উদ্ভাবনের কল-কব্জা-৪ : গোল্লাপূরণের পরীক্ষা
উদ্ভাবনের কলকব্জা -১: উদ্ভাবন বৈষম্য???
উদ্ভাবনের কলকব্জা ২: বাক্সের বাইরে – ব্যাক টু ব্যাক লেটার অব ক্রেডিট
উদ্ভাবনের কলকব্জা ৩: দেখতে হবে আশে পাশে
১৯৯৩ সালের জুন মাস। কোন একদিন দুপুর বেলা আমাদের বুয়েট কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালক মুজিবুর রহমান স্যার সবাইকে জরুরীভাবে ডেকে পাঠালেন। এমনিতে আমরা সবাই কনফারেন্স রুমেই বসতাম যাতে সার্বক্ষণিক সবার সবার সঙ্গে যোগাযোগ থাকে। যাহোক স্যার ডেকে যা জানালেন সেটা হল আমাদের নিজেদের এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার কথা মনে আছে কী না? পরীক্ষার পেছনের মেকানিজম সম্পর্কে কোন ধারণা আছে কী না?
কারণ টের পেলাম পরেরদিন। আমি, মুজিবর রহমান স্যার আর লুৎফুল কবীর স্যার গেলাম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। ইরশাদুল হক সচিব। তার রুমে।
ইরশাদুল হক সাহবে সোজা-সাপ্টা মানুষ। তিনি বললেন – পরীক্ষার খাতা থেকে রোল নম্বর কেমন করে বাদ দেওয়া যায় সেটা ভাবেন।
তিনি বললেন – শিক্ষাবোর্ডে পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে যে সব সমস্যা হয় তার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে উত্তরপত্রে পরিক্ষার্থীর পরিচিতি। এর মাধ্যমে অনায়াসে খাতা ট্রেক করা যায়, খাতার মলাট ঠিক রেখে ভেতরের অংশ বদলে ফেলা যায়, গাড়ি নিয়ে (এবং অন্য কিছু সঙ্গে) প্রধান পরীক্ষকের বাসায় যাওয়া যায়।
সেই সময় পরীক্ষায় দুইটি অংশ – নৈর্ব্যক্তিক ও রচনামূলক।
আমরা খুব সহজে নৈর্ব্যক্তিক অংশের সমাধান চিন্তা করে ফেললাম – মার্কিং-এর জন্য কম্পিউটার লাগানো হলেই এই কাজটা হয়ে যাবে। রোল নম্বর থাকলেও সমস্যা নাই কারণ কোন মানুষ খাতা দেখবে না। সেই সময় ওএমআর টেকনোলজি চালু হয়েছে এবং মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করা হচ্ছে।
কিন্তু, রচনামূলক?
-সোজাতো। খাতাগুলোকে কোড করলেই হবে। পরীক্ষা শেষে খাতার ওপরে কোডিং করলেই হবে।
-দাড়ান। কত খাতা? ৫০ লক্ষ!!!
– ও তাইলে তো মুশ্কিল।
এর বুদ্ধিও আমরা বের করলাম। খাতা আগে থেকেই কোডেড থাকবে, প্রি কোডেড।
চিন্তা করতে হল বারকোড হবে না লিথোকোড। অনেক আলোচনা শেষে আমরা লিথো কোডকে বেঁছে নিলাম।
কিন্তু ঝামেলা আছে অন্য খানে, সেটা হল খাতা থেকে যদি রোলনম্বর অংশ ছিড়ে ফেলা হয় তাহলে পরে যদি থাতা খুঁজে পেতে হয় তাহলে ৫০ লক্ষের মধ্যে ঐ খাতাটা কেমনে খুঁজে পাওয়া যাবে?
তাহলে কী সব খাতা স্ক্যান করতে হবে।
– কিন্তু রেজাল্ট দেওয়ার জন্য তো পরিক্ষার্থীর নম্বর দরকার, খাতার দরকার নাই। তাহলে?
