ডিজিটাল অর্থনীতির বাজেট চাই
আমার বাসা ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে। হলুদ ট্যাক্সি ক্যাবে বিমানবন্দর থেকে বাসায় ফিরতে মিটারে ভাড়া উঠেছে ১ হাজার ২৫০ টাকা। ট্যাক্সিচালক দাবি করেন ১ হাজার ৫০০ টাকা। এখন আমি আসা-যাওয়ার সময় উবারের রাইড শেয়ারিং সেবা নিই। এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ভাড়া দিয়েছি ৪০০ টাকা! এ বিচ্যুতি কীভাবে সম্ভব?
এ হলো ডিজিটাল উৎপাতের শক্তি—ডিজিটাল ডিসরাপশন। ২০০ বা তার চেয়ে বেশি বছর ধরে সভ্যতা কোটি কোটি পণ্য বা সেবা উৎপাদন করে তা ভোক্তার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি জটিল সরবরাহ-বিতরণব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। যেমন ট্যাক্সি সার্ভিস। এ ব্যবস্থার মধ্যেও এমন সব গাড়ির মালিকের সৃষ্টি হয়েছে, যাঁদের গাড়িটি অনেক সময় অব্যবহৃত থাকে। এত দিন পর্যন্ত আমার মতো যাদের কদাচিৎ বাহনসেবার প্রয়োজন হয়, তাদের সঙ্গে এই গাড়ির মালিকদের যোগাযোগের কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু ইন্টারনেট আর বিশেষ করে স্মার্টফোনের উদ্ভাবন আমার আর গাড়ির মালিকের মধ্যকার ব্যবধানটা ঘুচিয়ে দিয়েছে। তরুণ মেধাবী কম্পিউটার প্রোগ্রামাররা এমন অ্যাপলিকেশন বানিয়ে দিয়েছেন যে আমাকে বিমানবন্দরের বাইরে এসে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে হলুদ ছাদের গাড়ি খুঁজতে হচ্ছে না। তার আগেই আমি নিকটতম উবার চালকের খোঁজ আর তাঁর গাড়িতে বাড়ি পৌঁছানোর খরচ জেনে যাচ্ছি! শুধু ট্যাক্সি ক্যাব নয়, আমি ইচ্ছে করলে ‘পাঠাও’ নামের একটি দেশীয় সেবায় মোটরসাইকেলের পেছনে বসে বাড়ি চলে আসতে পারি। আর এভাবে উবার, পাঠাওয়ের পিঠে চড়ে বিশ্বব্যাপী বিকশিত হচ্ছে ডিজিটাল অর্থনীতি।
ব্যাপারটা অনেকেই লক্ষ করেছেন। তবে এর সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য বর্ণনা দিয়েছেন হাভাস মিডিয়ার কৌশল ও উদ্ভাবনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট টম গুডউইন। তিনি লিখেছেন, ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় ট্যাক্সি কোম্পানি উবারের নিজের কোনো বাহন নেই। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় মিডিয়া ফেসবুক কোনো কনটেন্ট নিজে তৈরি করে না। সবচেয়ে মূল্যবান বিক্রেতা আলিবাবার কোনো নিজস্ব মজুত নেই। বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ আবাসস্থলের জোগানদার এয়ার বিএনবির নিজের কোনো রিয়েল এস্টেট নেই। চিত্তাকর্ষক একটা কিছু ঘটছে চারপাশে।’
এর ফলাফলও লক্ষণীয়। বিপাকে পড়েছে প্রচলিত কোম্পানিগুলো। এমনকি বিজ্ঞাপনের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে ফেসবুক আর গুগলে, যারা কোনো কনটেন্ট কোম্পানি নয়। এর কারণ হলো ইন্টারনেট, আইসিটি আর স্মার্টফোন মিলে এমন একটা নতুন ইকো-সিস্টেম গড়ে তুলছে, যার মাধ্যমে ভোক্তা সরাসরি জোগানদার বা উৎপাদকের সঙ্গে যুক্ত হতে পারছে।
ইন্টারনেটের প্রভাব কিন্তু কেবল বাহনসেবা বা ছুটির আবাসনে সীমাবদ্ধ নেই। ২০১৬ সালের শেষ তিন মাসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ই-কমার্স স্টোর আমাজনের বিক্রি বড় বড় সুপারস্টোর চেইনকে ছাড়িয়ে গেছে। বাসায় বসে কেনাকাটা করার সুবিধার ফলে শুধু যে ক্রেতারই উপকার হচ্ছে, তা-ই নয়; হাজার হাজার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ফেসবুকে নিজের পাতা খুলে ভোক্তার কাছে পণ্য পৌঁছে দিচ্ছেন। দেশে এমন ফেসবুকভিত্তিক উদ্যোক্তার সংখ্যা অচিরেই পাঁচ অঙ্কে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্যদিকে এ ধরনের উদ্যোগ প্রচলিত ব্যবসার প্রসারেও নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দেশে অনলাইনে বই বিক্রির প্রতিষ্ঠান রকমারি ডটকমের মাধ্যমে সারা দেশে বই বিপণনের ফলে এখন বই বিক্রি কিছুটা হলেও বেড়েছে।
