বিপ্লব মোকাবেলার বাজেট

Spread the love

বিপ্লব আসতেছে। বাঁচার উপায় নেই। হয় মরতে হবে নতুবা বিপ্লবের ঘোড়ার ওপর চেপে বসতে হবে। এই বিপ্লবের একটা সুন্দর নামও আছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব, ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভোলিউশন। আর অন্য তিন বিপ্লবের মতো এটি কোন স্থানীয় ঘটনা হবে না, এই বিপ্লব কোন না কোনোভাবে প্রভাব ফেলবে পৃথিবীর সাতশ পঞ্চাশ কোটি মানুষকে।

ওয়াল্ড ইকোনোমিক ফোরামের চেয়ারম্যানসহ আরও অনেক চিন্তাবিদ মনে করেন এই বিপ্লব এরই মধ্যে তার ক্যারিশমা দেখাতে শুরু করেছে। এই বিপ্লবের প্রচ্ছদপট কিন্তু নানা রকমের। এক মাত্রায় এটিকে চেনা যাবে না। কারণ এর প্রধান উপকরণ হচ্ছে ডিজিটাল প্রযুক্তি। কেমন করে সেটি এরই মধ্যে আমাদের দৈনন্দিন কাজেরই অংশ হয়ে গেছে। আর এই ইন্টারনেট প্রযুক্তি ক্রমাগতভাবে আমাদের বেঁধে ফেলছে আষ্ঠেপৃষ্ঠে।
সেদিন এক বন্ধু আমাকে বললো- আচ্ছা, আগে আমরা কীভাবে গুগল ম্যাপ ছাড়া চলতাম?

ভাবুন, আমার বন্ধুটি আমেরিকা-ইউরোপে থাকে না, এই ঢাকা শহরেই তার বাস।
ব্যক্তিগত কয়েকটা গাড়ি আছে এমন এক ব্যক্তিও কাল বললেন- এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় ফেরার সময় তিনি উবারের রাইড শেয়ারিং ব্যবহার করেন, বাসার গাড়িতে ফেরেন না। কেন?
-কারণ এটি সাশ্রয়ী।
অন্যদিকে এ শহরেও অনেকে কেবল পাঠাও-উবারে ব্যবহারের জন্য দিয়ে দেবেন এই জন্য মোটর সাইকেল আর গাড়ি কিনতে শুরু করেছেন। আগে যে গাড়িগুলো গৃহকর্তাকে অফিসে নামিয়ে দিয়ে অফিস পার্কিং-এ বসে থাকতো বা বাসায় গিয়ে অপেক্ষা করতো সেটি কিন্তু এখন আর সে কাজটি করছে না। পার্কিং লটে না যেয়ে নেমে আসছে রাস্তায়। অপেক্ষা একটি “রিকোয়েস্টের”। ফলে, ঢাকা শহরে, কেবল উবার/পাঠাও-এর জন্য ২০ শতাংশ গাড়ি/মোটরসাইকেলের চলাচল বেড়ে গেছে। নতুনের সংখ্যার কথা বাদ দিলাম!
এসবই এক নতুন বিপ্লবের সূচনা। যে বিপ্লবের একটি বড় সাফল্য হলো কেবল বায়বীয় আইডিয়া বাস্তবায়নে সম্পদ সৃষ্টি করা। সিলিকন ভ্যালির উত্থানের আগে আমেরিকার ভারিশিল্পের কেন্দ্র (পৃথিবীরও) ছিল ডেট্রয়েট নগরী। ১৯৯০ সালে শীর্ষ তিন ডেট্রয়েট কোম্পানির বাজার মূলধন ছিল ৩ হাজার ৬০০ কোটি ডলার, রাজস্ব ছিল ২৫ হাজার কোটি  ডলার এবং কর্মী ছিল ১২ লক্ষ! আর ২০১৪ সালে সিলিকন ভ্যালির শীর্ষ তিন কোম্পানির বাজার মূলধন ১ লক্ষ ৯ হাজার কোটি ডলার, রাজস্ব প্রায় কাছাকাছি ২৪ হাজার সাত শত কোটি ডলার। কিন্তু কর্মীর সংখ্যা ১০ ভাগের এক ভাগ, মাত্র ১ লক্ষ ৩৭ হাজার!  (সূত্র – ফোর্থ ইন্ডাসট্রিয়াল রিভোলিউশন, ক্লাউস শোয়েব, ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম)২০১৮ সালের প্রথম তিনমাস শেষে সিলিকন ভ্যালির তিন শীর্ষ কোম্পানির  বাজার মূলধন দ্বিগুন হয়ে দুই লক্ষ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে কিন্তু তাদের কর্মী সংখ্যা কিন্তু দ্বিগুন হয়নি। মাত্র কয়েক বছর আগে ৫৫ জন কর্মীর তৈরি করা ‘হোয়াটসএপ‘ নামের একটি যোগাযোগ সফটওয়্যার ফেসবুক কিনে নিয়েছিল এক হাজার নয়শত কোটি ডলারে!

