বিজ্ঞান কংগ্রেসের প্রথম দিন
শিক্ষক যদি পুরুষ না হয়ে মহিলা হয় তাহলে কী শিক্ষার্থীরা বেশি শেখে? রাস্তার ধারে যে সর্বরোগহর ওষুধ পাওয়া যায় সেগুলো কি আদৌ কাজ করে? ঢাকা শহরের ছেলেরা কি মেয়েদের চেয়ে বেশি “মোটকা”? গান শুনলে কী বুদ্ধি বাড়ে?
না, এটি রস-আলোর কোন প্রদতিবেদন নয়। আজকে বিএফএফ-এসপিএসবি শিশু কিশোর বিজ্ঞান কংগ্রেসের খুদে বিজ্ঞানীরা যে সব বিষয় নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে এগুলো হল তার কয়েকটা।তবে, এসকল চিন্তার পাশাপাশি রবণাক্ত নদীর কুলে কোন গাছ বাঁচে না, জোয়ারের সময় পানিতে বেশি পলি থাকে না ভাটার সময়? এই যে আমরা বলি পানিতে রাখলে লোহাতে মরিচা পড়ে এটা কি ঠিক? শুধু পানিই কী সব?
এমনতর নানান প্রশ্নের উত্তর খোঁজা নিয়ে খুদে বিজ্ঞানীদের পেপার, পোস্টার আর প্রকল্প নিয়ে একটি ব্যস্ত দিন কেটেছে। তাদের ভাবনাচিন্তার জগতে বিষয়বস্তুর কত যে বৈচিত্র তা গুনে বলা মুশকিল। সারা দেশ থেক প্রায় ৪৫০ জন খুদে বিজ্ঞানী আজকের এই কংগ্রেসে যোগ দিয়েছে।
তাদের কেও পরিসংখ্যান টুল ব্যবহার করেছে। কেও কাঁচের বয়ামে পানির মধ্যে লোহা ভিজিয়ে রেখেছে, কেও একটা ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে আবার কেহ ভেবেছে প্রতিবন্ধীদের জন্য কী এমন হুইল চেয়ার বানানো যায় যা কী না সাধারণ সিড়ি দিয়ে উঠতে পারে?
এবারের কংগ্রেসের প্রথম দিনে দুইটি অত্যন্ত আনন্দময় ঘটনা ঘটেছে।
প্রথমটি হল আজ আমাদের মাঝে এসেছিলেন আমাদের কণা পদার্থবিজ্ঞানী হারুন-অর রশীদ স্যার। আজ থেকে ৩৬ বছর আগে যে ক’জন বিজ্ঞানীর হাত ধরে দেশে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের কাজ শুরু হয়েছিল তাদেরই একজন হারুন স্যার। উদ্বোধনী ভাষনে তিনি বলেছেন – আমাদের দেশের মানুষের মত মানুষ আর কোন দেশে নাই। তারা মায়ের ভাষার জন্য, মায়ের দেশের জন্য অবলীলায় জীবন দিতে পারে। প্রতিটা মানুষ প্রতিটি মানুষের পাশে দাড়াতে পারে। কাজে এই দেশ তো এগিয়ে যাবেই।
দ্বিতীয় ঘটনাটা হল হারুন স্যারের দুই প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীও আজ অনুষ্ঠানে ছিলেন। আজ সারাদিন জাফর ইকবাল স্যার-ইয়াসমীন ম্যাডাম কংগ্রেসে ছিলেন, নানা-নানী হিসেবে। নোভা আহমেদ-আরশাদ চৌধুরীর বড় মেয়ে অনুভার একটা পোস্টার ছিল কংগ্রেসে। তাদের সঙ্গেই এসেছিলেন নানা-নানী। নানা তারপর প্রায় বিকেল পর্যন্ত খুদে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কাটিয়েছেন। আমার হিসেবে প্রায় ৭-৮ বছর পর স্যার এতোটা সময় ধরে একটি মাত্র অনুষ্ঠানে কাটিয়েছেন। প্রত্যেকটা প্রজেক্ট দেখেছেন, ভাল-মন্দ বলেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন। প্রত্যেকটি পোস্টার দেখেছেন। সব খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেছেন। খুদে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলেছেন, ছবি তুলেছেন।
ফাঁকে ফাঁকে আমরা আমাদের ভবিষ্যত কর্মকাণ্ড নিয়ে আলাপও করেছি।
জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের কংগ্রেসে বিচারক হিসাবে ছিলেন বর্ষীয়ানদের সঙ্গে একঝাঁক তরুন শিক্ষক-শিক্ষিকা। কেও কেও সকালে কিছুক্ষণ থেকে চলে যাবেন বলেছিলেন তবে শেষ পর্যন্ত যান নি। রয়ে গেছেন। খুদে বিজ্ঞানীদের ভালবাসার জোর। [যারা আজকের দিনটা মিস করেছো তারা আগামীকাল সকাল বেলায় কংগ্রেস ঢু মারতে পারো। স্যার কিন্তু কালও কংগ্রেসে থাকবেন]।
