শুনতে পাচ্ছো তো?
এই ৭০০ কোটি দেশের পৃথিবী নামক গ্রহটির নানান ব্যারাম। উত্তরের দেশগুলো নানানভাবে দক্ষিণের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে। আগামীতেও হয়তো করবে। তবে, মজার ব্যাপার হল উত্তরের দেশগুলোকে নানান ভাবে দক্ষিণের দেশগুলোর ওপরই নির্ভর করতে হয়। সেটা তাদের জন্য মেধা পাওয়ার বিষয় হোক কিংবা তাদের অস্ত্র বেঁচা হোক। সে কারনে নানানভাবে উত্তরের দেশগুলো আমাদের ওপর ছড়ি ঘোরানোর চেষ্টা করবে।
অন্যদিকে আমাদেরকেও চেষ্টা করতে হবে উঠে দাড়ানোর। প্রিয়তমার জন্য অভিবাদন যোগাড়ের কাজে।
অনেকেই হয়তো ভাবে আরে বাংলাদেশে পড়ালেখা ঠিকমত না হলে উত্তরের দেশগুলোর এত মাথা ব্যথা হয় কেন? কেন তারা গাঁদা টাকা খরচ করতে চায় আমাদের পড়ালেখার জন্য? কেন আমাদের ছেলেমেয়েদের ওরা স্কলারশীপ দেয়?
কারণ এখন বিশ্বটা একটা বৈশ্বিক গ্রামে পরিণত হয়েছে। মনে আছে আমাদের ইকবাল কাদিরের সেই বিখ্যাত বাণী- Connectivity is productivity – সংযুক্তিই উৎপাদনশীলতা। সংযোগ এখন দ্বিমূখী ছুরি। এর এক ধার দরকার নিজের মান উন্নয়নে – কত কিছু আছে ইন্টারনেটে – বই, পড়া, নোট, হোম ওয়ার্ক, ভিডিও কত কী। একটা তালিকাও তুমি করে নিতে পারো।
অন্যদিকে এটি দেয় ভুরঙ্গামারিতে থেকে, ফ্রেশ বাতাস খেয়ে নরওয়েতে চাকরি করার সুযোগ।
প্রতিদিন যখনই পিসিতে বসি তখনই শুনতে পাই ইন্টারনেট আর জ্ঞানের জগৎ ডাক পাড়ে-
আয় আয় আয় জ্ঞানের দুনিয়ায়। আয় আয় আয় কাজের দুনিয়ায়।
কত সুযোগ, কত উদ্যম কত সম্ভাবনা। ৭০০ কোটি লোক, ৭০০ কোটি সম্ভাবনা।
কেবল আইটি আউটসোর্সের বাজার ৫০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি, গত কয়েক বছরে রেমিট্যান্সের বাজার বেড়ে হয়েছে দ্বিগুন। ২০২০ সালে লাখ লাখ প্রোগ্রামারের সন্ধানে হন্যে হয়ে মরবে উত্তরের দেশগুলো। ২০২৩ সালে আমাদেরই বছরে ১ লাখ ম্যানেজার লাগবে!!!
আর গত ১০ বছরে এই বাংলাদেশেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বেড়েছে শতকরা ৫০ভাগ। কিন্তু?
কিন্তু কোথায় যেন তাল কেটে যাচ্ছে। দেশের ৪৭% গ্র্যাজুয়েট চাকরি পাচ্ছে না। চাকরিদাতারা বলছেন তারা যোগ্য নন। তারা চাকরির জন্য লোক খুঁজে আনছেন ভারত, শ্রীলংকা, চিন, ফিলিপিন থেকে। সেই লোকগুলো হাজার হাজার কোটি টাকা আমাদের দেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে। আর আমার যুবারা দরখাস্ত লিখছে, প্রতি বৃহস্পতিবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছে – কর্মপরীক্ষা দেবে বলে।
এদের অনেকই চাইলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বছরগুলোকে আরো সুন্দর করে কাজে লাগাতে পারতো, নিজেকে তৈরি করতে পারতো নানান যোগ্যতা ও দক্ষতায়। কিন্তু তখন সময় হয়নি কারণ ক্লাস শেষ না করেই চলে যেতে হয়েছে আড্ডায়, ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে গেছে কেন্টিনে, লাইব্রেরিটা কোথায় সে খবর নেওয়া হয়নি, ইন্টারনেটে সময় কেটেছ কেবল ফেসবুকে।
নেত্রকোণা আর ময়মনসিংহ থেকে ঘুরে এসেছি কাল পরশু। তার আগে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া আর রাজশাহী। এই মাত্র ৩০ দিনের মধ্যে। সব জায়গাতে দেখছি তারুন্যের এক বড় অপচয়। সময় চলে যাচ্ছে, কিন্তু খেয়াল করছে না। আনন্দ মোহন কলেজে মাত্র ১১ দিন ক্লাশ হওয়ার পরই নাকি পরীক্ষা হচ্ছে। বাকী সময়টা নিজেদেরই পড়ার কথা। নিজেকে তৈরি করার কথা। কিন্তু সেটা হয়নি। নিজের সিভি বানানো হয়নি। ভেবেছে পাশ করে নেই, তারপর একটা সিভি লিখে নেবো!
