বিদেশি সফটওয়্যারপ্রীতি!

Spread the love

কখনো কখনো কোনো ভালো অনুষ্ঠানে গেলেও গেলেও সেখান থেকে মন খারাপ করে ফিরতে হয়। কদিন আগে এমনই এক অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। সোনারগাঁ হোটেলের সেমিনার কক্ষে চমৎকার এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দেশীয় তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডেটাসফট। এই প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে দেশ ও দেশের বাইরে প্রভূত সুনাম অর্জন করেছে। আলোচ্য অনুষ্ঠানে তারা আমাদের সবাইকে জানান যে এবার তারা জাপানেও কাজ করবে। জাপান জ্ঞান-বিজ্ঞানে খুবই উন্নত। সারা বিশ্বের লোকেরা যে সমস্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করে তার অনেকগুলোর উৎপত্তি, বিকাশ এবং বিপণন হয়েছে জাপান থেকে। জাপানী ইলেকট্রনিক্স পণ্য ছাড়া কোন বাসাবাড়ি চিন্তাও করা যায় না। অটোমেশনের বেলায় জাপান অনেক এগিয়ে। সেই জাপানী বাসাবাড়িকে চৌকস করার কাজটি করবে একটি বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান। ব্যাপারটি যে কতো গৌরবের ও গর্বের তা লিখে বোঝানো আসলেই কঠিন।

অনুষ্ঠানে জানানো হলো জাপানের টোকিও শহরের ১০ হাজার এপার্টমেন্টকে চৌকস করার দায়িত্ব নিয়েছে এ ডেটাসফট। সেখানকার টয়লেটগুলো তাৎক্ষণিকভাবে মলমূত্র পরীক্ষা করে বলতে পারবে গতকাল ঠিক মতো পানি পান করা হয়েছে কীনা, আঁশযুক্ত খাবার যথেষ্ঠ ছিল কিনা। শুধ তাই নয় এই সংক্রান্ত তথ্য টয়লেটটি পাঠিয়ে দেবে নানান জায়গায় যার একটি ঘরের রেফ্রিজারেটর। রেফ্রিজারেটরটি দেখবে সেই অনুযায়ী খাদ্য ফ্রিজে আছে কী না।

না থাকলে জানিয়ে দেবে কাছের সুপার স্টোরে আর সেখান থেকে প্রয়োজনীয় খাবার এসে পড়বে বাড়িতে। মেনর ভুর দরজা না লাগিয়ে চলে গেরে জাপানী বাড়ির মালিক তার মুঠোফোন দিয়েই দরজা বন্ধ করে দিতে পারবে। বৃষ্টি এস পড়লে বাবান্দার কাপড় ভিতরে নিয়ে আসা যাবে! শুনতে আজগুবী মনে হলেও এমনটিই ঘটবে আগামী কিছুদিনের মধ্যে আর তা সম্ভব হবে ‘ইন্টারনেট অব থিংস’-এর মাধ্যমে। এই প্রযুক্তি-কৌশলের মাধ্যমে কম্পিউটার প্রোগ্রামিঙ সংকেত নিয়ন্ত্রত ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী যুক্ত থাকবে ইন্টারনেটে। ফলে ইন্টারনেটের সকল সুযোগ সুবিধাই বিস্তৃত হবে যন্ত্রপাতিতে!

আর আগামীদিনে জাপানীদের এমন স্বপ্নপূরণে কাজ করবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান। এটি ভাবার কোন কোনো কারণ নেই যে ডেটাসফট জাপানি মামা-খালাদের কারণে এই কাজটি পেয়েছে।  নিজেদের প্রমাণ করে, দক্ষতা দেখিয়ে, কাজের পারফর্ম্যান্সের প্রমাণ দিয়ে তবেই ডেটাসফট এই কাজটি পেয়েছে। সেদিনের সেই অনুষ্ঠানে জাপানী ক্রেতাদের পক্ষে দুইজন বক্তব্য দিয়েছেন। তারাই বলেছেন কেন তারা ডেটাসফটকে বেঁছে নিয়েছন।

এই সেই বিজ্ঞপ্তি

অনুষ্ঠানে তাকতে থাকতে আমার মনে পড়েছে ক’দিন আগে সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি দরপত্র বিজ্ঞপ্তি। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সরকারের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের পাওয়ার সেল। বিজ্ঞপ্তিটিতে একটি ইআরপি (এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং) সফটওয়্যার কেনার দরপত্র। এইআরপি হলো প্রতিষ্ঠানজুড়ে সকল সম্প্দ ও কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও তদারকীর একটি সফটওয়্যার। বর্তমানে দেশের শতাধিক প্রতিষ্ঠান এমন সফটওয়্যার ব্যবহার করে। দরপত্রটির যে অংশ আমাকে ঐ অনুষ্ঠানটি থেকে মন খারাপ করে তুলে এনেছে তা হলো দরপত্রে কাঙ্খিত প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা। আশ্চর্য হলেও সত্য পাওয়ার সেলের এই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে এই কাজটি তারাই করতে পারবে যারা গাত দশ বছর বছরে কমপক্ষে আশি হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করেছে!!! না, আপনি ঠিকই পড়েছেনে। এটি ১০ বিলিয়ন ডলারই। শুধু তাই নয় ঐ প্রতিষ্ঠানের তরল সম্পদ (লিকুইড এসেট) থাকতে হবে আট হাজার কোটি টাকার (এক বিলিয়ন ডলার)! বলাবাহুল্য, এমন যোগ্যতা দেশের কোন সফটওয়্যার কোম্পানিরতো নেই, এমনকি অন্যান্য অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানেরও নেই। বোঝাই যাচ্ছে পাওয়ারসেলের কর্তাব্যক্তিরা বিদেশী কোন প্রতিষ্ঠানের জন্যই এই দরপত্র বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশ করেছেন।

