হজ অব্যবস্থাপনা : দায় কার?
এ বছরের জাতীয় হজনীতির কথাই ধরা যাক। প্রতিবছর এই নীতিটি হালনাগাদ করা হয়, যাতে হজ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত সব সংস্থা এ-সংক্রান্ত সব বিষয়ে সময়মতো যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে। ২০১৫ সালের হজের সময় সংঘটিত দুর্ঘটনা এবং বিশ্বব্যাপী তেলের দাম কমে যাওয়ায় সৌদি আরব ২০১৬ সালের ২ অক্টোবর (১ মুহররম) নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে। সেখানে জানানো হয়, এখন থেকে সৌদি সরকার বিশ্বের সব মুসলমানের জন্য একবার হজ পালনের এবং একই বছরে একবার ওমরাহ পালনের ভিসা ফ্রি বা কোনো অর্থ ছাড়াই দেবে। কিন্তু কেউ যদি একাধিকবার হজে যেতে চান কিংবা একই বছরে একাধিকবার ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরবে যেতে চান, তাহলে তাঁদের নির্ধারিত ভিসা ফি প্রদান করতে হবে। সৌদি মুদ্রায় এটি ২ হাজার রিয়াল, যা বাংলাদেশি প্রায় ৪৪ হাজার টাকা। সৌদি সরকারের এ ঘোষণার পর আরব বিশ্বের একাধিক সংবাদমাধ্যমেও এ খবর ছাপা হয়েছে। সৌদি সরকারও নিশ্চয়ই এ খবর সব দেশ, বিশেষ করে যেসব দেশ থেকে হজযাত্রীরা যান, তাঁদের বিশেষভাবে অবহিত করেছে।
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছরই হজে যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তির সংখ্যা বাড়ছে। একাধিকবার হজে যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তির সংখ্যাও কম নয়। আমার হিসাবে এটি ১৫ শতাংশের বেশি হতে পারে। একাধিকবার হজ পালনকারীদের জন্য ভিসা ফি প্রদানের এ নিয়মের কিছুই জাতীয় হজনীতিতে প্রতিফলিত হয়নি। অথচ সৌদি সরকারের ঘোষণার প্রায় পাঁচ মাস পর ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ আমাদের হজনীতি প্রকাশিত হয়েছে। এবং একই দিন প্রকাশিত হজ প্যাকেজ ২০১৭-এর কোথাও এ বিষয় উল্লেখ করা হয়নি। কাজেই কোনো হজ এজেন্সিও এ ব্যাপারে হজে যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের অবহিত করেনি। কিন্তু হজ এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি যখন সবাই জানতে পারে, তখন হজ এজেন্সিগুলো একাধিকবারের হাজিদের বিষয়টি জানাতে শুরু করে। জাতীয় হজনীতিতে উল্লেখ না থাকায় অনেকেই এটি এজেন্সিগুলোর একটি বাড়তি আয়ের পথ মনে করলে কি তাদের দোষ দেওয়া যাবে?
আমাদের দেশে হজে যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের অনেকে নিজের কাফেলায় এমন একজন বা একাধিক জনকে প্রত্যাশা করেন, যাঁর পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ কারণে কাফেলাগুলোও একইভাবে তাদের পরিকল্পনা করে। কিন্তু এ বছর এ পরিকল্পনা করার সময় পুরোনোদের অতিরিক্ত ৪৪ হাজার টাকা জানা না থাকায় খরচের হিসাবটাও ভিন্নভাবে করা হয়েছে। এ দায় তাহলে কার?