পলিটেকনিকের একদল ছেলেমেয়ের সঙ্গে দেখা হল সেলিমের দোকানে। পাশ করার পর উপলব্ধি হয়েছে অনেক কিছু শেখা হয়নি। এখন সেলিমের কাছে এসেছে উত্তরণের জন্য। বেচারা সেলিম কতোজনকেই বা সাপোর্ট দিবে। সারাদিন ছাত্র পড়িয়ে যে টাকা সেলিম পায় তার সবই চলে যায় তরুনদের ডাক শোনাতে, তাদেরকে আগামী দিনের জন্য তৈরি করে দিতে।
ক্লাশ হয় না বলে জীবন থেমে থাকবে, কেটে যাবে শুধু আড্ডায়?
এই তো সেদিন চমক হাসান এসেছিল আমাদের টকসে। বলে গেছে কুষ্টিয়া কলেজে পড়ার সময় ক্লাশ হয়নি বলে নিজের মতো করে জগৎ গড়ে নিতে পেরেছে। পেরেছে বলেই না তাঁর চকমকি আমরা এখন দেখছি। তাহলে?
প্রায় ২০ লক্ষ ছেলে-মেয়ে পড়ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। নিরুত্তাপ, হতাশার আবর্তে মনে হয় ঘুরপাক খাচ্ছে। জানতে চাইলে বলে – আমাদের কথা কেও ভাবে না। আমরা কই যাবো?
কই যাবা মানে। নিজের রাস্তা নিজে বানিয়ে নেবা। আমি কেবল তথ্য প্রযুক্তিখাতে বাংলাদেশের সফল ১০০ জনের তালিকা বানাতে পারবো যার কমপক্ষে ২৭ জন হবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। বুয়েট, ঢাবি না পড়লে তোমার জীবন ব্যর্থ নয়। বুয়েট, ঢাবি থেকে জীবন অনেক বড়। কাজে হাল ছাড়া যাবে না।
অন্যদের মতো সময় নষ্ট করো না। তাহলে কালের ডাক শুনতে পাবে না।
পরে সেটা পুষিয়ে নেবার চেষ্টা। রাত জেগে মোটা মোটা কারেন্ট এফ্যেয়ার্স আর প্রফেসরস গাইড পড়ার চেষ্টা। একজনকে দেখলাম বিশ্বের প্রায় সব ধ্রুপদী বই-এর নাম আর তার লেখকের নাম জানে। খুশী হয়ে জানতে চাইলাম – সব নিশ্চয়ই পড়া হয়েছে।
– না, স্যার। প্রিলিতে তো লেখকের নাম আসে তাই মুখস্ত করে ফেলেছি। একটিও আমি পড়ি নাই!
আমার মুখে কথা সরে না। এভাবে কী হবে? তাই কি হয় কখনো? সবাই কি পারে অসময়ের নয় ফোঁড়কে সময়ের এক ফোঁড়ে পরিণত করতে?
কিন্তু, তোমরা যারা এখন বিশ্ববিদ্যালয় দাপিয়ে বেড়াচ্ছো? তোমরা কি শুনতে পাচ্ছো কালের ডাক? ডারউইনের সেই আপ্ত বাক্য – যোগ্যরাই টিকে থাকে?
শুনতে কি পাচ্ছো ৭০০ কোটি মানুষের পৃথিবী তোমার দক্ষতা, যোগ্যতা এবং ভালবাসার জন্য অপেক্ষা করে আছে?
নানান প্রান্তের মানুষ বসে আছে তোমার নেতৃত্বের জন্য, তোমার উদ্ভাবনের জন্য এবং তোমার ডাকের জন্য?
কান পাতো, নিজের অন্তরের ডাক শোনো।
ঝাপিড়ে পড়। বিশ্ব তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
শুনতে পাচ্ছো তো?
One Reply to “শুনতে পাচ্ছো তো?”
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.
সুন্দর লেখা, স্যার! ঠিক আমার মনের কথাগুলোই বলেছেন। চারদিকে শুধু তারুণ্যের অপচয়! শক্তির অপচয়! মেধার অপচয়! চিন্তা-শক্তির অপচয়! প্রচুর উদাহরণ দিতে পারবো চারপাশ থেকে। শুধু যে তরুণরা অপচয় করছে তা কিন্তু নয়। অপচয় করছে স্কুল/কলেজের/মাদ্রাসার শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক/প্রিন্সিপল, বেকার/চাকুরে সবাই। রাস্তায় বেরুলেই পরিচিত ছাত্র/শিক্ষক/প্রিন্সিপল/সাধারণ লোক সবাই জায়গায়-অজায়গায় আড্ডা দিচ্ছে। আড্ডার বিষয়বস্তু পরচর্চা, স্থুল বাতচিত। কী হবে আমাদের?