বটে, যে দেশের প্রতিষ্ঠান জাপানের মতো দেশের জন্য অত্যাধুনিক বাসাবাড়ি বিনির্মাণ করতে পারে সে দেশের একটি সামান্য ইআরপি সফটওয়্যার তৈরির যোগ্যতা রাখে কেবল বিশ্বের একেবারেই প্রথমসারির কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। দেশীয় সফটওয়্যার কোম্পানিগুলো, যাদের হাত ধরে নির্মিত হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশের মহাকাব্য, তারা থাকবে সেখানে অপাক্তেয় হয়ে!!! দরপত্র বিজ্ঞপ্তি পড়লেই বোঝা যায় যে দেশীয় সফটওয়্যার সংস্থাসমূহকে কতো প্রবলভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছে!

ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে মহাযজ্ঞ বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে শুরু করেছে তারই ধারাবাহিকতায় দেশে অনেকগুলো প্রযোজনীয় ডিজিটালাইজেশনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে, অনেকগুলো হচ্ছে এবং অনেকগুলো বাকী আছে। সেই কার্যক্রমগুলোই সাফল্যের ছোঁয়া দেশবাসী পেয়েছে যেগুলোর পরিকল্পনা, বাস্তবায়নে দেশের তরুনরাই কাজ করেছে। মুঠোফোনে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম, জমির পর্চা ইন্টারনেটে মালিকের কাজে পৌছে দেওয়া, লক্ষাধিক হাজীর ব্যবস্থাপনা বা চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের অটোমেশনের সফল কাজগুলো আমাদের তরুনরাই সম্পন্ন করেছে। দেশে যে অজস্র প্রতিষ্ঠানে ইআরপি বাস্তবায়িত হয়েছে সেগুলোর পেছনেও আমাদের তরুনরাই সক্রিয়। এমন এক সময়ে এই বিজ্ঞপ্তিটি কিসের আলামত?

ডিজিটাল বাংলাদেশের চারটি স্তম্ভের একটি হল দেশিয় তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বিকাশ। আগামীতে এই খাতে ৫০০ কোটি ডলারের রপ্তানী লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। জানা কথা বিদেশীরা আমাদের তখনই কাজ দেবে যখন তারা দেখবে আমাদের তরুনরা দেশীয় কাজগুলো করছে, সফল হয়েছে। তৈরি পোষাক আর ঔষধ শিল্পেও আমরা এই প্রবণতাটি দেখেছি। একইভাবে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প বিকশিত হবে যদি আমাদের তথ্যপ্রযুক্তিবিদরা নিজ দেশে কাজের সুযোগ পায়। এতে কেবল প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়বে তা নয়। দেশের ৯০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর যে ১০ হাজার তথ্যপ্রযুক্তি স্নাতক পাস করে বের হয়ে আসছেন তারাও পাবেন তাদের জ্ঞান-দক্ষতা প্রকাশের সুযোগ।

ডিজিটাল বাংলাদেশের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকেই দেশে একটি বিশেষ গোষ্ঠী সার্বক্ষনিকভাবে আমাদের তরুনদের সক্ষমতা নেই, তারা পারবে না ইত্যাদি ধুযা তুলে বিদেশি সফটওয়্যার কোম্পানিকে দেশীয় কাজ দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং প্রায়শ সফল হচ্ছে। আর বিদেশি কোম্পানিগুলো যেসকল সফটওয়্যার তৈরি করছেন সেগুলোর কোন কোনটি এমনিকি বাংলাভাষাতে কাজই করতে পারে না!

জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে নিজেদের সমৃদ্ধ ও অবস্থান জোরদার করার যে সরকারি-বেসরকারি মহাযজ্ঞ বর্তমানে চলছে পাওয়ার সেলের ১২ সেপ্টেম্বরের দরপত্র বিজ্ঞপ্তিটি তার ওপর একটি চপেটাঘাত। দেশের তরুন তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের অবজ্ঞা করার অপচেষ্ঠা। দেশীয় সফটওয়্যার শিল্পের বিরুদ্ধে একটি গভীর ষড়যন্ত্র। এখনো সময় আছে, ঐ দরপত্র বিজ্ঞপ্তিটি বাতিল করে এই কাজ দেশী সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানগুলোকে করার সুযোগ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার।

 

(২৩ সেপ্টেম্বর দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত)

Leave a Reply