বঞ্চিত আনন্দময় শৈশব
আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন স্কুলগুলো এসএসসি কিংবা বৃত্তি পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের আলাদা কোচিং করাতো। তবে, সেটা বাধ্যতামূলক ছিল না। অন্তত আমি করি নাই। আমার অবশ্য বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার ধান্ধা ছিল ভিন্ন। সে সময় যারা বৃত্তি পরীক্ষা দিত তাদের আর বার্ষিক পরীক্ষা দেওয়া লাগতো না!
দিনকাল এখন আর অত ভাল নাই। এখন প্রায় প্রথ্যেক ক্লাসে পারলে পাবলিক পরীক্ষা চালু হবে হবে ভাব। কাজেই শিশুদের শৈশবের বারোটা বেজে গেছে। আমাদের সহকর্মী পল্লব মোহাইমেনের মেয়ে এবার বিজ্ঞান ক্যাম্পে যায়নি, কারণ তার পিএসসি পরীক্ষা। বিডিআর স্কুলের আর এক ছেলে আন্তর্জাতিক ওয়াটার রকেট প্রতিযোগিতায় দেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। সেও যাবে না। কারণ জেএসসি পরীক্ষার পর তাকে আবার বার্ষিক পরীক্ষা দিতে হবে।
মনে হচ্ছে পরীক্ষাই জীবনের সব। পরীক্ষা আর জিপিএ ৫ ছাড়া জীবন সর্বতোভাবে ব্যর্থ।
দেশে ছিলাম না যখন তখন শিক্ষা নিয়ে বেশ কিছু লেখালেখি হৈচৈ হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় জিপিএ পাঁচ ওয়ালাদের ব্যর্থতা নিয়ে অনেকেই শিক্ষা ব্যবস্থাকে একহাত নিয়েছেন। সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীকেও। কিন্তু আমি আশ্চর্য হয়ে দেখলাম এই বিতর্ক থেকে শিক্ষামন্ত্রী নিয়েছেন হল – আমরা নাকি বলছি পাসের হার বেশি হলে শিক্ষার মান খারাপ হয়!!!
আশ্চর্য হল এমনটি কেও বলে নাই। পাসের হার বাড়ানোর জন্য শিক্ষামন্ত্রী গত পাঁচ বছরে অন্তত তিনটি কাজ করেছেন –
১. উনি খুজে বের করেছেন গ্রামের অনেক স্কুলে ইংরেজি ও গণিতে শিক্ষার্থীরা বেশি ফেল করে। ফলে, পাসের হার কম হয়।
২. এরপর তিনি প্রায় আট হাজার স্কুলে ইংরেজি এবং গণিতের বাড়তি ক্লাসের ব্যবস্থা করেছেন। স্কুল শেষে, ছুটির সময়ে এবং বন্ধে।
এই দুইটি উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসার দাবী রাখে। আর এর কারণেই কিন্ত পাসের হার বেড়েছে। বিশেষ করে গ্রামের দিকে।
তবে, তৃতীয় যে আন-অফিসিয়াল উদ্যোগের সবাই সমালোচনা করেছে সেটা হল পরীক্ষার খাতায় ঢালাও নম্বর দেওয়া। এটা নিয়ে তিনি কখনো কিছু বলেন না। স্বীকারও করেন না আবার অস্বীকারও করেন না।
শিক্ষা তর্কটা হয়তো এবার একটা জায়গায় যাবে।
আমি নিজে মনে করি দ্রুততার সঙ্গে পিএসসি আর জেএসসি পরীক্ষার মত দুইটি পাবলিক পরীক্ষা তুলে দেওয়া হোক। এইগুলো রাস্ট্রীয় অর্থের অপচয় এবং আমাদের শিশুদের আনন্দময় শৈশব থেকে বঞ্চিত করার উদ্যোগ মাত্র। এই নিয়ে আজকে একটা নিবন্ধ লিখেছি প্রথম আলোতে –পাবলিক পরীক্ষা : বঞ্চিত আনন্দময় শিক্ষা ও শৈশব । এই নিবন্ধে আমি লিখেছি ইচ্ছে করলেই কিন্তু আনন্দময় শিক্ষার ব্যবস্থা করাটা কঠিন না। মাস খানেক আগে আমরা আশুলিয়ায় একটি বিজ্ঞান ক্যাম্পের আয়োজন করেছিলাম। সেটার সমাপনী অনুষ্ঠানে ক্যাম্পে থাকা এক মা বলেছিলেন – ‘বাচ্চারা পড়তে চায় না। তাদের ধরে বেঁধে পড়ার টেবিলে নিতে হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে হয় টিভি বা কম্পিউটারের সামনে তাদের পাওয়া যায়। অথচ এখানে তারা নিজেরাই হাজির হয়ে যাচ্ছে ক্লাসে! অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকে কী জানি সব কাজ করছে। অথচ ঠিক ভোর সাড়ে ছয়টায় উঠে হাজির হয়ে যাচ্ছে পতাকার সামনে। বাসায় কত কষ্ট করে না তাদের ঘুম থেকে তুলতে হয়!’
তাঁর অবাক হওয়ার কারণ শিক্ষার্থীদের জন্য ওই ক্যাম্পটা তো আসলে পড়ালেখারই। কিন্তু তারা কেউ ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছে না। ২৪ তারিখে সেন্ট যোসেফ স্কুলের মাঠে কিশোর আলোর উদ্যোগে কিআনন্দ উৎসবে গিয়েও আমার মন খারাপ হয়েছে। কারণ সেখানে, এভারেস্ট একাডেমি ছাড়া, বাকী যে সব আয়োজন প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থীকে আনন্দ দিয়েছে তার কোনটিই কঠিন ব্যাপার ছিল না। বিজ্ঞান নিয়ে মাতামাতি, ওয়াটার রকেট ছুড়ে দেওয়া, ফ্ল্যাশ মব, যেমন খুশি সাজো, শখের দুনিয়া – সবই তো যে কোন স্কুল চাইলেই করতে পারে। কিন্তু স্কুলগুলো সেটা করতে পারে না। কারণ অহেতুক পাবলিক পরীক্ষার চাপ। স্যারদের পক্ষে অন্যকিছু ভাবাটা মুশ্কিল। আবার সেরকম কিছু করলে অভিভাবকরাও ভাবেন যে আরে পিএসসি জেএসসির কী হবে? এ এক ভয়নক চক্র।
আমি জানি আমার কথা কেও শুনবে না। তবে, আমি আমার চিল্লানো অব্যাহত রাখবো। অনন্ত নতুন প্রজন্মের কাছে তো পরিস্কার থাকবো।
জেএসসি পরীক্ষায় নাকি ২৯ সেট প্রশ্ন করা হবে যাতে প্রশ্ন আউট হতে না পারে। আইসিটি ব্যবহার করে প্রশ্ন সেদিনই ছাপা হবে। মানে কিনা আরো টাকার অপচয়। কিন্ত আখেরে কী লাভ হবে?
আনন্দময় শৈশব বঞ্চিত শিশু।
যতদিন আমরা আমাদের শিশুদের জন্য শিক্ষাকে আনন্দময় করতে পারবো না ততদিন একটা উন্নত জাতি হওয়ার স্বপ্ন আমাদের অধরাই থেকে যাবে।
সবার জীবন পাই-এর মত সুন্দর হোক।
শুভ সকাল।