জ্বালোরে জ্বালো …
চট্টগ্রাম কলেজে যখন পড়তে আসি তখন দেশের পরিস্থিতি অন্যরকম। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। আর তার দুইদিন আগে আমাদের মেট্টিকের লিখিত পরীক্ষা শেষ হয়। কাজে ১৯৮২ সালের জুলাই মাসের শেষদিকে যখন চট্টগ্রাম কলেজে ক্লাশ শুরু করি তখন দেশ এক বিশ্ববেহায়ার কবলে। আমরাও তার খোঁজ খবর করিনা যে তা নয়। তবে, আমাদের খোঁজ খবরের বড় অংশ জুড়ে থাকে কলেজের ঢোকার পর ডানদিকের রাস্তা দিয়ে শেষমাথার কমনরুমটি। ওই রাস্তা দিয়ে বেশি হাটাহাটি করা যায় না। করলে নাকি কপালে দু:খ আছে।
অন্যদিকে কো-এডুকেশন হলেও চট্টগ্রাম কলেজ এক অদ্ভুত জায়গা। এখানে ক্লাশের আগে ছাত্ররা ক্লাশে ঢুকলেও ছাত্রীরা ঠিকই বাইরে দাড়িয়ে থাকে। স্যার বা ম্যাডাম এসে ক্লাশে ঢুকলে তারপর ছাত্রীরা ক্লাশে ঢুকে। ওদের জন্য গ্যালারি বা ক্লাশরুমের সামনের দুই সারি বেঞ্চ খালি রাখা হয়। ক্লাশ শেষ হলে প্রথমে ছাত্রীরা ক্লাশ থেকে বের হয়। ওদের বেরোনো শেষ হলে শিক্ষক বের হোন। কাজে কোন কিছুতে কোন লাভ নাই। লাভের কিছু করতে হলে ক্লাশে পড়া পারতে হবে। মানে পড়ুয়া ছেলে হতে হবে। সে আমারে দিয়ে হবে না। আর না হয় যে সব স্যার ব্যাচে পড়ান সেখানে পড়তে হবে। এমনিতেই কলেজে অনেক সময় চলে যায়, তার ওপর ব্যাচে পড়তে অনেক সময় লাগবে। তাই আমি ঐ লাইনে হাটি না। কাজে আমার খুব একটা ভবিষ্যৎ নাই এটাই মেনে নিলাম। তার ওপর কলেজের মেয়েরা সবাই শাদা এপ্রোন পড়ে আসে। অনেকটা সিস্টার সিস্টার লাগে। এর মধ্যে একদিন কে জানি জানালো ওদের কমনরুমের সামনে মিছিল করে গেলে কেউ আপত্তি করে না। কাজে আমরা মিছিলের উপলক্ষ খুঁজতে থাকি।
কিন্তু সেরকম সুযোগ আসে না। কারণ রাজনীতির ওপর খড়গ ঝুলছে। এরশাদের সামরিক শাসন। এর মধ্যে একদিন শুনতে পেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা মিছিল হয়েছে এবং ১১ জানুয়ারি সচিবালয় ঘেরাও এর একটা কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে, আমাদের ক্যাম্পাসে সেরকম চাঞ্চল্য নাই। সেকন্ডে ইয়ারে আমার এক চাচা পড়তেন, বিপ্লবী তৌহিদ চাচা। তিনি মাঝে মধ্যে গাছের নিচে দাঁড় করিয়ে বিপ্লবের দীক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করতেন, কলেজ কেন্টিনে নিয়ে গিযে চা-সিঙ্গারা খাওয়াতেন। তবে, কখনোই সফল হতেন না। কারণ আমার মাথায় কেবল “ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথ”। অথবা কোন শাদা এপ্রোন।
তবে, একদিন হটাৎ করে শুনলাম এরশাদ আমাদের কলেজে আসবেন। বাস খালি শোনার অপেক্ষা। কিছুক্ষণের মধ্যে তৌহিদ ভাইদের নেতৃত্বে মিছিল শুরু। শ্লোগান দুইটা – জ্বালো, জ্বালো, আগুন জ্বালো। এরশাদ এলে আজ, আগুন জ্বলবে। আগুন কীভাবে জ্বলবে তাতো আর আমরা জানি না তবে জানি “এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়”।
তো, ক্লাশ পন্ড। ঘণ্টাখানেক ধরে কলেজের গেটে গেটে মিছিল (এখন ভাবি, চাইলে কি আমরা সেদিন এরশাদকে ঠেকাতে পারতাম?) টিছিল করে হয়রান হয়ে জানলাম এরশাদ আসবে না।
এভাবে চট্টগ্রাম কলেজে আমাদের সময় কেটে যায়। আমার বন্ধুদের সবাই খুব মেধাবী। তাদের সবার চেষ্টা পত্রিকার পাতায় নাম লেখানো। আমার এসব লক্ষ্য নাই খালি ফিজিক্স কেমিস্ট্রি ম্যাথ। আমি নোটের ধার ধারি না আর পড়ি বই-এর সব কাল কাল অংশ। কারণ বাদল ভাই বলে দিয়েছেন এইচএসসি নয় আমার টার্গেট বুয়েট। কাজে আমি দেখি আমাদের ক্লাশের একজন সেভেনটির পেছনে ঘোরে, একজন সেভেনটি ফাইভের পেছনে। আমাদের সঙ্গে আলাপ করে কেমন করে দৃষ্টি আকর্ষন করবে। আমি তখন বিশ্ব-ইতিহাস পড়ি (হায় রে বোকারে)। দুইটি মিয়ে একটি গাড়িতে চড়ে আসে। সেই গাড়ির নম্বর ৪২৩০। সেটা নিয়ে আমি একটা কবিতাও লিখে ফেললাম আলির অনুরোধে যার শেষ লাইন ছিল – বেয়াল্লিশ ত্রিশ হাঁকিয়ে চলে যাও তুমি, তুমি মেহেদীবাগের চিড়িয়া। গ্যালারিতে মেয়েদের বেঞ্ঝতো প্রথম দুইটাতে। কাজে যাদের আগ্রহ বেশি তারা বসতো তৃতীয় সারিতে। তৃতীয় আর দ্বিতিয় সারির মধ্যে চোখাচোখি আর ক্লাশ নোট তোলার নামেও অনেক কিছু আদান প্রদান। একদিন আমাদের এক বন্ধু আবিস্কার করলো দ্বিতীয় বেঞ্চের একজন তার খাতায় লিখেছে – কিস মি বাট, মিস মি নট! পরের কয়েকদিন আমাদের কেটে গেল হবু ডাক্তার কার উদ্দেশ্যে এই বাক্য লিখেছে!!!