কংগ্রেসের প্রজেক্ট-পোস্টার-পেপার দেখে আমি, নোভা আর লাফিফা ম্যাডাম আলাপ করছিলাম আমরা নিজেরা কবে পেপার-পোস্টারের কথা জেনেছি? আমি তো চাকরি করতে এসে প্রথম পেপার লিখেছি, লাফিফা আর নোভা তাদের গ্র্যাজুয়েশনের শেষের দিকে। আর আমাদের অরিত্র মাত্র ক্লাস ওয়ানে পড়ে।
আমি খালি সেদিনগুলোর কথা ভাবছি যখন এই ছোট বেলা থেকে মেথডিক্যাল বিজ্ঞান গবেষণা জানা ছেলে মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে। ওরা নিজেরাই স্যার-ম্যাডামকে খুঁজে বেড়াবে তাদের গবেষণার সুপারভাইজর হতে। আমি নিশ্চিত ওরা যখন গ্যাজুয়েশন করে বের হবে তখনই ওদের একাধিক জার্নাল পেপার থাকবে। আমাদের কেবল তাদের জন্য পথটা তৈরি করে দিতে হবে, পথের বাঁধাটা সরিয়ে নিতে হবে।
আজও গৌরাঙ্গ স্যারের কথা মনে পড়েছে। স্যার বলেছিলেন গণিত অলিম্পিয়াডের সমস্যা সমাধান করতে আমাদের শিক্ষার্থীদের ম্যালা দিন লেগে যাবে। ওরা সেটি ভুল প্রমাণিত করেছে।
তিন বছর আগে আমরা যকন কংগ্রেস শুরু করি তখন অনেকই নাক-সিটকে বলেছিলেন – চিলড্রেন কংগ্রেস? বাচ্চারা পোস্টার বানাবে, পেপার লিখবে? হু!
আমি জানি এখন তারা রাগে গর গর করছেন। কারণ আমাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা একটা একটা করে টেকনিক ধরছে। যেমন জরিপ ভিত্তিক গবেষণা। এটা ওরা শিখে ফেলেছে। গত দুই বছর ধরে আমরা যত ক্যাম্প করেছি সেখানে মূল উপজীব্য ছিল জরিপ। এবছর সেটা হয়েছে মাপ-ঝোক, হিসাব-নিকাশ।
যে কোন প্রজেক্টের সামনে গিয়ে বললেই হল- তোমার হিসাবটা দেখি তো? সঙ্গে সঙ্গে মোটা খাতা বের করে দেখানো শুরু।
জানি, আত্মতৃপ্তির কোন ব্যাপার নেই। কিন্তু শুকরিয়াতো আছে!
দুপুরের দিকে রেজাউর রহমান স্যার বলছিলেন – যে যাত্রাটা ঠিক পথেই আছে। কেবল গতি বাড়াতে হবে, যুক্ততা ছড়িয়ে দিতে হবে।
এই বছর খুলনার রূপসা থেকে ৬টি মেয়ে এসেছে। ওদের দুইটি গবেষণার পোস্টার নিয়ে। বলে না দিলে কেও বলতে পারতো না, ওরা মাত্র কয়েকমাস আগে বিজ্ঞান গবেষণা শব্দটা শিখেছে। রংপুরের হারাগাছ থেকেও একটি দল এসেছে।
আমার কাছে যদি জানতে চাও ওরা কেমন করেছে। আমি বলবো- অসাধারণ।
সারাদিন আবার অন্য আলাপও হয়েছে। বিশেষ করে একটি মোবাইল ল্যাবরেটরীর ব্যাপারে। জরিপ শেখানোর জন্য তো ল্যাবরেটরি লাগে না। কিন্তু মাপ-ঝোক শেখাতে হলে তো ল্যাবরেটির লাগবে।
একটি ট্র্যাংকের মধ্যে নানান যন্ত্রপাতি নিয়ে একটি মোবাইল ল্যাবরেটরি তৈরির একটি কাজ আমরা কয়েকদিনের মধ্যেই শুরু করবো। আমি জানি আল্লাহর রহমতে এই ল্যাবরেটরি আমরা অচিরেই চারু করে দিতে পারবো।
আমাদের এই মোবাইল ল্যাবের পাশাপাশি সরকারও কয়েকহাজার স্কুলে বিজ্ঞান ল্যাব তৈরি করে দেবেন। উদ্যোগ শুরু হয়েছে।
আমি যেখানেই যাই, সেখানেই এইচ এসবিসির ওয়ার্ল্ড এট ২০৫০ এর কথা বলি। যেখানে বলা হয়েছে ২০৫০ সালে বাংলাদেশ ইউরোপের সকল দেশকে অতিক্রম করে যাবে।
অনেকেই আমার কাছে জানতে চাই – এই জোর আমি কোথা থেকে পাই?
উত্তরটা সহজ। আমি আমার সামনে বসা গোল গোল চোখ করা ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকেই এই আত্মবিশ্বাসটা পাই।
বিজ্ঞানের জয় হোক।
সবার জীবন পাই-এর মত সুন্দর হোক।