করো করো করো -১
১৯৯২ সালের জুন মাসের ২৭ তারিখ, সন্ধ্যা বেলা।
চাকরি খোঁজার পেছনে আরও একটি দিন গেল। তেমন কোন আশার বানী শোনা হয়নি। টিএসসিতে গাল-গপ্প করে বুয়েটের নজরুল ইসলাম হলের দিকে ফিরছি। সিভিল আর ইএমই বিল্ডিং-এর মাঝামাঝি আসতেই শুনতে পেলাম, কে জানি ডাকছে।
‘মুনির”।
তাকিয়ে দেখি গাড়ি থেকে নামছেন ড. মুজিবুর রহমান স্যার। স্যার গাড়িটা রেখেছেন সিভিল বিল্ডিং-এর সামনে। কী জন্য ডাকে দেখি।
“চলো। আমার সঙ্গে”।
স্যারের সঙ্গে গেলাম সিভিল বিল্ডিং-এর পাঁচতলায়। স্যার এখন বুয়েট কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালক। স্যারের সঙ্গেই সিস্টেম এনালিস্ট হিসাবে আরও আছেন লুৎফুল কবীর স্যার।
এই সেন্টারে আমার অনেক সময় কেটেছে ফোর্থ ইয়ারে। কারণ থিসিসের জন্য একটা কয়েক হাজার লাইনের প্রোগ্রাম লিখতে হয়েছিল। আমার দুই পার্টনার আযম আর কে জানি জীবনে কোনদিন সেন্টারে আসে নাই। যা করার আমারই করা লাগতো। আর ছিল মোহাম্মদউল্লাহ। দ্যা জিনিয়াস।
সেই আমার প্রোগ্রামের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়েছিল। সে যাকগে। জামিলুর রেজা স্যার এই সেন্টারের পরিচালক থাকতে কয়েকবার তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। কাজে আমি ভাবলাম মুজিবুর রহমান স্যার আমাকে পরিচালকের রুমে নিয়ে যাবেন। কিন্তু তিনি সেখানে গেলেন না। আমাকে সঙ্গে করে স্যার ঢুকলেন পরিচালকের পাশের কক্ষে। ঐটা কনফারেন্স কক্ষ, জানি।
কিন্তু ভিতরে ঢুকে চমকে গেলাম। দেখলাম স্যার আসলে কনফারেন্স রুমটাকেই এখন অফিস বানিয়েছেন। বড়ো টেবিলটার বিভিন্ন জায়গা দেখে বোঝা গেল টিমের সবাই এই রুমেই বসেন। স্যার নিজের চেয়ারে বসলেন। আমাকে বসতে বলে বেল বাজালেন।
কে জানি আসলো খেয়াল করিনি। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন – চা খাবা তো। তারপর যে আসলো তাকে বললেন, ‘মুনিরের জন্য চা নিয়ে আসো।”
মুজিবুর রহমান স্যার হলেন আমাদের সে কয়জন স্যারের অন্যতম যাদেরকে আমরা ভয় পেতাম না। স্যার আমাদের ফুরিয়ার ট্রান্সফর্ম পড়াতেন ফোর্থ ইয়ারে। ফুরিয়ার ট্রান্সফর্ম আমি তখনও বুঝতাম না, এখনও বুঝি না। কাজে ক্লাসের স্মৃতি বেশি মনে নেই।
যারা পড়ো পড়ো পড়ো পড়েছে তারা জানে আমি তেমন একটা ক্লাসও করতাম না। কাজে ক্লাস করার কারণে কোন স্যারের সঙ্গে আমার খাতির হয় নাই। তবে, মুজিবুর রহমান স্যার আর লুৎফুল কবীর স্যারের সঙ্গে আমার একটা কাজ করার সুযোগ হয়েছে শেষ সময়ে।
আমাদের ফোর্থ ইয়ারের সময় ইইই বিভাগ একটি ইলেকট্রিক্যাল ডে করার সিদ্ধান্ত নেয়। সব বড় পন্ডিতরা সব কাজ করে ফেলেছে। সে সময় একদিন সকালে রুমে ঘুমাচ্ছি দেখি কয়েকজন আমাকে ডাকাডাকি করে। দেখলাম আশিকুর রহমান বিজয়, আর জানি কে কে। বললাম – কী বিষয়। বলে, “আজ তোমারে স্যাররা পাইছে। এতক্ষণ ঘুমাও। ডীন স্যার ডাকছে”।
খাইছে। আমি কী অপরাধ করলাম। আমাকে ডাকে কেনু?
