ডেলিভারিং হ্যাপিনেস ২২ : পোকার পোকার পোকার
আগের পর্ব : ডেলিভারিং হ্যাপিনেস ২১ : জাপ্পোসের জন্ম
কলেজে পড়ার সময় আমি খুব একটা পোকার কখনো খেলিনি। মাঝে মধ্যে ফান হিসাবে নিয়েছি। কখনো ভাবিনি এটা নিয়ে পড়াশোনা করবো। ১৯৯৯ সালে পোকার নিয়ে সাধারণের মাঝেও আগ্রহ খুব একটা বেশি ছিল না। এমনকী অনেকে পোকারের যে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশীপ আছে সেটাই জানতো না। ইএসপিএনের মতো টিভি চ্যানেলগুলোও কখনো এ নিয়ে উচ্চবাক্য করেনি।
একদিন রাতে ইনসোমোনিয়ায় ঠ্যালায় আমি কম্পিউটারে বসে পড়ি এবং ব্রাউজ করতে করতে একটি সাইটের সন্ধান পাই। দেখলাম ঐ সাইটে পোকার খেলা নিয়ে অনেক তথ্য এবং বিশ্লেষন আছে। আমি খুবই অবাক হলাম কারণ সাইটটি ফ্রি। আমি সারারাত ধরে বেশ কয়েকটি নিবন্ধ পড়ে ফেললাম।
তার আগে পর্যন্ত, অন্য অনেকের মতো আমিও মনে করতাম পোকার আসলে লাক, ব্লাফিং আর মানুষকে পড়তে পারা। কিন্তু পড়ালেখা করে আমি টের পেলাম এগুলোর কোনটাই দিনশেষে গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রত্যেক রাউন্ডের জন্য একটা গাণিতিকভাবে সঠিক দান আছে এ খেলার। সেটা খেলতে পারলে দিনশেষে বিজয়ী হাসি দেওয়া যায়।
অনেকেই প্রত্যেক রাউন্ডকে আলাদা হিসাবে গণ্য করে। কিন্তু খেলতে হবে পুরো সময়টা জুড়ে এবং প্রত্যেক রাউন্ডে নিজের হার-জিতের হিসাব করা যাবে না। ক্যাসিনোতে পোকারই একমাত্র খেলা যেখানে ক্যাসিনো হাউস কোন পক্ষ নয়। হাউস মূলত প্রতিরাউন্ডে যে জিতে তার কাছ থেকে একটা ফী নেয়। ফলে পোকার খেলাতেই একমাত্র হিসেব নিকেশ করা যায়। রুলেত বা জ্যাকপটে ক্যাসিনোওয়ালারা দৃশ্যপটটা এমনভাবে সাজায় যে, আপনি যতই পণ্ডিত হোন না কেন টাকা ওদেরকেই দিয়ে আসতে হবে।
পোকার বোঝার পর আমি ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন ক্লাবে পোকার খেলতে শুরু করলাম। সেখানে একটা টেবিলে ১০ জন থাকে। ক্যালিফোর্নিয়াতে জুয়া বৈধ না হলেও পোকার খেলাটা জায়েজ ছিল। অচিরেই আমি পোকারে দক্ষ হয়ে উঠলাম এবং যেহেতু আমার মতো ‘ম্যাথমেটিক্যালি’ কেউ সেখানে খেলে না তাই নতুন জায়গা খুঁজতে শুরু করলাম। তখন যাওয়া শুরু করলাম লাস ভেগাসে। লাস ভেগাসে নানান মানুষ আসে, কাজে খেলেও আরাম পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিদিনকার খেলা আর পোকারের বই পড়ে আমি অনেক কিছুই শিখে ফেললাম এবং টের পেলাম পোকারের সঙ্গে ব্যবসার একটা সম্পর্কও আছে।
আমি সেগুলো লিখেও ফেললাম
বাজারের সম্ভাব্যতা যাচাই
- টেবিল বাছাই করা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত যা তুমি নিতে পারো
- তুমি যদি টের পাও এ টেবিলে খেলে তুমি যুৎ করতে পারবা না তাহলে টেবিল বদলানো জায়েজ
- টেবিলে যদি অনেক উল্টাপাল্টা ও আনাড়ি খেলোয়াড় থাকে তাহলে তুমি যতই ভাল খেলোয়াড় হও না কেন, জেতাটা কঠিনই (ই-উপত্যকার কথা ভাবতে পারো)।
বিপণন ও ব্র্যান্ডিং
- যখন দুর্বল তখন সবলের ভান করো, যখন সবল তখন দুর্বলের ভান করো এবং কখন ভ্লাফ দিতে হবে সেটা জানো
- তোমার ‘ব্র্যান্ড’ কিন্তু তোমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ
- তোমার সম্পর্কে লোকে যেন গল্প করে সেটাতে মনোযোগ দাও, গল্পটাকে ঠিকমতো দানা বাঁধতে দাও
ফিন্যান্স
- সবসময় সবচেয়ে খারাপ সময়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখো,
- যে লোক সবচেয়ে বেশিবার জেতে সে কিন্তু সবচেয়ে বেশি টাকা জেতার লোকটা নাও হতে পারে, আবার যে লোকটা সবচেয়ে বেশিবার হারে সেও কিন্তু সবচেয়ে বেশি টাকা হারার লোক নাও হতে পারে
- যে কিনা একবারও হারে না, সেই কিন্তু সবচেয়ে বেশি টাকা জেতে না
- মারি তো গণ্ডার লুটিতো ভান্ডার হবে তোমার কৌশল। অর্থাৎ যেখানে বড় দানের সম্ভাবনা সেখানেই লড়তে হবে; যেখানে রিস্ক কম সেখানে নয়।
- নিজের ব্যাঙ্কের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। সেই দান কখনো খেলা যাবে না যা তোমাকে দেউলিয়া করে ফেলবে