তারমানে এমন কিছু ভাবতে হবে যাতে আমাদের রোলনম্বরের সঙ্গে খাতাটার একটা সম্পর্ক থাকে এবং আবার খাতা স্ক্যান না করেই খাতাটা বের করা যায়।
সেটাই আমরা করলাম একটা অভিনব পদ্ধতিতে।
ঠিক হল – রচনামূলক খাতার প্রথম পৃষ্টায় মোট তিনটি অংশ থাকবে। এর মধ্যে দুইটি অংশ থাকবে পারফোরেটেড। যাতে সহজে ছিড়ে নেওয়া যায়। তৃতীয় অংশ থাকবে খাতার সঙ্গে যুক্ত। সব খন্ডেই একই লিথোকোড থাকবে।
প্রথম অংশে থাকবে শিক্ষার্থীর পরিচয়। মানে তার রোল নম্বর, বিষয়, সেন্টার ইত্যাদি। সেটা পরীক্ষার হল থেকে কম্পিউটার কেন্দ্রে চলে আসবে আলাদাভাবে। এই কাজটা করার জন্য পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা কেন্দ্রে খাতার ওপরের অংশ ছিড়ে ফেলা হবে এবং সেগুলো বান্ডেল করে কম্পিউটার কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। কম্পিউটার কেন্দ্রে তাহলে লিথোকোডের বিপরীতে রোল নম্বর ও অন্যান্য তথ্যের ডেটাবেস তৈরি হবে।
আর রোলনম্বর ছাড়া খাতাগুলো প্যাকেট করে চলে যাবে বোর্ডে। এখন এগুলোতে কোন রোলনম্বর নেই। কাজে রোল নম্বরের সমস্যাও নাই।
বোর্ড খাতাগুলো তাদের পরীক্ষকদের মধ্যে বিতরণ করবে। পরীক্ষক বাসায় গিয়ে প্রত্যেক খাতার দুটো অংশে তার নিজের পরিচিতি নম্বর (পরীক্ষক কোড) (শুরুতে এটি বান্ডেল নম্বর ছিল) আর খাতার সিরিয়াল নম্বর বসাবে। । সিরিয়াল নম্বর তিনি ১ থেকে শুরু করবেন। তাহলে পরীক্ষককোড আর সিরিয়াল নম্বর মিলে আমরা একটা ইউনিক আইডেন্টিটি পাবো।
পরীক্ষক খাতা দেখে বাকী কাজ করে খাতা পাঠিয়ে দেবেন প্রধান পরীক্ষকের কাছে। প্রধান পরীক্ষকের নিরিক্ষার পর খাতা থেকে দ্বিতীয় অংশ ছেড়া হবে। এবং পাঠিয়ে দেওয়া হবে কম্পিউটার কেন্দ্র। সেখানে এখন লিথোকোডের সঙ্গে খাতার আইডেন্টিটি এবং নম্বরের ডেটাবেস তৈরি হবে।
যেহেতু একই লিথোকোড দুইটি অংশেই আছে কাজে রোল নম্বরের বিপরীতে প্রাপ্ত নম্বরের ডেটাবেস তৈরি করে ফেলা সম্ভব হবে।
অন্যদিকে কোন রোল নম্বরের বিপরীতে ঐ খাতাটি যদি বের করতে হয় তাহলে পরীক্ষক কোড আর সিরিয়াল নম্বর বের করলেই হবে। তখন জানা যাবে খাতা কার কাছে আছে। খাতাটি তখন বের করা সম্ভব হবে।
তো, হয়ে গেল সমাধান। সিম্পল!!! জী, সিম্পল ইজ বিউটিফুল।
সে জন্যই বলি সহজ ভাবে চিন্তা করলেই সমস্যার সমাধান বের করা যায়। সেটা উদ্ভাবনীই হয় কারণ তা হয় সুন্দর।
ভালো কথা – এখানে সমস্যাটা ছিল উত্তরপত্রের কোডিং। কম্পিউটার আর ওএমআর প্রযুক্তি এসেছে সমাধান হিসাবে। এই কারণে এই প্রকল্পের নাম ছিল – এসএসসি ও এইচএসসসি পরীক্ষার উত্তরপত্র কোডভুক্তকরণ এবং ফলাফল প্রক্রিয়া কম্পিউটারায়ন।
এই প্রকল্পে আরো অনেক উদ্ভাবন হয়েছে তবে সেটি অন্য প্রসঙ্গ এবং একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আমি কেবল মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে শুকরিয়া আদায় করি যে, এমন একটা কাজের সঙ্গে তিনি আমাকে যুক্ত রেখেছিলেন।
রচনামূলক খাতার সমাধানের উদ্ভাবনটা আজকের উপজীব্য। বাকীগুলো অন্য কোন সময়, অন্য কোন খানে বলা যাবে।
সবার জীবন পাই-এর মত সুন্দর হোক।
শুভ সকাল।
2 Replies to “উদ্ভাবনের কল-কব্জা-৪ : গোল্লাপূরণের পরীক্ষা”