল্প খোঁজার কাজ। আর এই সময় আমি স্যারের কাছ থেকে শোনা নানা গল্প ব্যবহার করতে শুরু করি, আমার মতো করে।
এর মধ্যে মানচিত্র জোড়া লাগানোর গল্পটা আমার নিজের জন্যই ছিল একটি অনুপ্রেরণা। এক ছেলে তার বাবার বাংলাদেশের মানচিত্র ছিড়ে ফেলে। বাবার মারের ভয়ে সে সেটা আবার জোড়া লাগিয়ে দেয়। ভূগোলের জ্ঞানশূণ্য পুত্রের এই সাফল্যে বাবা অবাক হলে ছেলে তাকে জানায় – আমি মানচিত্র জোড়া লাগাইনি। ঐ ছবির পিছনে অনেকগুলো মানুষের ছবি ছিল। আমি মানুষগুলোকে জোড়া লাগিয়েছি। মানচিত্রটা জোড়া লেগে গেছে। মানুষ জোড়া লাগলে কেন একটা দেশের মানচিত্র উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তা বোঝানোর এর চেয়ে সুন্দর কোন উদাহরণ আজও আমি পাইনি।
আর একটি গল্প হলো কলসির মধ্যে আটকে পরা জ্বিনের গল্প, আরব্য উপন্যাসের। স্যারের প্রশ্নটাই আমি সবাইকে করি – এতো শক্তিশালি একটা জ্বিন কীভাবে একটা কলসির মধ্যে হাজার বছর আটকে থাকে?
ভাল কথা। যখন স্যাটেলাইট টেলিভিশন এ দেশে আসে, তখন জিটিভির একটা অনুষ্ঠান খুবই জনপ্রিয় হয়। আনু মালিক উপস্থাপিত এই অনুষ্ঠানের নাম ছিল আন্তাক্ষরি। গানের শেষ কলি থেকে নতুন গান গাওয়ার অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান দেখার সময়ই আমরা জানতাম এই আন্তাক্ষরির ব্যাপারটা সায়ীদ স্যার সেই সত্তর দশকে বিটিভির সপ্তপদী অনুষ্ঠানেই করেছেন।
স্যার এখন আর টিভি অনুষ্ঠান করেন না। কিন্তু চালিয়ে যাচ্ছেন ‘আলোকিত মানুষ’ গড়ার সংগ্রাম। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র এখন বিকশিত হয়ে বড় অবকাঠামো হয়েছে। নানা কলেবরে সারা দেশে বই পড়ার কার্যক্রম এগিয়ে চলেছে।
আজ ২৫ জুলাই স্যারের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন স্যার।
আল্লাহ তায়ালা আপনাকে হায়াতে তৈয়বা দান করুন। আপনি আমাদের মাথার ওপরে ছায়া হয়ে থাকুন। মানুষকে আলোকিত করুন।
আলোর বড়ই দরকার এই দেশে!
[আমার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন টুইটার, লিংকডইন, ইউটিউব বা ফেসবুকে]