বিপ্লব মোকাবিলায় চাই বিপ্লবী উদ্যোগ

Spread the love

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ট্যাক্সি কোম্পানি উবারের নিজের কোনো ট্যাক্সি নেই, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিডিয়া ফেসবুক নিজে কোনো কনটেন্ট তৈরি করে না, পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাইকার আলিবাবার কোনো গুদাম নেই এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় আবাসন প্রোভাইডার এয়ারবিএনবির নিজেদের কোনো রিয়েল এস্টেট নেই।—টম গুডউইন

গত ডিসেম্বরে ম্যানিলায় হয়ে যাওয়া আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের তিনজন শিক্ষার্থীর একটি দল স্বর্ণপদক পেয়েছে। এই দলের সবচেয়ে খুদে শিক্ষার্থীর বয়স ছিল মাত্র আট বছর! যে বয়সে আমরা পুতুল খেলতাম, সেই বয়সে এখন ওরা রোবট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় নিজেদের বুদ্ধির প্রয়োগ দেখাচ্ছে! তবে রোবট শিশুদের জন্য যত আনন্দ বয়ে আনছে, বড়দের জন্য ততটা আনন্দের খবর কিন্তু জোগাচ্ছে না।

পিডব্লিউসি নামের চিন্তক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, স্বয়ংক্রিয়করণ ও রোবটিকসের পাল্লায় ২০৩০ সালে বিশ্বের ৮০ কোটি বর্তমান চাকরি নাই হয়ে যাবে। এই ঝড় মূলত বয়ে যাবে শ্রমনির্ভর কাজের বেলায় এবং স্বভাবতই আমাদের মতো শ্রমনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলো বিপদে পড়বে। আমাদের রপ্তানির প্রথম উৎসই তৈরি পোশাক। একসময় আমরা ভাবতাম ভারত, চীন বা ভিয়েতনাম আমাদের প্রতিপক্ষ। কিন্তু রোবটের কল্যাণে পশ্চিমারা তাদের কাপড় সেলাইয়ের কাজটা আবার নিজ দেশে নিয়ে যেতে পারে!

এসবই সেই বিপ্লবের আলামত, যার কথা আমি বলতে শুরু করেছি ২০১৬ সাল থেকে। সেই বছরের ১১ জানুয়ারি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের কর্তাব্যক্তি ক্লাউস শোয়াইবের একই নামের বইটি প্রকাশিত হয়। প্রথম শিল্পবিপ্লব হলো বাষ্পীয় ইঞ্জিন। পানি আর বাষ্পের ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্ধি। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব হলো বিদ্যুৎ ব্যবহার করে গণ–উৎপাদন। তৃতীয় শিল্পবিপ্লব হলো ইলেকট্রনিকস আর ইনফরমেশন টেকনোলজিকে কেন্দ্র করে কদিন আগে যা ঘটছে, তা–ই। এটি শুরু হয়েছে গেল শতকের মাঝামাঝি সময়ে যখন ট্রানজিস্টর আবিষ্কৃত হয়। আর এই তৃতীয় বিপ্লবের ওপর ভর করেই এখন একটি নতুন বিপ্লব, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়েছে। এই হচ্ছে প্রযুক্তির একধরনের মিথস্ক্রিয়া, যার ফলে ভৌত জগৎ, ডিজিটাল জগৎ আর জীবজগতের মধ্যে পার্থক্যটা হয়ে যাচ্ছে বায়বীয়।

কয়েক শ কোটি লোকের মুঠোফোনের মাধ্যমে সংযুক্ত থাকা, অকল্পনীয় প্রসেসিং আর স্টোরেজ ক্ষমতা এবং সহজে জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশাধিকারের ফলে কোথায় যে সভ্যতা যাবে, তা চিন্তা করাও কঠিন বটে। নিত্যনতুন প্রযুক্তির আবির্ভাবে সবকিছুতে একটা ভ্যাবাচ্যাকা লেগে যাচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকস, ইন্টারনেট অব থিংস, নিজে চলা গাড়ি, ত্রিমাত্রিক প্রিন্টিং, ন্যানো টেকনোলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োটেকনোলজি, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, শক্তি সঞ্চয় কিংবা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং। আর ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিমেষে হাজার হাজার লোকের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে। পাঁচ কোটি লোকের কাছে রেডিওর পৌঁছাতে লেগেছে ৩৮ বছর, টেলিভিশনের ১৩ বছর। অথচ ইন্টারনেটের লেগেছে ৪ বছর। আইপডের জন্য সময়টা মাত্র তিন বছর আর ফেসবুকের? ২৪ মাস!

