বিশ তিরিশের চট্টগ্রাম – প্রস্তুত তো?

Spread the love

১৮৫৭ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ করে উপমহাদেশের লোক। সেই সময়কার কয়েকজন সিপাহীনেতারর কথা জানা যায়। এর মধ্যে সিপাহী জামাল খানের নামেই চট্টগ্রামের জামাল খান সড়কের নাম। আর হাবিলদার রজব আলীর নামে জেল রোডের নাম যদিও বৃটিশরা এবং পরে আমরা সেটাকে জেল রোডই রেখেছি। জামাল খান সড়কের শেষ মাথায়, ডা. খাস্তগীর স্কুলের সামনে, সেন্ট মেরিস স্কুলের পাহাড়ে ওঠার আগের মোড়টার নাম এখন ডা. হাসেম স্কোয়ার। ডা. হাসেম কোলকাতার বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা সেই সময়কার পূর্ববাংলার প্রথম মুসলিম এমবি ডাক্তার। চট্টগ্রামেরই লোক। ১৯২৭/২৮ সালে মহাত্মা গান্ধীকে রেঙ্গুন নিয়ে যান জাহাজ ব্যবসায়ী আবদুল বারি চৌধুরী। গান্ধীজী যখন বন্দরে পৌছান তখন একটা জাহাজের মাস্তুলে ব্রিটিশ পতাকা লাগানো ছিল। একজন খর্বকায় ব্যক্তি মাস্তুল বেয়ে ঐ পতাকা নামিয়ে আনেন। তিনি ঐ ডাক্তার হাসেমই।

তারও বছর খানে আগে, চট্টগ্রাম পৌরসভার নূর মোহাম্মদ চেয়ারম্যান শিক্ষা কার্যক্রমকে পৌরসভার কার্যক্রমে অন্তর্ভূক্ত করেন। এর ফলে চট্টগ্রাম পৌরসভা হয় উপমহাদেশের প্রথম পৌরসভা যার স্কুল আছে। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে। ১৯৩০ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে উপমহাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রামের সূর্য সেন। আমার বাড়ির কয়েক কিলোমিটার দূরে তাঁর জন্মস্থান।

সে সময়টাতে বাবরি চুলের কবি কাজী নজরুল ইসলাম সারাদেশে ঘুরে বেড়ান। তাঁকে চট্টগ্রাম হয়ে রাউজান নিয়ে যান শিক্ষক মৌলভী আহমদ চৌধুরী। রাউজানে দুইদিনের যুব সম্মেলনে তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর তুতভাইয়েরা যাদের একজন ইউসুফ চৌধুরী। ইউসুফ চৌধুরী পরে বাংলাদেশের প্রথম ফটোটাইপ সেটিং পত্রিকা “দৈনিক পূর্বকোণ” প্রকাশ করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সিগনেট প্রেসই প্রথম বাংলাদেশে লিভার ব্রাদার্সের (এখন ইউনিলিভারের) বিভিন্ন সামগ্রীর মোড়ক তৈরি করতে শুরু করে। নেতৃত্ব দেস চট্টগ্রামে দেশের একমাত্র ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। আদমজী-বাওয়ানীর শৃঙ্খল ভেঙ্গে পূর্ব পাকিন্তানে প্রথম পাটকল প্রতিষ্ঠা করে এ কে খান। ঐ চট্টগ্রামেরই লোক।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার খবর কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি সবার প্রথমে করেন চট্টগ্রামের আবুল কাশেম সন্দীপ। যুদ্ধের দামামাও বাজে এখান থেকে।

স্বাধীনতার পরেও এই ধারা অব্যাহত ছিল। বর্তমানে দেশের প্রথম রপ্তানী খাত তৈরী পোষাক শিল্প। অনন্য নূরুল কাদেরের দেশ গার্মেন্টস থেকে এর সূত্রপাত। দেশ গার্মেন্টস-এর কারখানটিও চট্টগ্রামে। দেশের প্রথম ইপিজেড হয়েছে চট্টগ্রামে।
এসবই কিন্তু কোন আকস্মিক বিষয় নয়। কেবল ব্যবসা বা বাণিজ্য উদ্যোগ নয়। লেখাপড়া বা ক্রীড়াতে চট্টগ্রাম সব সময় অগ্রগণ্য ছিল। আইসিসি ট্রফি জিতে বাংলাদেশ দলের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে যাত্রা শুরু হয়। সেই দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন কাজির দেউড়ির আকরাম খান। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড থেকে বাংলাদেশের জন্য প্রথম সোনার পদকটি এনেছে চট্টগ্রামের আহেমদ জাওয়াদ চৌধুরী। তারও আগে প্রথম ব্রোঞ্জ বা প্রথম রূপার পদকটিও চট্টগ্রামের ছেলে-মেয়েদের দখলে। কমনওয়েলথ গেমস থেকে আমাদের প্রথম সোনার পদকটি চট্টগ্রামের স্যুটার আতিকুল ইসলামের।