এভাবে দেখতে দেখতে এসে পড়ে ১১ জানুয়ারি ১৯৮৩ সাল। তখন তো এতো টিভি চ্যানেল ছিল না। বিকেলে নানান জায়গায় খোঁজ নিয়ে জানার চেষ্টা করি ঢাকাতে কিছু হয়েছে কিনা। তবে, বড় কোন ঘটনা যে ঘটে নাই সেটা বুঝতে পারি। পরে জানতে পারি জিয়াউদ্দিন বাবলু পটকান খেয়েছে। গিয়ে এরশাদের দলে ভিড়েছে। ফলে, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্ল্যান ভেস্তে গেছে। তবে, নেতারা দ্রুত আবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারি নতুন তারিখ ঠিক করেছে। আমি কয়েকদিন ফলো করে তারপর ভুলে গেছি।
কিন্তু ঠিকই ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩ সাল এসে পড়লো। তার আগের দিন ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে জাফর-জয়নাল-আর দীপালী সাহার রক্তে। (১৪ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ের সামনে পাখির মতো ছাত্রদের গুলি করে মারার প্ল্যানটা নাকি করেছিলেন এরশাদের তখনকার সহযোগী এক জেনারেল। এই জেনারেলের ছেলে আমাদের সঙ্গে বুয়েটে পড়েছে)।আমরা যখন কলেজে পৌছাই তখনই জেনে গেছি আজ চট্টগ্রাম শহীদ মিনারে জমায়েত হবে। এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মিছিলগুলো ট্রেনে করে শহরে পৌছে গেছে। আমরা অপেক্ষা করছি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মিছিলের জন্য। সকাল ১০টার দিকে চট্টগ্রাম কলেজে এসে পৌছালো মেডিকেল কলেজের মিছিল। আমি কেবল বাপ্পীদাকে চিনি। তার হাতে এক বিরাট চ্যালাকাঠ। আমাকে দেখে বললেন- ঝাটপট মিছিলে ঢুকে পড়তে। মেডিকেলের মিছিলটা আমাদের কলেজে পুরোটা ঢোকার আগেই কলেজের মিছিলটা গেটে এসে পড়লো। মুহুর্তের মধ্যে মিছিল পরিণত হলো জনসমুদ্রে।
কলেজের সামনে একটু দাড়িয়ে মিছিলটাকে সংহত করা হল। আমাদের লক্ষ্য শহীদ মিনার।
জ্বালোরে জ্বালো আগুন জ্বালো
খুনী এরশাদের গদিতে আগুন জ্বালো একসাথে।
মিছিল নিয়ে আমরা গণি বেকারির মোড়ে পৌছালাম। মিছিল ডানদিক দিয়ে জামালখান রোডের দিকে আগাবে। মিছিলের কিছু অংশ ডানে মোড় নিয়ে নিয়েছে। আমাদের একটা বড় অংশ তখনো কাজেম আলি স্কুলের সামনে।
তখনই আমি জীবনের প্রথম পুলিশের একশন দেখলাম। পুলিশ আমরা দেখেছি সকাল থেকে মিছিলের আগে আগে ছিল। মিছিল যখন ডানে মোড় নেয় তখন পুলিশের গাড়িটা সোজা গুডস হিলের দিকে এগিয়ে দাড়ায়। মেডিকেল অংশটা মোড় ক্রস করার সঙ্গে হুইসল বাজিয়ে পুলিশের একদল লাঠি নিয়ে আমাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়লো। ঐ মিছিলে বেশিরভাগই জীবনে প্রথম পুলিশের তাড়া খাচ্ছে। আমার পাশে যে ছিল সে আমারে বললো – দৌড়াও। আমিও দিলাম দৌড়।
কাজেম আলি স্কুলের পাশের গলি দিয়ে ভিতরে দৌড় দিলাম আমরা কয়েক জন। খালি দেখলাম কয়েকজন পুলিশ লাঠি হাতে আমাদের পিছু নিয়েছে। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বড় নালার পাড়ে এসে পৌছালাম। কোনো দিকে না তাকিয়ে লাফ দিয়ে নালা পার হয়ে এক বড় দেয়ালে কেমনে উঠলাম কে জানে। লাভ দিয়ে পড়ে ভৌ দৌড়। ততক্ষণে আমার বিপ্লবের আকাঙ্খা শেষ।