আর এই গতির কারণেই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ঢেউ এসে পড়েছে আমাদের দেশেও। পাল্টে যাচ্ছে আমাদের সামাজিক বিষয়-আশয়ও। আমি দেখেছি, কত অবলীলায় কর্মজীবী নারী কিংবা ইউনিভার্সিটির পড়ুয়া মেয়ে অপরিচিত পাঠাও ড্রাইভারের পেছনে মোটরসাইকেলে উঠে পড়ছেন। গভীর রাতে আপনি কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই উবারে করে বের হয়ে পড়ছেন বাসা থেকে। ‘ফেসবুকের ফ্রেন্ড’ কিন্তু বাস্তবে চেনেন না এমন কাউকে দিয়ে বানিয়ে নিচ্ছেন আপনার প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট।

আর এসবের ফলে এক নতুন সম্ভাবনারও সৃষ্টি হয়েছে। কর্মসংস্থানের কথাই ভাবুন। গত দুই বছরে একটি ছোট্ট স্টার্টআপ কোম্পানি যত নতুন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে, সেটির কথা ভাবতেও পারে না আমাদের ৫০ বছর বয়সী কোনো করপোরেট সংস্থা। মোটরবাইক শেয়ারিং সার্ভিস পাঠাও গত কয়েক বছরে প্রায় দেড় লাখ বাইকারের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে; যদিও এর জন্য তার একটিও মোটরসাইকেল কিনতে হয়নি! মাত্র পাঁচ বছর আগেও বাংলাদেশের গ্রামের কোনো মাতবর ভেবেছেন তাঁর গ্রামের জমির আলে মোটরসাইকেল চালিয়ে যে তরুণ শ্রম ও সময় নষ্ট করছেন, সেই একই কাজ ঢাকায় গিয়ে করে মাসে ২০ হাজার টাকা আয় করতে পারবেন?

পিডব্লিউসি ঠিক এ কথাই বলছে। ৮০ কোটি চাকরির জায়গায় নতুন ১০০ কোটি কাজের সৃষ্টি হবে তরুণদের জন্য, তৈরি হবে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র আর সেসবের জন্য লাগবে ভিন্ন দক্ষতা।১২ ও ১৩ মার্চ দুই দিন ধরে ঢাকার একটি হোটেলে যথাক্রমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ড, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ও ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভের উদ্যোগে দুটি পৃথক অনুষ্ঠানে এ বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে।

ভারতভিত্তিক চিন্তক প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সমীর সরন সেখানে বলেছেন, যে নতুন কাজগুলো তৈরি হবে, সেগুলোর কিছু আমরা দেখছি আবার কিছু দেখছি না। কাজে কেবল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে নতুন প্রজন্মকে তৈরি করার কাজটা ছেড়ে দিয়ে রাখলে লাভ হবে না। গড়ে তুলতে হবে জীবনব্যাপী শেখার (লার্নিং) সংস্কৃতি। তাঁর হিসাবে বাংলাদেশের ৬ কোটি তরুণকে এই নতুন বিপ্লবের জন্য তৈরি করতে হলে লার্নিং খাতে প্রতিবছর ৬০ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে, যা কিনা আমাদের জিডিপির ২৫ শতাংশ এবং মোদ্দাকথা, অসম্ভব! তাহলে কেমন করে এটি হবে? হবে, যদি আমরা বেসরকারি খাতকে এ কাজে সামনে নিয়ে আসতে পারি। কারণ, সরকারি ভর্তুকি ছাড়া এটি করতে হলে দরকার নতুন ও উদ্যমী উদ্যোক্তা, যারা নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলবে এবং একই সঙ্গে সৃষ্টি করবে নতুন কর্মসংস্থান।

