পড়ো পড়ো পড়ো : একাত্তরের স্মৃতি – বাসন্তী গুহ ঠাকুরতা
লিখেছেন টুকুনজিল নায়ীরা
উৎসর্গ পত্রে লেখা আছে, “শহীদ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা
যিনি একাত্তেরে পঁচিশে মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আমাকে বলেছিলেন স্বাধীনতার ইতিহাস লিখতে
আজ তাঁর ও মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদের স্মরণে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে তুলে দিলাম”
একজন মানুষ দেশকে ঠিক কতটা ভালবাসলে আর কতটা স্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী হলে নিজে গুলিবিদ্ধ হয়েও স্ত্রীকে স্বাধীনতার ইতিহাস লিখে যেতে বলেন??
সেদিন কাল রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৪ নম্বর জগন্নাথ হল কক্ষের সামনে অধ্যাপক মনিরুজ্জামান আর ডঃ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে পাশাপাশি রেখে গুলি করা হয়েছিল। ডঃ জামান মিনিট দশেকের মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। গুহঠাকুরতা তখনও বেঁচে ছিলেন। মিসেস মনিরুজ্জামান বাসন্তী গুহঠাকুরতাকে ডেকে বলেন, “দিদি দরজা খুলুন। আমার সাহেব মারা গেছেন। আপনার সাহেব এখনও বেঁচে আছেন, তাঁকে ভিতরে নিয়ে যান!”
জ্যোতির্ময় ঠাকুর মারা গেছেন আরও পাঁচ দিন পর, ৩০শে মার্চ সকাল নয়টায় ঢাকা মেডিক্যালের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ২ নম্বর বেডে শুয়ে।
দাহ করার জন্য অধ্যাপকের লাশও লেখিকা ফেরত পাননি। পাননি কোনো ডেথ সার্টিফিকেট। (পরবর্তী সময়ে মিথ্যে একটা সার্টিফিকেট তাকে দেয়া হয় যেখানে মৃত্যুর কারণ হিসেবে নিউমোনিয়া উল্লেখ করা হয়েছে।) প্রিয়জনের মৃতদেহ হসপিটালে ফেলে রেখে মেয়ে মেঘনাকে নিয়ে যাযাবরের মত অনিশ্চিত দিন পার করেছেন বাসন্তী গুহঠাকুরতা। এর মধ্যেই প্রাণ হাতে নিয়ে নানা কাজে ছুটাছুটি করতে হয়েছে। ব্যাংক, বীমার কাগজপত্রের কাজ গুছানো, জ্যোতির্ময় ঠাকুরের নামে ইস্যু করা বই জমা দেয়া, লোন পরিশোধ করা.. যুদ্ধকালীন সময়ে অফিস আদালতের কোনো কাজই থেমে ছিলনা!
এরমধ্যে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার কথা বলে। রাস্তায় রাস্তায় চেকপোস্ট, একটু এদিক সেদিক হলেই নিশ্চিত মৃত্যু! এভাবে ক্লাস করা যায়?! ততদিনে যুদ্ধ পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। অনেকেরই প্রিয়জন মারা গেছে। চারিদিকে লাশের স্তুপ আর রক্তের বন্যা। পাকিস্তান সরকার বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে দেশে কিছু হয়নি। ছয়জন শিক্ষাবিদকে সরকারের পক্ষে সাফাই গাইবার জন্য দেশ বিদেশে পাঠানো হয়েছিল। কি আশ্চর্য! শিক্ষাঙ্গন বিনষ্ট করে যারা ছাত্র শিক্ষক হত্যা করেছে তাদের দোসর হয়ে মিথ্যে প্রচার করার জন্য মেধাবী মানুষেরও অভাব হয়নি! অশিক্ষিত রাজাকারদের আর কি দোষ দিব!
যুদ্ধের নয় মাসে যেসব ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তা উল্লেখ করতে গিয়ে লেখিকা বলেছেন, যারা মারা গেছে তারা এক প্রকার বেঁচে গেছে! তবুও কেন যেন লেখিকার বর্ণনায় উঠে আসা যুদ্ধের ভয়াবহতা আর পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারের নির্মমতা স্পর্শ করতে পারেনি। (আনোয়ার পাশার লেখা “রাইফেল, রোটি, আওরাত” পড়লে শিউরে উঠতে হয়!) বীরাঙ্গনাদের নিপীড়নের কোনো স্পষ্ট ছবি নেই। শেষ দিকে আয়ারল্যান্ডের সংগঠন CONCERN আর মাদার টেরেসার হোমের কথা উল্লেখ করেছেন যারা নির্যাতিতা মেয়েদের আর যুদ্ধশিশুদের আশ্রয় দিয়েছে।
৭১ এর ১৪ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে গভীরতম আফসোসের একটা দিন। লেখিকার লেখা পড়তে গিয়ে আফসোসটা আরো বাড়ল। ডঃ শহীদুল্লাহ, ডাঃ ফজলে রাব্বি, ডাঃ আলীম চৌধুরী, সন্তোষ ভট্টাচার্য, আনোয়ার পাশা, ডঃ সিরাজুল হক খান, গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, ডাঃ মূর্তজা -এই মানুষগুলো বেঁচে থাকলে দেশটা আরও পঞ্চাশ বছর এগিয়ে যেতো না?! রায়েরবাজার বধ্যভূমি, মিরপুরের শিয়ালবাড়ি বধ্যভূমিতে উৎভ্রান্তের মতো স্বজনহারা মানুষেরা প্রিয়জনের লাশ খুঁজে বেড়িয়েছে। যুদ্ধ শেষ হয়েছে, তবুও যেন শান্তি নেই কোথাও!
ইউপিএল প্রকশনী একটি ধন্যবাদের দাবীদার। ওদের থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক অসাধারণ কিছু বই ছাপা হয়েছে। “একাত্তরের স্মৃতি” তেমন একটি বই, মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য দলিল।
বাসন্তী গুহঠাকুরতার বিরুদ্ধে আমার ছোট্ট একটা অভিযোগ আছে। তিনি এই বইটি টানা লিখে গেছেন। একটানা লেখা পড়তে একটু কষ্ট হয়। ছোটছোট অধ্যায়ে ভাগ করে লিখলে পড়তে আরাম লাগতো।