শুভ জন্মদিন নবী
কুমিল্লা থেকে একটা মাইক্রোবাস রওনা হয়েছে, উদ্দেশ্য ফেনী। পরদিন ফেনীতে গণিত উৎসব। গাড়ি রওনা দেওযার কিছুক্ষণের মধ্যে একটা ফোন, ওভারসীজ কল।
‘মুনির ভাই, চৌদ্দগ্রাম বাজারের ওখানে বাবু আপনাদের জন্য দাড়ায় থাকবে। ওখানে থেকে আমাদের বাড়ি কাছেই।” ব্রাসেলস থেকে ফোন করেছে আমাদের ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ নবী। এর পরের অংশটুকু এক বিরাট ইতিহাস।
আমরা সন্ধ্যার সময় একটা বাড়িতে গিয়ে পৌঁছায়। আমাদের সামনে কম করে হলেও ১০-১২ পদের পিঠা পরিবেশন করা হয়। আমরা ভাবলাম, যাক ফেনীর ডিনারকে তাহলে ট্রিকসে ফেলা গেল। আমরা সবাই চেটেপুটে সব পিঠা খেয়ে শেষ করে ফেললাম।(কারো কারো ইচ্ছা ছিল বাক্সে নেওয়ার। প্রথমবার বলে সেটা করা গেল না)। তারপর চা। তারপর আমরা একটু বিশ্রাম নিলাম এবং ঘোষণা করলাম- এবার তাহলে আমরা উঠি!
“উঠি মানে?” – বাড়ির কর্তা অবাক হয়ে বললেন। ভিতর বাড়ি থেকে নবীর মাও বের হয়ে আসলেন।
“তোমরা যদি না খেয়ে যাও তাহলে নবীকে আমি কি বলবো?”
…
…
আমরা পরস্পরের দিকে তাকাই। তারপর মেনে নেই। কিন্তু পেটে তো এককাপ চা খাওয়ারও জায়গা নেই। কী করি? আমরা বের হয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। বাড়ির সামনে একটু এগোতে স্কুলের বিরাট মাঠ। ব্যাস আমরা সেখানে গিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করলাম।
তারপর আমরা আবার ঐ বাড়িতে খেয়েদেয়ে ফেনী চলে গেলাম!
খালি দু:খ, আমাদের সঙ্গে নবী নেই!
নবীকে আমি প্রথম কবে দেখেছি?
মনে করার চেষ্টা করি। ২০০১ সালে নিউরনে অনুরণন দিয়ে আমাদের গণিত অলিম্পিয়াডের কাজ শুরু হয়। ২০০২ সালের ২৬ জানুয়ারি সিএ ভবনে আমরা প্রথম একটা মিনি অলিম্পিয়াড করি। সেখানে অনেকে নিজে থেকে এসে যোগ দিয়েছিলেন। কাউকে ডেকে আনার মত ফুরসৎ আমার ছিল না কারণ তার আগের কয়েকদিন আমি কেবল বিভিন্ন মায়ের কাছে গিয়েছি তাদের ছেরে/মেয়েকে একবেলার জন্য চেয়ে আনতে।
আমি সকাল বেলায় গিয়ে দেখি এক ভদ্রলোক দাড়িয়ে আছেন মিলনায়তনের বাইরে। গেট তখনো খুলে নাই। উনি গৌরাঙ্গ স্যার (প্রয়াত ড. গৌরাঙ্গ দেব রায়)। সিলেট থেকে এসেছেন।
যখন জাতীয় সংগীত শুরু হয় তখন ছোটখাটো গড়নের অধ্যক্ষ হারুন অর রশীদ স্যার সেখানে আসেন, খুলনা থেকে। স্যার পেছনের রো’তে দাড়িয়ে যান। আমি স্যারকে আনার জন্য যাই। সেখানে সম্ভবত একজন নাদুস-নুদুস ছেলেকেও আমি দেখেছি।
তারপর ১৬ ফেব্রুয়ারি নায়ায়নগঞ্জ, রাজবাড়ি আর শেষে চট্টগ্রামের তিনটের পর ২০০৩ সালের প্রথমটা সাস্টে। তখন হিটলার (হিটলার এ হালিম) আমার প্রধান সেনাপতি। সাস্টে গাজিউল হক সোহাগ। পরের বছর আমরা জুন মাসে শুরু করি ৬ বিভাগে উৎসব আর জাতীয়। সে সময়ে কারো না কারো রেফারেন্সে নবী আমাদের দলে লেফ্টেন্যান্ট হিসাবে যোগ দেয়। সেবারই আমরা মাইক্রোবাসে করে সারাদেশে (বিভাগীয় শহরে) গেলাম। নবী হলো আমাদের ট্রান্সপোর্ট ম্যানেজার। নানান ঘটনা। দু’টো বলি।
