জ্যামিতি শিখে কী লাভ?
ঘটনা শুরু ইউক্লিডের আমল থেকে। জ্যামিতির ব্যাপারগুলো সুবিন্যস্ত করার পর ইউক্লিড শিষ্যদের পড়ানো শুরু করলেন। অচিরে ব্যাপারটা বেশ ডালপালা গজিয়ে ফেললো। মূল কারণ হলো যুক্তির সৌধ।
আমাদের দেশে আমরা যেভাবে জ্যামিতি পড়ি তাতে যুক্তির সৌধটা আমরা বুজতে পারি না। অনেক সময় জ্যামিতির চেয়ে জ্যামিতিক চিত্রই এখানে মুখ্য হয়ে পড়ে। আমার মনে আছে এসএসসি পরীক্ষার সময় জ্যামিতির উপপাদ্যের ছবি কীভাবে ঠিকমতো আঁকতে হবে সেটা স্যার ভালমতো বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যেন চিত্রের জন্য নম্বর কাটা না যায়। বলেছিলেন চিত্র যেন বাঁ দিকের পাতায় আঁকি। তাহল এসমাধান ডানের পাতায় লিখলেও যেন স্যার সেটা দেখতে পারেন।
তো, ইউক্লিডের সময় ব্যাপারটা যখন অনেক বাজার পেয়ে যায় তখন রাজদরবারের লোকেরাও ভাবলো জ্যামিতি না শিখলে তো মান উজ্জত থাকছে না। কোন ভিড্যু করা যাচ্ছে না। কিন্তু এতো সময় কোথায়? তখন তাদের একজন প্রতিনিধি এসে হাজির হয় ইউক্লিডের কাছে। জানতে চায় – জ্যামিতি শেখার কোন রাজকীয় পথ আছে কী না? মানে শর্টকার্ট।
ইউক্লিড তখন বলেছিলন – (জ্যামিতি ) শেখার কোন রাজকীয় পথ নেই।
তার কিছুদিন পরে আর একজন লোক এসে ইউক্লিডকে প্রশ্ন করে, “ আচ্ছা, জ্যামিতি শিখে আমার কী লাভ হবে?”
লোকটির দিকে তাকিয়ে ইউক্লিড তার বাড়ির চাকরকে ডেকে বলেন, “ওনাকে একটা মুদ্রা দিয়ে দাও। ও যা শেখে সব থেকেই লাভ পেতে চায়?”
জ্যামিতির প্রথম পাঠ নামে একটা বই-এর পরিকল্পনা করতে বসেছি। এসব কথা মনে পড়ছে। সেই সঙ্গে মনে হচ্ছে ঐ দুটো লোককে আমি চিনি কী না। তারপর আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম ঐ দুই লোকের উত্তরসুরীরা আমার চারপাশে ব্যাপক সংখ্যায় আছে। এদের একদল যে কোন কিছুতে শর্টকার্ট খোঁজে। এই যেমন কোন অনুষ্ঠান হলে লেখে , “ভাই, অনুষ্ঠানটা লাইভ করেন। তাহলে আমরা যারা যেতে পারছি না তারা শিখতে পারতাম”। যেন লাইভ করলেই সে শিখে ফেলবে। লাইভের জন্যই তার শেখাটা আটকে আছে!!! বটে।
সেরকম একজনকে একদিন খুব করে ধরলাম।
“আরে, তোমার কথা তো অনেক শুনেছি। তোমার কাছে নাকি লিন্ডাও এর অনেক ভিডিও টিউটোরিয়াল আছে”।
জি, আছে স্যার। আপনার লাগবে?
তো কী কী আছে। তারপর যা যা আছে বললো তাতে বুঝলাম তার কাছে না হলেও কয়েক টেরাবাইট ভিডিও ডাউনলোড করা আছে। দুইটা আলাদা পোর্টেবল হার্ড ড্রাইভ আছে। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে, ডাউনলোড করে সে এই ভিডিও সংগ্রহশালা তৈরি করেছে। আমি হিসাব করে দেখলাম সে যদি প্রতিদিন ঘন্টাখানেক করেও দেখে তাহলে আগামী ৫ বছরেও তার এই স্টক ফুরাবে না। তারপর সেই প্রশ্ন করলাম- এর মধ্যে কোনগুলো সিরিয়াসলি দেখেছো?