ইন্টারনেট এবং হালের ইন্টারনেট অব থিংসের কারণে এমন সব যন্ত্র আবিষ্কৃত হচ্ছে বা হবে, যা কিনা আমাদের মতো দেশ থেকে হার্ডওয়্যার রপ্তানির সুযোগ তৈরি করে দেবে। কদিন আগে এক প্রাক-বাজেট আলোচনায় তেমনি একটি বিষয় তুলে ধরেন ৩২ বছর নাসায় চাকরি করে দেশে ফিরে আসা এক প্রকৌশলী। তিনি একটি হাতের মুঠোর সমান যন্ত্র দেখিয়ে বলেন, যন্ত্রটি সৌদি আরবের মতো দেশে যেখানে পাইপে পানির সরবরাহব্যবস্থা নেই, সেখানে একটা নতুন যুগের সূচনা করবে। নিজের ডিজাইন করা ওই যন্ত্রের একটা নমুনা তিনি চীন থেকে বানিয়ে এনে ঢাকায় তাঁর প্রোগ্রামিং অংশটি যুক্ত করেছেন। কিন্তু সে নমুনাটি এখন সৌদি আরবে পাঠাতে পারছেন না। কারণ, এ জন্য যেসব কাগজপত্র দাবি করা হয়েছে, সেগুলো জোগাড় করে ওই নমুনা রপ্তানি করতে হলে তিনি আর ১০ হাজার যন্ত্রের অর্ডার পাবেন না। বিপাকে পড়ে এখন তিনি ওমরাহ করার জন্য সৌদি আরবে যাওয়ার মনস্থ করেছেন।
ইন্টারনেট অব থিংসের ট্রিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যের ব্যাপারটি এখনকার প্রচলিত নিয়মে করা যাবে না। এ কাজের মূল সমস্যাটির উদ্ভব হবে জাপানে, সেখানে বাংলাদেশের ব্রিজ ইঞ্জিনিয়াররা সেটির ধারণার কথা দেশে পৌঁছে দেবেন। এখানেই ডিজাইন হবে নতুন কোনো যন্ত্রের। সেটির নমুনা বানানোর জন্য ডিজাইনটি ই-মেইলে পাঠানো হবে চীনে। সেখান থেকে নমুনাটি যশোর হাইটেক পার্কে আসার পর সেখানকার প্রকৌশলীরা সেটিতে কম্পিউটার সফটওয়্যারটি যুক্ত করবেন। তারপর সম্পূর্ণ নমুনা যন্ত্রটি জাপানে যাবে গ্রাহকের পরীক্ষা ও অনুমোদনের জন্য। অনুমোদিত হলে পাওয়া যাবে লাখো পিস বানানোর অর্ডার। তখন সেটি বাংলাদেশে বানাতে গিয়ে আমাদের হার্ডওয়্যার উদ্যোক্তা আবিষ্কার করবেন এর কাঁচামালের প্রতিটিতে গড়ে ৫০-৭০ শতাংশ শুল্ক বসিয়ে রেখেছে আমাদের শুল্ক বিভাগ। কিন্তু তৈরি পণ্য আনলে দিতে হবে মাত্র ২১ শতাংশ। বেচারা তখন গাট্টিবোঁচকা বেঁধে রওনা দেবেন চীন দেশে। সেখানে লাখো পিস তৈরি করে আবার তা দেশে আনতে চাইবেন, যেন অন্তত সফটওয়্যার যুক্ত করার অংশটি দেশে করা যায়। এবং দুঃখের সঙ্গে আবিষ্কার করবেন এ কাজটি আরও কঠিন। ফাইল নিয়ে দপ্তরে দপ্তরে যখন আমাদের তরুণ উদ্যোক্তা দৌড়াদৌড়ি করবেন, তত দিন ভিয়েতনামের উদ্যোক্তা সেটি জাপানে পাঠিয়ে তাঁর বিলের দাবিও পেয়ে যাবেন।
২০১৬ সালের বিশ্বব্যাংকের বিশ্ব উন্নয়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিজিটাল অর্থনীতির উন্নয়নের জন্য এর এনালগ স্তম্ভগুলোকে শক্তিশালী করার বিকল্প নেই। আর প্রতিবছর সরকারের নীতিমালার প্রতিফলন দেখা যায় বাজেটে। যে সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার সংগ্রামে রত, তাদের বাজেটও হতে হবে ডিজিটাল অর্থনীতির সহায়ক। সেখানে ডিজিটাল উৎপাত নয়, ডিজিটাল-সহায়ক নীতিমালার প্রকাশ ও প্রতিফলন থাকতে হবে। যেসব উদ্যোক্তা নিছক কমিশন এজেন্ট না হয়ে দেশেই ডিজিটাল উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে তুলতে চান, তাঁদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সে জন্য খতিয়ে দেখতে হবে কেন এ দেশে কারখানা করতে হলে উদ্যোক্তার স্যান্ডেল ক্ষয়ে যায়, কোন নীতিমালা আমাদের ‘ট্রেডার’ জাতি বানিয়ে রাখতে চায়। ব্রিটিশ আর পাকিস্তানিদের বানানো সেসব নিয়মকানুন, নীতিমালা আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। মনে রাখা দরকার, ব্রিটিশ বা পাকিস্তানিরা আমাদের শুধুই ভোক্তা বানিয়ে রাখতে চেয়েছে, উৎপাদক হতে দিতে চায়নি।
উবার দিয়ে শুরু করেছিলাম। হোয়াটস অ্যাপের কথা দিয়ে শেষ করি। মাত্র ৫৫ জন কর্মীর একটি গ্যারেজ কোম্পানির হাতে উদ্ভাবিত হোয়াটস অ্যাপকে ফেসবুক কিনে নিয়েছে কয়েক বছর আগে মাত্র ১ হাজার ৯০০ কোটি ডলারে। এ রকম একটিমাত্র পণ্যই বিশ্ব আসরে আমাদের ডিজিটাল অর্থনীতির সমার্থক হয়ে উঠবে, যদি আমাদের বাজেট ডিজিটাল উদ্যোক্তাবান্ধব হয়।