এতোকিছুর পরও এখন চট্টগ্রাম অনেক কিছুতেই পিছিয়ে। এক সময় বলা হতো চট্টগ্রামের ছেলেমেয়েরা মায়ের পেট থেকে ব্যবসা শিখে আসে। কিন্তু সরকারের আইডিয়া প্রজেক্টের অনুদান পাওয়া স্টার্টআপের তালিকায় চট্টগ্রামের কাউকে খুঁজে পেতে খুবই কষ্ট হয়। এক সপ্তাহ আগে স্টুডেন্ট টু স্টার্টআপ প্রতিযোগিতার প্রথম ১০টিতেও নেই চট্টগ্রাম। প্রতিবছর যে প্রোগ্রামিং –এর যে বিশ্ব প্রতিযোগিতা হয় সেখানে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি।

ব্যবসায়ীর দেশ বল কথিত চট্টগ্রামে উদ্যোক্তার অভাবে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানীতে না আছে কোন বিশ্বমানের হাসপাতাল না আছে কোন বিশ্বমানের রিসোর্ট! সর্দি জ্বর বেশি থাকলে চাঁটগাইয়াদের ঢাকায় যেতে হয় চিকিৎসা করতে! অথচ এসবই সমাধান করে ফেলা যায় যদি এক সময়কার প্রাচ্যের রাণী আবারও উঠে দাড়ায়, নিজের উদ্যোক্তা সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনে। আর এজন্য যা কিছু করার দরকার সব আমাদেরই করতে হবে। কাজটা দুইভাবে হতে পারে। এক হলো ফেসবুকে জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস দিয়ে আর চায়ের কাপে ঝড় তুলে সরকারের চৌদ্দগুষ্ঠী এবং চট্টগ্রামের রাজনৈতিক-প্রশাসনিক নেতৃত্বের ষোলগুষ্ঠি উদ্ধার করে। অথবা নিজেরা দল বেঁধে ছোট ছোট কাজ করে।
তবে শুরু করার আগে অন্য দিকের কিছুও ভেবে দেখা যায় । বিশেষ করে ২০৩০ সালকে সামনে রেখে।

আগামী ১০ বছরে সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেরও অনেক পরিবর্তন হবে। এই যেমন মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হলে তার সাক্ষাৎ প্রভাব পড়বে চট্টগ্রাম ও কর্ণফূলী ইপিজেডে। সেখানকার বেশিরভাগ কোম্পানির অনেক ওপরের কর্মীতো বটে মূল শ্রমিকরাও পাড়ি জমাবে মিরসরাইতে। দুই কারণে এই মাইগ্রেশন হবে – মিরসরাইতে নতুন কিছু হবে ফলে ক্যারিয়ারে একটা জাম্প পাওয়া যাবে, ২ নম্বর হলো শ্রমিকদের বড় অংশ যারা নোয়াখালী, কুমিল্লা থেকে এসেছেন তারা বাড়ির কাছে চলে যাবেন। তার মানে হলো চট্টগ্রামে একটা শূণ্যতা তৈরি হবে।
গভীর সমুদ্রবন্দরটা চালু হয়ে যাবে। এটি লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থানে অবদান রাখবে যদি ঠিকমতো নার্সিং করা যায়। এই বন্দরকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের তৎপরতা বাড়বে। বিমানের উঠানামা বাড়বে। এই বিমানবন্দরের চাপ আরও বাড়বে কারণ ঢাকা বিমানবন্দর চাইলেও বাড়তে পারবে না। ফলে, অনেকেই তাদের ফ্লাইট রিডাইরেক্ট করবে চট্টগ্রামে।
যদিও বাণিজ্যিক রাজধানীর যে মূলা দেখানো হয়েছে চট্টগ্রামবাসীকে সেটার জন্য তেমন কিছুই হবে না। কিন্তু, একটা নিরব পরিবর্তন তখন সামনে আসবে। সেটি হলো চট্টগ্রামের দ্বিতীয় প্রজন্মের ব্যবসায়ীদের সামনে আসা। এদের বড় অংশ বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে এসেছেন, তাদের ফোরসাইট ভাল, দেখার চোখ আছে। ফলে, অনেক পড়ে থাকা বিষয়ে তারা নজর দেবেন। বারকোডের মঞ্জুরুল হক বা প্যাসিফিকের সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর হচ্ছেন এদের উদাহরণ। ফলে, টালিখাতা থেকে বের হয়ে আসা সম্পন্ন করবে খাতুনগঞ্জ। একটি নতুন মেরুকরণ হবে।