না। কোনটাই তার ঠিকমতো দেখা হয়নি।
রবীন্দ্রনাথের ভাষাতে
“আমারই ভিডিও ডাউনলোডেই আনন্দ। ভরে যায় হার্ডডিস্ক, বর্ষা আসে, বসন্ত আমারই ভিডিও ডাউনলোডেই আনন্দ।”
শিখতে না চাওয়ার এই সব মানুষদের পূর্বপুরষ নিশ্চয়ই ঐ মিশরীয় রাজপুরুষ। এদের সংখ্যা নেহায়েৎ কম নয়। এরা প্রায় সব সেমিনার, সিম্পোজিয়ামেও হাজির হয়। সব লিফলটে যত্ন করে যোগাড় করে। তারপর কিছুই করে না!!!
এরা বেশি অবশ্য হার্মফুল নয়।
দ্বিতীয় দলটা ডেনজারাস। এরা পাবলিক অনুষ্ঠানে আমাকে প্রশ্ন করে, “ এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার আমাদের জীবনে কী কাজে লাগে? এটা জেনে কী লাভ?”
এদেরকে কেমন করে আপনি বোঝাবেন যে, তাৎক্ষনিক লাভ দিয়ে শিক্ষার কোন হিসাব নিকাশ করা যায় না। এ প্লাস বি হোল স্কোয়ারের মতো ব্যাপারগুলো না থাকলে যে যমুনা ব্রিজ বানানোই যেতো না সেটা তাদেরকে কেমনে বোঝানো যাবে?
আমরা যতো বিষয় স্কুল-কলেজে পড়ি তার সবটাই সরাসরি কাজে লাগে না। একটা অংশ থাকেই আরও পরের পড়ালেখার জন্য। যেমন বীজগণিত কিংবা জ্যামিতি। প্রকৌশল বিদ্যায় এগুলোর ডিরেক্ট প্রয়োগ হয়। এর সঙ্গে দর্শন যোগ করলে যা হয় সেটা হয়ে ওঠে অসাধারণ। আর যদি প্রকৃতিকে এসবের সঙ্গে জুড়ে দিতে পারেন তাহলে আপনি হয়ে উঠবেন এফ আর খান কিংবা লুই আই কান।
সংসদ ভবনের পাশ দিয়ে কিংবা গণভবন সংলগ্ন কোয়ার্টারগুলো অতিক্রম করার সময় বোঝা যায় একটা ঝড়ো হাওয়া আর আলো-বাতাসের দেশের বাড়িঘরগুলো কেমন হওয়া উচিৎ। কেমন করে সেখানে আলো-বাতাস এমনভাবে খেলবে যে, তাতে আলাদা করে এসি লাগাতে হবে না।
কিন্ত যখন শিক্ষা থেকে দর্শন আর প্রকৃতি হাওয়া হয়ে যায় তখন বাংলাদেশেও লোকে বিল্ডিং-এর চারপাশে কাঁচের পর কাঁচ লাগিয়ে সেগুলোকে গ্রীন হাউসে পরিণত করে। ঠিকমতো বাতাস চলাচলের রাস্তা করতে পারলে, এই ঢাকা শহরের অর্ধেক বাড়িরই কোন এসি লাগার কথা না। কিন্ত যে নকশাবিদরা বাড়ির দক্ষিণ দিকে দুই দুইটা টয়লেট দিয়ে রাখে তাদের সঙ্গে আলাপ করেই বা কী লাভ?
আর এভাবে এসির চাহিদা আর খরচ বাড়ে।
এতে এসি ওয়ালার লাভ। আর এভাবেই দ্বিতীয় দলের লোকেরা শিক্ষা থেকে তাদের লাভের ব্যবসাটাও করে ফেলে।
মাঝখান দিয়ে মরে জনগণ।