রাজশাহী থেকে আমাদের রওনা দিতে দিতে রাত হয়ে গেল। আমরা খেয়ে দেয়ে হেলেদুলে রওনা দিলাম। গাড়িতে আমি, নবী ছাড়াও আছেন গৌরাঙ্গ স্যার, আনোয়ার স্যার, জাফর ইকবাল স্যার। আর? রাত ১টা-দেড়টার দিকে আমরা নাটোরের কাছ দিয়ে যখন যাচ্ছি তখন বনলতা সেনের পাশাপাশি অন্য যে আলোচনাটি উঠে আসে সেটি হল – নাটোরের কাঁচাগোল্লা। আনোয়ার স্যার বললেন – নবী, গাড়ি ঘুরাও। আমরা কাঁচাগোল্লা খাবো। রাত দুইটার সময় আমরা নাটোর শহরে রাজবাড়ির মোড়ে এক ময়রার দোকানে হাজির হলাম। তখনো কাঁচাগোল্লা নামেনি। আমরা প্রায় আধাঘন্টা বসে থাকলাম এবং তারপর কাঁচাগোল্লা খেয়ে রওনা দিলাম!
বরিশাল থেকেও রাওনা দিতে দিতেও মেলা রাত হয়ে গেল। সেসময় কেন্দ্রীয় টিমই একইসঙ্গে অর্গ্রবর্তী, পরবর্তী, একাডেমিক আর অনুষ্ঠান- সব কাজই করতো। প্রবল বৃষ্টিপাত! ভাঙ্গা-টাঙ্গা কোন এক জায়গায় গাড়ি হঠাৎ করে থেমে গেল। তারপর আমরা দেখলাম এক অভাবনীয় কীর্তি। আমাদের ড্রাইভার ব্যাকগিয়ারে চলে গেল কয়েক কিলোমিটার। কারণ সামনে ডাকাতি হচ্ছে!!! তারপর এক থানার সামনে আমরা বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। তারপর আবার রওনা দিলাম। পান্থ ঠিক করেছিল সে রাজবাড়ির মোড়ে নামবে। কিন্তু প্রবল বৃষ্টি দেখে সে আর নামলো না। গৌরাঙ্গ স্যার তখন পান্থকে নিয়ে তাঁর বিখ্যাত কবিতা – কেন পান্থ ক্ষান্ত হও, হেরি বৃষ্টির রাত” বলে ফেললেন! তখন থেকেই নবী আমার আত্মার দলে!
এরই মধ্যে হিটলারের প্রমোশন হল। সে চলে গেল অন্য পত্রিকায়। আমি একজন সমন্বয়কারী খুঁজতে থাকলাম। এবং কেমন করে জানি নবী আমাদের সমন্বয়কারী হলো। হিটলার, পান্থ বা সোহাগ কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে সমন্বয়ক ছিল না। যদিও কাজটা তারাই করতো। আর উৎসবের সমন্বয়কারী হিসাবে কাগজে কলমে আমিই স্বাক্ষর করতাম। কিন্তু নবীকে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব দিলাম। সেই থেকে দীর্ঘদিন নবী আমাদের গণিত উৎসবের সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেছে, অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে। আজকের গণিত অলিম্পিয়াডের বিস্তৃতির পেছনে নবী এবং নবীর মতো অনেকেরই আনন্দ, ভালবাসা ও শ্রম মিশে আছে। আছে বেদনাও। নবীর একটা বড় গুণ হচ্ছে ওর আমলে আমাকে কোন কাগজ দুইবার লিখতে হয়নি। প্রথমবারের পরই ও ব্যাপারটা ধরে ফেলতো। কাজে পরেরবার সই করলেই হত। সে সময় আমরা প্রতিবছর ১০ হাজার স্কুলে একটা চিঠি পাঠাতাম। সেটা যে কেমনে যেতো তা আমি বলতে পারবো না!
