ভিন্ন হওয়ার সাহস
সানড্রো ফোরতে, বিশ্বের সেরা ২৫% জীবন বীমা সেলসম্যানের অন্যতম, এখন নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান চালান। ১৯৭৬ সালে তার বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ে। এবং এর মাত্র দুই বছরের মধ্যে বাবা মারা যান। সানড্রোর মা, তার আরো তিন সন্তান নিয়ে বেচে-বর্তে যাওয়ার কথা। কারণ তাদের একটি ভাল রেস্তোরা ছিল। কিন্তু আইনী মারপ্যাচে সে রেস্তোরা নিয়ে নেয় সানড্রোর ফুফু। এর পর দেনার দায়ে নিজেদের বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে সানড্রোদের উঠে আসতে হয় গণ-ঠিকানায়।
মানুষের জীবনে যখন একটি দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তখন অন্য দরজা খুলে যায়। সানড্রোর মার সঙ্গে ডেভের পরিচয় হয় এবং একটি নতুন সংসার শুরু হয়। তখন থেকে সানড্রোর মনে হতো আচ্ছা আবার যদি বজ্রপাত হয়? তাহলে এই সংসারের কী হবে?
১৯৮৯ সালে জীবন বীমা কোম্পানিতে চাকরি শুরু করার পর সানড্রো ভেবেছে ডেভের একটা বীমা করানো দরকার। পারিবারিক ভাবে সবাই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতে পারে এটা ভেবেও শেষ পর্যন্ত সানড্রো তার সৎপিতাকে রাজী করাতে সক্ষম হোন। ডেভ একটা জীবন-বীমা করার মাত্র কয়েক মাস পরেই ক্যান্সারে মারা যান। মারা যাবার আগে ডেভের শেষ কথা ছিল, “ পুত্র, পরিবারের জন্য তুমি যা করেছ তার জন্য ধন্যবাদ। তোমার জন্য আমি গর্বিত।”
সান্ড্রোর আবার সংগ্রাম। তবে, লড়াই সংগ্রাম শেষে সান্ড্রো শেষ পর্যন্ত মিলিয়ন ডলার রাউন্ড টেবলের শীর্ষ তালিকায় উঠে আসেন। এখন তিনি সপ্তাহে তিনদিন নিজের একটি প্রতিষ্ঠান চালান, দুইদিন লেখালেখি এবং বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান। তার বিপনন ও বিক্রয় ক্ষমতাকে ‘জাদুকরী’ হিসাবে চিহ্নিত করেন অনেক। তার বক্তৃতা কালে অনেকে তাকে তার সাফল্যের গল্প বলার জন্য অনুরোধ করেন। এই বইটি তার সাফল্যের গল্প।
কয়েকটি অধ্যায়ে সান্ড্রো তার সাফল্যের মূলমন্ত্রগুলো ব্যাখ্যা করেছেন। শুরু করেছেন একটি উপমা দিয়ে। জন্ম থেকে অন্ধ কোন লোক হটাৎ করে যদি তার দৃষ্টি শক্তি ফিরে পায় তাহলে সে এক নতুন জগৎ দেখতে পায়। দেখতে পায় নতুন নতুন সম্ভাবনা। আসলে সব মানুষের জীবনেই অফুরন্ত সম্ভাবনার হাতছানি। তবে শতকরা ৯০% লোক সে সম্ভাবনা দেখতে পায় না। কারণ তা দেখার জন্য যে সাহস, দৃষ্টি দরকার তা তাদের থাকে না। তারা কেবল কয়েকফুট দূরের জিনিষ দেখতে পায়।
অন্যদিকে বাকী ১০%, যারা কিনা সম্ভাবনাকে দেখে তাদের মধ্যে ৭% কিন্তু দোনামনা করে। করবো কি করবো না এরকম একটা পয়েন্টে থাকে। আমি কি পারবো? এমন প্রশ্নও করে। ফলে শেষ পর্যন্ত তারা তেমন কিছু করতে পারে না। জগতে সফল হয় ৩% যারা ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা করে, লেগে থাকে এবং সাহস নিয়ে এগিয়ে যায়।
প্রথম অধ্যায়ে চূড়ান্ত সাফল্যের জন্য চারটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন সান্ড্রো –
• কোন কাজে ধারাবাহিকভাবে লেগে থাকার প্রকৃতি অনুধাবন করতে পারা এবং লেগে থাকার শিল্প আয়ত্ব করা,
• যে সব চিন্তা এই লেগে থাকাকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে তা চিহ্নিত করতে পারা,
• যে সকল পদ্ধতি ও টুলস ব্যবহার করলে লেগে থাকাটা সহজ হয় তার অন্তর্নিহিত ভাব-কিতাব জানে এবং প্রয়োগ করতে পারে, এবং
• নিজের জীবনের প্রধান লক্ষ্যের ব্যাপারে স্থির থাকে।
বেশিরভাগ মানুষ নতুন সম্ভাবনাকে দেখে না কারণ, সাধারণভাবে বা মিডিওকার হিসাবে বেঁচে থাকাটা কোন লক্ষ্যপূরণের চেয়ে অনেক সহজ!!! নিশ্চিত ভাবে কোন কাজ করার চেয়ে সে কাজ না করার যুক্তি বের করাটা সহজ বটে!!!