দুই দিনই আমি বলার চেষ্টা করেছি, ঠিক এ জন্য আমাদের সরকারকেও হতে হবে ভিন্ন মাত্রার। এখনো এই দেশে একটি ভার্চ্যুয়াল শপ বা ইন্টারনেটভিত্তিক ব্যবসা, যা কিনা বাসায় বসে তরুণ-তরুণীরা তাঁদের ল্যাপটপ বা স্মার্টফোনে করতে পারেন, তার জন্য ট্রেড লাইসেন্স (বিজনেস লাইসেন্স নয়!) নিতে গেলে সিটি করপোরেশন বা ইউনিয়ন পরিষদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়, দিতে হয় ঘুষ! আর শতবর্ষের অধিক বয়সী আইনে লিখে রেখেছে ব্যবসা করতে হলে ‘বর্গফুট’ জায়গা থাকতে হবে, থাকতে হবে সেই জায়গা ভাড়া নেওয়ার বা মালিকানার চুক্তি! ফির কথা না বলি। অথচ আমাদের যুবার কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র আছে, সেটি দিয়ে তিনি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন, নিজের বাসায় ইন্টারনেট–সংযোগ দিয়ে গড়ে তুলতে পারেন বৈশ্বিক ব্যবসা। তবে বাংলাদেশে তিনি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলতে পারবেন না। [মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ওই অনুষ্ঠানে বলেছেন, বিষয়টি দেখবেন। দেখা যাক।]

আর যদি আমাদের যুবাটি আসতে চান শিক্ষাক্ষেত্রে? তাহলে তাঁর গায়ে জুড়ে দেওয়া হবে ‘কোচিং–বাণিজ্যের’ তকমা। বাংলাদেশ সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র দেশ, যেখানে প্রশিক্ষণের ওপর ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর দিতে হয়। কারণ, ‘প্রশিক্ষণ তো বাণিজ্যই’! অথচ এডুকেশন ও লার্নিং দুটোই জাতির জন্য বিনিয়োগ।

দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানে সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন প্রকল্পের একজন কর্মকর্তা জানালেন, তাঁরা একটি ‘সব সমস্যার সমাধানের দোকান’ খুলে রেখেছেন। তিনি বললেন, বেসরকারি উদ্যোক্তারা যদি তাঁদের কাছে যান, তাহলে তাঁরা সব সমস্যার সমাধান দিয়ে দেবেন! নিঃসন্দেহে অতি ভালো উদ্যোগ। তবে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলা করতে হলে সরকারকে ‘নিজে ব্যবসা করা’ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সরকারের মূল কাজ হবে শতবর্ষী আইনকানুন, পুরোনো নীতিমালাকে আধুনিক করা, মান্ধাতার আমলের চিন্তা–চেতনা থেকে বের হয়ে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং ছয় কোটি তরুণকে উৎসাহিত করা, তাঁরা যেন নতুন এই বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

যে সরকার ২০১৫ সালে তামাদি হয়ে যাওয়া জাতীয় ব্রডব্যান্ড নীতিমালা চার বছরেও হালনাগাদ করতে পারে না, সরকার অনুমোদন করার পর ২০ মাসেও আইসিটি শিল্পের রপ্তানিকারকদের একজনকেও মাত্র ১০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দিতে ব্যর্থ হয়, আইসিটি খাতে সরকারের অন্যতম সাফল্য হাইটেক ও সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই প্রণোদনার ভেতরে আনতে পারে না, তাদের ভেবে দেখতে হবে তারা এসব কাজে মনোযোগ দেবে, নাকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের পাসের সার্টিফিকেট যাচাই করার কাজে সময় কাটাবে।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব একটা বিপ্লব। আদিখ্যেতা নয়। সেটির মোকাবিলায় সরকারকেও বিপ্লবী হতে হবে কাজকর্মে, মুখে মুখে নয়!

 

(দৈনিক প্রথম আলো’তে ১৮ মার্চ ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত)

Leave a Reply