গণিত অলিম্পিয়াড আর উৎসব যখন বড় হতে শুরু করে তখন সেটিকে কাঠামোবদ্ধ (সৃজনশীল নয়!!!) করার কাজটা শুরু হল। লজিস্টিক আর একাডেমিক টিম আলাদা হল। সুব্রতকে দায়িত্ব দেওয়া হল একাডেমিক টিম গোছানোর। আমি ঠিক করলাম আমি আর প্রশ্ন করবো না!
আমাদের শুরুর অনুষ্ঠানগুলোতে আমরা নানান কিছু করতে করতে একটা ফরম্যাট দাঁড় করিয়ে ফেললাম। যেহেতু সব অনুষ্ঠানই আমি সঞ্চালনা করতাম তাই আমি ভাবতাম সব আমার মাথায় থাকে। কিন্তু পরের বার, মানে ২০০৬ সালেই নবী আমাকে অনুষ্ঠানস্থলে একটা কাগজ ধরিয়ে দিল। দেখলাম ও আমরা যা যা করি তার একটা লিস্ট বানিয়ে ফেলছে! তখন থেকে আমি ঐ কাগজ দেখে দেখে অনুষ্ঠান করতাম। আর সেবারই আমি বুঝতে পারলাম আমি না থাকলেও গনিত অলিম্পিয়াড চলবে। এ যে কত বড় আনন্দ তা বোঝানো মুশ্কিল।
গণিত উৎসবের সঙ্গে নবীর ভালবাসাটা অন্যরকম। আল্লাহ তায়ালা চেয়েছিলেন নবীর এই ভালবাসাটি ইতিহাসের অংশ হোক। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ গণিত দলের সঙ্গে জার্মানীতে নবী গিয়েছে পর্যবেক্ষক হিসাবে। আর আমরা প্রথম পদক জিতেছি। পদকের খবর পেয়ে ঢাকা থেকে সুমী (সুমনা শারমিন, ফিচার সম্পাদক, প্রথম আলো) আপা ফোনে আমাকে বললেন – নবীর যাওয়ার জন্যই বাংলাদেশের প্রথম পদক এতোদিন অপেক্ষা করেছে!
নবী এখন ইউরোপের নানান দেশে থাকে। আমরা যখন কেও ইউরোপে যাই তখন সে কেবল জীবনটা দিতে বাকি রাখে। আর সবটাই সে করে। ২০১১ সালে আমাদেরকে যে খাতির যত্ন করেছে সেটা এখানে লিখলে বেচারা লজ্জা পাবে।
শুরু দিকে নবী দেমে চলে আসার জন্য ঘ্যান ঘ্যান করতো। আমি বলতাম- ফেরৎ আসলে ঠ্যাং ভেঙ্গ হাতে ধরিয়ে দেবো। ও বলতো – পা, প্লাস্টার করে আসবে!
এর মধ্যে একবার এসে ঘুরে গেছে গত বছর। ও আসার এক দিন পরেই আমি দেশের বাইরে চলে যাই। তাই বড় কোন সেলফি তোলা হয়নি!
আজ নবীর জন্মদিন।
বিদেশ বিভুঁই-এ বেচারা ঠিক মত খেতে না পেয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। আজকে সবাই তার জন্মদিন উপলক্ষে খাওয়া দাওয়া করে সেই ছবিতে নবীকে ট্যাগ করতে পারে। আর দোয়া করেন ২০১৬ সালের মধ্যে যেন নবীর একাকীত্বটা কাটে!
আমাদের সকল শুভকামনা তাকে আরো অনুপ্রাণিত ও সাফল্য মন্ডিত করবে, ইনশা আল্লাহ!
নবীর সেকেন্ড ডিফারেন্সিয়াল নেগেটিভ হোক।
তার জীবন পাই-এর মত সুন্দর হোক।