উঠে রেডি হয়ে নাস্তা না করে বিজয়ের সঙ্গে রওনা দিলাম। যেতে যেতে শুনলাম ইলেকট্রিক্যাল ডে’র সব কাজ হলেও স্যুভেনিরের প্যাচ লেগে গেছে। আর মাত্র ৭ দিন আছে। যেখান থেকে আগে স্যুভেনির করার কথা হয়েছিল তারা এই বাজেটে করতে পারবে না। কাজে বিজয়রা মনে করছে এখন এটা আমাকেই করতে হবে।
গেলাম স্যারের রুমে। স্যার বললেন, “ তুমি পারবা তো?”
ম্যাটার রেডি কিনা জানি না, কন্টেন্টের খবর জানি না। আমি বিজয়ের কথামতো বলে দিলাম – জি স্যার। পারবো।
তারপর স্যারের রুম থেকে লুৎফুল কবীর স্যারের রুমে। স্যার তখন সদ্য পিএইচডি করে ফিরেছেন। আমাদের ক্লাস নেন না। কিন্তু বি-সেকশনে নেন। আমাদের সেকশনে সে ক্লাসটা নেন হামিদুর রহমান স্যার। হামিদুর রহমান স্যারের ক্লাসটা ছিল আমা্র খুব প্রিয়। একটা হলো স্যার কোন বই থেকে পড়াতেন না। আর দ্বিতীয় হলো যা কিছু ইনি পড়াতেন তার প্রায় সবকিছুই উনি নিজের জীবনে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। ফলে তার ক্লাসের বড় অংশ জুড়ে থাকতো স্যারের অভিজ্ঞতার গল্প। তখনই আমরা জেনে গিয়েছিলাম সে সময় পিডিবির নেটওয়ার্কের খুঁটিনাটি সবকিছুই স্যারের একেবারে ‘মুখস্ত’। (পরে যখন আমি বিভিন্ন জায়গায় পড়ানোর সুযোগ পেয়েছি তখন হামিদুর রহমান স্যার আর লুৎফুল কবীর স্যার হলেন আমার আদর্শ। সে অন্য গল্প)
লুৎফুল কবীর স্যার আমার সঙ্গে কয়েকটা কথা বললেন। তারপর যে কাজের বর্ণণা দিলেন তাতে আমি বুঝলাম জীবনে মস্তোবড় একটা ভুল করে ফেলেছি। এই কাজ আমারে দিয়ে হবে না। একটা মোটামুটি ৮০ পাতার স্যুভেনির বের করতে হবে। যার কোন ম্যাটারই এখনো হাতে আসে নাই। যদিও স্যারের স্থির বিশ্বাস সেগুলো ‘কালকের’ মধ্যে পাওয়া যাবে। আর বেশিরভাগ লেখা হবে হাতে লেখা। কিছু থাকবে কম্পোজ করা। তবে, সেগুলো হতে পারে ওয়ার্ড স্টারে। মানে ওগুলোরে ম্যাকে নেওয়ার কোন বুদ্ধি নাই। মানে দাড়ালো সব কম্পোজ করাতে হবে। দুইবার করে প্রূফ দেখাতে হবে এবং ৭ দিন পর সকালে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কমপক্ষে ২০০ কপি হাজির করতে হবে!!! এর বড় কারণ হলো অনুষ্ঠানের খরচের টাকা তোলা হয়েছে স্যুভেনিরের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। স্যুভেনির বের না হরে তো টাকা পাওয়া যাবে না। (তখন কিন্তু টাইটেল স্পন্সর, গোল্প স্পন্সর এসবের বালাই ছিল না। স্পন্সরশিপ মানেই বিজ্ঞাপন)।
আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। বুঝলাম চার ইয়ারে ফালতু কাজ পারি বলে সে সুনামটা হয়েছে সেটা আর থাকবে না।
কনফারেন্স রুমে বড় টেবিলটার কোনার দিকে মুজিবুর রহমান স্যারের বাম হাতে বসে আমার এই কথাগুলো মনে পড়ছিল।
ঠিক তখনই স্যার আমার কাছে জানতে চাইলেন, “গ্যারিসন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ভাইভাতে ডাক পাওনি?”
One Reply to “করো করো করো -১”