এসবের একটাই মানে। এখন আগের তুলনায় কম লোক দিয়ে সমপরিমাণ সম্পদ সৃষ্টি করা যায়। এমন দিনে  আমাদের মতো জনববহুল দেশগুলোর ভাগ্যে কী হবে?

আমাজন নামে বিশ্বের অন্যতম অনলাইন শপ তাদের একটি গুদাম মেইনটেইন করে চীনে। সেখানে কয়েকজন মানবকর্মীকে অর্ডার অনুসারে মালামাল শেলফ থেকে নামানের কাজে সহায়তা করে ৩০০টি রোবট! আমরা এক সময় গর্ব করতাম প্যান্টের পকেট শেলাই করা বা বেল্টের লুপ লাগানোর কাজটা যন্ত্র দিয়ে করা যাবে না। মানুষ লাগবেই। এখন আর গলার সেই জোর নেই। গার্মেন্টসের অনেক কাজই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন রোবটরা করে ফেলবে। আর যদি পুরোটা করে ফেলতে পারে তাহলে গার্মেন্টস বিল্পব কিন্তু আর বাংলাদেশে হবে না। পরের গার্মেন্টসগুলো হবে ডেট্রয়েটে বা বুদাপেস্টে। নিজেদের কাপড় নিজেরাই তারা বানিয়ে ফেলবে, আমাদের চেয়ে অনেক সস্তায়!
আমাদের আইটির আর একটি বড় কর্মমূখর সেক্টর হলো কল-সেন্টার। রোবট যখন ফোনে আপনার কথার উত্তর দিয়ে দেবে তখন এই সেন্টারগুলোর কী হবে?  আপনার পকেটের স্মার্ট ফোনটি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আপনার ব্যাংকের পাসবই থেকে শুরু করে দরজা খোলার চাবি হয়ে উঠবে। একবার ভাবুনতো ফোন দিয়ে যদি আপনি বাসার দরজা খোলার অভ্যাস করতে পারেন তাহলে সেটি কাজ না করলে আপনি কার শরনাপণ্ন হবেন। আপিন কি তখন ঢাকার নিউমার্কেট বা কারওরানবাজারে যারা তালা-চাবি বানায় তাদের কাছে যাবেন নাকি খোঁজ করবেন কম্পিউটার প্রোগ্রামের যারা আপনার ঐ এপটি ঠিক করে দিতে পারবে?

এই ডিজিটাল যুগের কারণে ডেপ্রিসিয়েশনের ব্যাপারটাও নতুন সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত হবে।  আপনার গাড়ি. বাসার ফ্রিজ এমনকী ওয়াশিং মেশিনের সফটওয়্যার ক্রমাগত আপডেট হয়ে যাবে। ফলে, বছর শেষে এটির কার্যক্ষমতা না কমে বরং বেড়ে যাবে। উৎপাদন লাইনে এর প্রভাবটা ভাবুন।

এমন একটা বাস্তবতায় আমরা ভাবছি আগামী ২৩ বছরে আমাদের সব লোকের দক্ষতা গড়ে ১০ গুণ বেড়ে যাবে। আর আমরা প্রবেশ করবো উন্নত দেশের কাতারে। কিন্তু গত এক দশকে আমাদের মাথাপিছু আয় আর প্রবৃদ্ধি বাড়া স্বত্ত্বেও এই দেশের কর্মক্ষম লোকের এক বিরাট অংশের কোনো কাজ নেই।  সকল হিসাব বলছে শিক্ষিত স্নাতকদের ৪৭% বেকার থাকে, একটি মাত্র পদের বিপরীত দুই হাজারের বেশি আবেদনকারী নির্ঘুম রাত কাটায়!

এমন বাস্তবতায় আগামীকাল ৭ তারিখে অর্থমন্ত্রী তার চলতি সময়কালের শেষ বাজেট জাতীয় সংসদে উত্থাপন করবেন। উদ্যমী, চ্যালেঞ্চ নিতে চায় এমন অর্ধেক জনগোষ্ঠীর সেখানে কী কী থাকবে? ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত ৬৩ শতাংশ তরুণ কী সেখানে নতুন আশার আলো পাবে?

চতুর্থ বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে সত্যিকারের উন্নয়নের পথে অভিযাত্রার কোন কোন নির্দেশনা এবারের বাজেটে দেখতে পাবো তা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি।

দেখা যাক আমাদের তরুণদের জন্য অর্থমন্ত্রী কী নিয়ে বসে আছেন?

 

 

Leave a Reply