- যে ক্ষতি তুমি পোষাতে পারো সে পরিমাণই তুমি খেলবা নতুবা দুর্যোধনের পাল্লায় পড়ে দ্রৌপদীকে হারাতে পারো
- এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী খেলা, কখনো হারবা, কখনো জিতবা; হিসাব করতে হবে দিন শেষে কী হয় সেটা নিয়ে
কৌশল
- যে খেলা জানো না, বোঝো না সে খেলার দরকার নাই, যদিও অনেকেই সে খেলা খেলে হয়তো প্রচুর টাকা কামাই করছে,
- যখন স্টেক খুব উঁচু না তখনই সেটার কলকব্জা বুঝতে হবে
- চিটিং করা যাবে না, ফোর-টুয়েন্টিরা শেষ পর্যন্ত জিততে পারে না
- নিজের নীতিতে অটল থাকো
- ফ্লেক্সিবল হও। দরকার হলে প্রতিমুহূর্তে নিজের খেলার স্টাইল পরিবর্তন করো
- দূরের দিকে তাকাও এবং ধের্যশীল হও
- যার স্ট্যামিনা বেশি আর ফোকাস আছে সেই জিতে শেষপর্যন্ত
- অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করো
- ধন্য আশা কুহকিনী, আশা কোন ভাল পরিকল্পনা নয়
- বেপরোয়া হওয়া যাবে না, দরকার হলে বিরতি নাও, এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াও
সতত শিক্ষা
- নিজেকে প্রতিনিয়ত শিক্ষিত করো, প্রচুর বই পড়, শিখো
- হাতে কলমে শিখো – লার্নিং বাই ডুইং। থিউরি ভাল, সেটাতে পরীক্ষায় নম্বর ভাল পাওয়া যায়।
- ভাল শিখতে হলে ট্যালেন্টেড প্লেয়ারদের সঙ্গে খেলতে হবে, হন্ডুরাসে সঙ্গে খেলে চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায় না
- পর পর কয়েক দান জিতলে নিজেকে ভাল খেলোয়াড় ভেবো না, নিজের শেখার জায়গা ঠিক রাখো
- ভাল পরামর্শের খোঁজে কখনো পিছপা হয়ো না
কালচার
- ভাল খেলোয়াড় হতে হলে খেলাটাকে ভালবাসতে হবে। সেখানেই খাওয়া আর ঘুমানো হওয়া চাই
- ভয় পাওয়ার দরকার নাই। সব সময় কেউ না কেউ তোমার চেয়ে ভাল খেলবে। মনে রাখবা বাবার ও বাবা আছে, তাকে বলে দাদা।
- বিনয়ী, সদালাপী বন্ধু বৎসল হও। বন্ধু বানাও।
- নিজে যা শিখছো সেটা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করো
- খেলার বাইরেও সম্ভাবনার প্রতি নজর রাখো
- হ্যাভ ফান। মজা নাও। খেলাটা সত্যিই মজার
পোকার খেলা থেকে যা আমি শিখেছি তার মধ্যে একটা হলো টেবিল নির্বাচন। কারণ এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।ব্যবসাতেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কোন ব্যবসাটা তুমি করতে চাও সেটা ঠিক করা। আজকে যদি তুমি এমন একটা প্রতিষ্ঠান করতে চাও যা ওয়ালমার্টের সঙ্গে কম্পিট করবে তাহলে দ্বিতীয়বার ভাবো।
পোকারের সঙ্গে ব্যবসার একটা বড়ো পার্থক্যও আছে। সেটাও মাথায় রাখতে হবে। পোকার খেলায় আমাকে কোন একটা বিদ্যমান টেবিলকেই বেছে নিতে হয়। কিন্তু ব্বযসাতে আমি সম্পুর্ণ নতুন একটা গেম চালু করতে পারি অথবা বিদ্যমান কোন ব্যবসাকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যেতে পারি। উদাহরণ হিসাবে সাউথওয়েস্ট এয়ারলাইন্সের কথা বলি। ওরা কিন্তু নিয়মিত বিমানযাত্রীদের টার্গে করে ব্যবসাতে নামে নাই। ওরা বরং যারা বিলাসী বাসসার্ভিস কিংবা ট্রেন ব্যবহার করে তাদেরকই টার্গেট করেছে। ওদের টিকেটের দাম হলো কম, টিকেট বদলালে পেনাল্টি দিতেও হয় কম। আর কাছাকাছি জায়গায় যাওয়ার জন্যও ওরা সার্ভিস দিতে শুরু করলো। তারা সফল হয়েছে কারণ তারা অন্যান্যদের তুলনায় টেবিলটা বড় করে ফেলেছে।
[আমাদের দেশে ওয়ালটনও ঠিক এই কাজটা করেছে। ওরা টিভি, ফ্রিজকে উচ্চবিত্ত আর উচ্চ মধ্যবিত্তের মুঠো থেকে সাধারণের মাঝে নিয়ে গেছে – ওয়ালটনের একটা কেস স্টাডি মনে হয় এখানে দেওয়া যায়]।
খেলতে খেলতে আমি মোটামুটি বোরড হতে শুরু করলাম।
এবং টের পেলাম আমাকে এখন টেবিল বদলাতে হবে।
[জাপ্পোসের সিইও টনি সেই-এর বিখ্যাত বই ও দর্শন সুখ বিতরণের কিছু অংশ আমি অনুবাদ করছি আমার মত করে, আমাদের উদ্যোক্তাদের জন্য। এটি আক্ষরিক অনুবাদ নয়]
2 Replies to “ডেলিভারিং হ্যাপিনেস ২২ : পোকার পোকার পোকার”