তো, চিন্তা করলেই খালি হবে না। কাজও করতে হবে। কারণ কাজ করলেই কেবল চিন্তার ফল পাওয়া যায়!
শুরু করতে হবে লক্ষ্য স্থির করে। জীবনের একটি মূল লক্ষ্য থাকা দরকার। তারপর নানান সাব-লক্ষ্য। থাকবে বিভিন্ন মাইল স্টোন।
যেমন আমার জীবনের লক্ষ্য যদি হয় বুয়েট থেকে প্রকৌশলী হয়ে বের হবার, তাহলে হায়ার সেকেন্ডারিতে আমার ফিজিক্স, কেমেস্ট্রি ও ম্যাথে ভাল দক্ষতা অর্জন করতে হবে। নতুবা আমি বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষাতে উৎরাতে পারবো না।
লক্ষ্য স্থির করার পরের কাজটা হল বিশ্বাস করা। ইতিবাচক ভাবে মনে প্রাণে বিশ্বাস করা যে আমি সেটা করতে পারবো। মনোচিকিৎসকরা এ ক্ষেত্রে বেশ কিছু পরামর্শ দেন যা কাজে লাগে। মাইন্ড চেঞ্চিং কার্ড, ফ্লিপ কার্ড, ফাস্ট ফরোয়ার্ড ইত্যাদি। ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়া তার পড়ার টেবিলের সামনে লিখে রাখতে পারে , “আমি বুয়েটে ভর্তি হবো।”
এভাবে নিজের প্রতি, লক্ষ্যপূরণের প্রতি বিশ্বাস জন্মাতে হবে। তারপর হলো সে লক্ষ্যপূরণের কাজ।
তবে, শুরু করা যেতে পারে নিজের একটা এসেসমেন্ট বা মূল্যায়ন করে। একাদশ শ্রেণীতে উঠেই একটা মূল্যায়ন করা যতে পারে। বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় পদার্থ, রসায়ন আর ম্যাথ ছাড়াও থাকে ইংরেজি। কাজে এই চারটি বিষয়ে দক্ষতা না থাকলে ভর্তি হওয়া যাবে না।
তাহলে একাদশ শ্রেণীর শুরুতে একটি মূল্যায়ন করা যায় এই চার বিষয়ে নিজের দক্ষতার। বুয়েটের ভর্তিপরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার কথাতো জানাই। তাহলে, বের করা যাবে গ্যাপটা কোথায়। সেটা পূরণের জন্যই আগাতে হবে।
সান্ড্রোর এই বইটি আসলে একটি ওয়ার্কবুক। মানে কেবল পড়ার জন্য নয়। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু কাজও করতে হবে। যেমন প্রথম অধ্যায় শেষে সান্ড্রো পরিস্কার করে বলছেন – নিচের কাজগুলো করে নিতে। নতুবা পরের চ্যাপটারে যাবার দরকার নেই-
• নিজের জীবনের মূল লক্ষ্য লিখ
• অন্যান্য লক্ষ্য – স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য
• এর মধ্য কমপক্ষে ১০টি লক্ষ্যের জন্য মাইন্ডচেঞ্জার ফ্লিপকার্ড তৈরি করে প্রতিদিন একবার করে পড়তে শুরু করো
• একটি কাগজে নিচের বিষয়গুলো লিখে সেটির ওপর নিজেকে মূল্যায়ন কর। ১-১০ এর মধ্যে নম্বর দিতে হবে্। ১ হলো দূর্বল আর ১০ হলো ভাল।
o আত্মবিশ্বাস
o ব্যাক্তিগত উচ্চাখাঙ্খা
o পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইতে পারা
o অধ্যবসায়
o কাজে নেমে পড়া
o কমিউনিকেশন
o পার্সোনাল এপিয়ারেন্স
o পরিকল্পনা আর পরিকল্পনা প্রনয়ণ
o সময় ব্যবস্থাপনা
o প্রতিদিনের কাজ সম্পর্কে সচেতনতা
o ফোকাস
o সমস্যা মোকাবেলা
o পড়ার অভ্যাস
o সুখী হওয়া এবং ব্যক্তিগত পরিতৃপ্তি
o শারীরীক সক্ষমতা
o বিক্রয়
শেষেরটা দেখে বোঝা যাচ্ছে এই বইটি মূলত মার্কেটিয়ারদের জন্য। কিন্তু অন্যরাও যে উপকৃত হবে তাতে কোন সন্দেহ নাই।
বাড়িয়ে ধরার দরকার নাই। নিজের ব্যাপারে খুবই সতর্ক হতে হবে। যে কোন ধরণের বাহুল্য শেষ পর্যন্ত নিজের সর্বনাশই ডেকে আনবে।
সান্ড্রোর বইটা পড়া আমার জন্য খুব সহজ হবে না। আবার এখন আরো কিছু বই পড়ছি। কাজে পরের পর্এব কবে লিখবো সেটা কেউ জানে না। তবে, নিজেরাই যদি পড়ে নিতে পারে তাহলে আমার কাজটা কমে যায়!
সবার সেকেন্ড ডিফারেন্সিয়াল নেগেটিভ হোক।