১১টি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে আছে। সেগুলোর মান নিয়ে হয়তো এখনও কেই সেভাবে ভাবে না, কিন্তু তরুণ একদল শিক্ষক এখন সেখানে ফিরছেন। তারা কাজটা শুরু করেছেন, সামনে দৃশ্যমান হবে।২০৪১ সালের বাংলাদেশে একাধিক সিটি একেবারে সিটি গভর্নমেন্টের মর্যাদা পাবে। সেগুলোকেই কেন্দ্র করেই কিন্তু ঘুরবে অর্থনীতি। চট্টগ্রাম হবে তার একটা।

এসব চমৎকার সম্ভাবনার পাশাপাশি নজর দিতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের। আগামীতে চট্রগ্রামের এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে জলবায়ু পরিবর্তন। ইতোমধ্যে যার প্রভাব পড়তে শুরু হয়েছে। সাধারাণ সুইমিংপুলসম জলাবদ্ধতাতো আছেই। এছাড়া শহরের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ বছরে চারমাস জলমগ্ন থাকে। চাক্তাই খাতুনগঞ্জের আড়তদাররা এই চার মাস সকাল-সন্ধ্যা জোয়ারের পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে আড়তগুলো বাইরে সরিয়ে নিতে শুরু করেছে। বাকলিয়া, আগ্রাবাদের অনেকটা অংশ এখন থেকেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ভুগতে শুরু করেছে। গত ১০ বছর আগে নির্মিত অনেক গুলা বিল্ডিং এর নিচতলার অর্ধেক সকাল সন্ধ্যায় প্লাবিত থাকে। হয়ত আগামী দশ বছর পর এসব ইমারতের নিচতলা আর খুজে পাওয়া যাবেনা।এসব এলাকার মানুষজনকে এই চার মাস উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের মত জোয়ার ভাটার সময় জেনে ঘর থেকে বের হতে হয়।
চট্টগ্রাম থেকে অনেক ছেলেমেয়ে এখন বাইরে পড়তে যাচ্ছে বটে তবে অন্যান্য জেলার সঙ্গে সেটি যথেষ্ট পিছিয়ে। যারা যাচ্ছে তারাও ফিরছে কিনা সেটিরও খোঁজ করা হচ্ছে না। তবে, আমি ধারণা করি ওদের একটা বড় অংশ দেশে, নাড়ীর টানে, ভালবাসায় দেশে ফিরবে। তাদের কাজের জায়গা কী হবে? সেই ১৯৮০র দশকে ভালবেসে দেশে ফিরেছিলেন জামাল নজুরল ইসলাম। চবি’তে গড়ে তুলেছেন একটি গবেষণা কেন্দ্র। এর পরের সেরকম কেন্দ্র কবে হবে?

আমরা যখন ছোট ছিলাম তখনও চট্টগ্রামে বেড়ানোর জায়গা ছিল ওয়ার সিমেট্রি আর পতেঙ্গা। আর নিউমার্কেটে যেদিন এক্সেলেটর চালানো হতো। এখনও তাই আছে। যশোরের মনিহার সিনেমা হলের পরপরই তৈরি হয়েছিল বনানী কমপ্লেক্স। গত রবিবার গিয়ে জনলাম সেখানে আর সিনেমা কমপ্লেক্স নেই। চট্টগ্রামে সিনেপ্লেক্সের মতো কোন বিনোদন কেন্দ্র নেই। যদিও ঢাকার সিনেপ্লেক্সটির উদ্যোক্তা চট্টগ্রামেরই লোক!

সবচেয়ে বড় কথা, গত দুই সপ্তাহ ধরে হন্য হয়ে খুঁজেও চট্টগ্রামের কমপ্রিহেনসিভ কোন ডেটাবেসের সন্ধান করতে পারলাম না। নাই মনে হয়।

১৯৩০-এর দশকে মহাত্মা গান্ধী চিটাগাং-এ এসে চট্টগ্রামের কাজ কর্ম দেখে খুবই আপ।রুত হোন। দিল্লী ফিরে যাবার পর চট্টগ্রাম সফর কেমন হয়েছে এই প্রশ্নের জবাবে গান্ধীজী বলেন – চিটাগাং টু দ্যা ফোর! চট্টগ্রাম সব সময় এগিয়ে থাকে?

বিশ তিরিশে কী চট্টগ্রাম এগিয়ে থাকবে?

 

 

 

2 Replies to “বিশ তিরিশের চট্টগ্রাম – প্রস্তুত তো?”

  1. চলেন নেমে পড়ি। শুরু হোক বিশ তিরিশের চট্টগ্রামের প্রস্তুতি। চোদ্দ-ষোল গুষ্টি উদ্ধার করে কিছুই হবে না।

Leave a Reply