এরপর আসা যাক বাড়িভাড়া প্রসঙ্গে। বাড়িভাড়ার কাগজপত্র ঠিকমতো দেখাতে না পারলে যে ভিসা হয় না, এটি প্রায় সবাই জানেন। এজেন্সিগুলো সেভাবে কাজ করছে কি না তা দেখভালের দায়িত্ব মন্ত্রণালয় ও হজ অফিসের। কেবল জাতীয় হজনীতিতে উল্লিখিত বিষয়গুলো নিশ্চিত করা হলেই ঘরভাড়া করাসংক্রান্ত যে জটিলতা এখন দেখা দিয়েছে, তা কখনোই হতো না। নীতিমালার ৮.২.৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এজেন্সির সঙ্গে মক্কা-মদিনার বাড়িভাড়ার চুক্তি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তারপরই কেবল সৌদি আরবের হজ মিশন এজেন্সিগুলোকে ছাড়পত্র দেবে। কাজটা যদি ঠিকমতো করাই হবে, তাহলে এখন কেন হঠাৎ করে জানা যাবে যে অধিকাংশ হজ এজেন্সি ২০ আগস্টের পর বাড়ি ভাড়া করেছে? বর্তমানে হজ ব্যবস্থাপনায় তথ্যভান্ডারে এ তথ্য থাকলে তো আগেভাগেই সবার জানার কথা। এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা।
সবাই জানেন যে জিলহজ মাস এগিয়ে আসতে থাকলে মক্কা নগরীতে ঘরভাড়া বাড়তে থাকে। এ কারণে আমাদের এজেন্সিগুলো এ সময়ের আগেই হজযাত্রীদের মক্কা থেকে মদিনায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে এবং ৬-৭ জিলহজ তাঁদের মক্কায় নিয়ে আসে। হজের নিয়মানুযায়ী এর পরবর্তী কয়েক দিন হাজিদের মিনায় থাকার কথা। এজেন্সিগুলো এ সময় মিনার নিকটবর্তী আজিজিয়া বা সে রকম জায়গায় হাজিদের মধ্যবর্তী সময়ে থাকার ব্যবস্থা করে। যেসব হাজি প্রথমে মক্কায় থেকে হজের আনুষ্ঠানিকতা সারতে চান, তাঁদেরই ১ জিলহজ বা এর দু-এক দিন আগে থেকে মক্কা নগরীতে বাসা ভাড়া করে রাখতে হয়। এ কারণে এসব প্যাকেজের খরচও বেশি। কয়েক বছর ধরে এসব প্যাকেজে যাওয়া হাজির সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে। এ হিসাবটিও যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না।
এবার আসা যাক বিমানের ফ্লাইট প্রসঙ্গে। এ পর্যন্ত বাতিল হওয়া ফ্লাইটগুলোর বাতিলের কারণ পর্যাপ্ত যাত্রী না পাওয়া। এর কারণ হয় হজযাত্রীরা ভিসা পাননি অথবা এজেন্সির ঘর ভাড়ার সময় হয়নি। এ দুটি বিষয় নিশ্চিত না হয়ে বিমান কীভাবে তাদের ফ্লাইট শিডিউল করেছে? এর মানে হচ্ছে এ ব্যাপারটায় কোনো সমন্বয় ছিল না। প্রতিবছরের এ অভিজ্ঞতা থেকেই সম্ভবত জাতীয় হজনীতিতে বিমানের ফ্লাইট-সংক্রান্ত সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। হজযাত্রীদের বহনের জন্য হজনীতিতে একটি আলাদা অধ্যায় রয়েছে। সেখানে সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদসমূহে ফ্লাইটের সময় নির্ধারণ, যাত্রীর নিশ্চয়তা ইত্যাদি সমন্বয়ের জন্য সভা করা, প্রয়োজনীয় তথ্যাদি বিনিময় করা এবং সব পক্ষের দায়িত্ব নির্দিষ্ট করা হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ বিমানকে এ বিষয়ে সব কর্মকাণ্ড সমন্বয় করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সমন্বয়ের কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন হলে বিমান কর্তৃপক্ষ আগেভাগেই জানতে পারত যে তাদের নির্ধারিত ফ্লাইটে যাওয়ার মতো কোনো যাত্রী নেই। ফ্লাইট শিডিউল করার আগেই এ বিষয়গুলো সঠিকভাবে দেখভাল করা মোটেই কোনো অসম্ভব কাজ ছিল না।
দুঃখজনক যে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো প্রতিবছরই কিছু রুটিন কাজ দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু কখনোই এ ব্যাপারে কাউকে দায়ী করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এ-সংক্রান্ত ভুলগুলো সংশোধন করে তা এড়ানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এমনটি দেখা যায় না। প্রতিবছর হজ ব্যবস্থাপনায় যে অবহেলা ও গাফিলতির নজির দেখা যায়, তার কোনো তুলনা মেলে না।
এসব কারণে এ বছর কয়েক হাজার মানুষের হজে যাওয়া এখনো অনিশ্চয়তায়। আশা করি, সব হজযাত্রীর হজে যাওয়ার নিশ্চিত ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে।
(১৭ আগস্ট ২১৭, দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত)