আমার বধুয়া আনবাড়ি যায়, আমার আঙ্গিনা দিয়া
বাংলাদেশ থেকে ভারতে ব্যান্ডউইথ রপ্তানির প্রায় সব আনুষ্ঠানিকতা নাকি সম্পন্ন হয়েছে। আগস্ট মাস থেকেই সেটি কার্যকর হবে বলে জানা গেছে। পত্রিকান্তরে জানা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যান্ডউইথের পরিমাণ ২৫০ গিগাবাইট। এর মধ্যে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেব্ল কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিসিএল) রয়েছে ২০০ গিগাবাইট। আর ইন্টারন্যাশনাল টেরিস্ট্রিয়াল কেব্ল (আইটিসি) অপারেটরসহ অন্যদের রয়েছে ৫০ গিগাবাইট।মোট ২৫০ গিগাবাইটের মধ্যে এখন পর্যন্ত দেশে ব্যবহৃত হয় মাত্র ৪২ গিগাবাইট। বাকি ২০৮ গিগাবাইট পুরোটাই অব্যবহৃত থেকে যায়।অনেকের ধারণা, আগামী কয়েক বছরে এই পুরো ২৫০ গিগাবাইট দেশের মধ্যে ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। কাজেই রপ্তানি করাটা দোষের নয়।
তবে মুশকিল হচ্ছে, আমাদের চাহিদা আসলে কতটুকু, সেটা কি আমরা জানি? আমরা কি মোবাইলের বিকাশের ব্যাপারটি কোনো গণনায় পেয়েছিলাম? কিন্তু সাধারণের নাগালে আসার পরপরই দেশে মোবাইলের ব্যবহার দ্রুত বেড়েছে। কাজেই ব্রডব্যান্ড সাধারণ মানুষের নাগালে চলে এলে সেটির ব্যবহার যে দ্রুত বাড়বে না, সেটা কি কেউ হলফ করে বলতে পারে?
ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট এখন বিশ্বজুড়ে মৌলিক অধিকারের পর্যায়ে চলে গেছে। এর অন্যতম কারণ হলো এর বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও দিন বদলের শক্তি। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি হাজার নতুন সংযোগের ফলে আটটি নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হয়। ফলে কর্মসংস্থান বাড়ে এবং মানুষের জীবনমানও বাড়ে।আবার তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের প্রভাবে শিক্ষাক্ষেত্রেও একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে।এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মুক্ত দর্শনের বিকাশ।ফলে বাংলাদেশের একজন শিক্ষার্থী ইচ্ছে করলেই (এবং ব্র্যডব্যান্ডে প্রবেশাধিকার থাকলে) বিশ্বের বিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্সে অংশ নিতে পারে। এমআইটি, স্ট্যানফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষা কার্যক্রমকে ইন্টারনেটে উন্মুক্ত করছে।
অন্যদিকে, ইন্টারনেটের কারণে উন্নত বিশ্বের অনেক কাজ এখন আমাদের মতো দেশের তরুণ-তরুণীরা ঘরে বসেই করতে পারে। একটি বড় পারিবারিক করপোরেট প্রতিষ্ঠান বিগত ৫০-৬০ বছরে প্রায় ৫০ হাজার পরিবারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। অথচ ইন্টারনেটে স্বাধীন ব্যবসার মাধ্যমে মাত্র পাঁচ বছরেই প্রায় ৩০ হাজার ছেলেমেয়ে নিজেদের আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করতে পেরেছে। এর বাইরেও গড়ে উঠছে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক শিল্প, যা গত বছর ১০ কোটি ডলারের রপ্তানি করেছে বলে দেশের সফটওয়্যার ব্যবসায়ীদের সংগঠন জানিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ১৯৯৮ সালে মোবাইল ফোনের একচেটিয়া কার্যক্রম ভেঙে দেওয়ার পর থেকে দেশের প্রবৃদ্ধি, বিদেশি বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে মোবাইল ফোনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পটি জ্ঞানভিত্তিক কার্যক্রম বলে এর প্রকৃত মূল্যায়ন করা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর ২০ বিলিয়ন ডলারের একটা রিজার্ভ গড়ে তুলতে আমাদের প্রায় ৪২ বছর লেগেছে। অথচ কয়েক দিন আগে হোয়াটস আপ নামে একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ১৯ বিলিয়ন ডলারে বেচাকেনা হয়েছে। ‘অ্যাংরি বার্ড’ নামের একটি গেমস বিক্রি হয়েছে মাত্র ৮০ মিলিয়ন ডলারে! তার মানে হলো, তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ও উদ্ভাবনী ব্যবহার বাড়াতে পারলে জাতীয় আয় বৃদ্ধির যে স্বপ্ন আমরা দেখি, তার পথে এগোনোর একটা সুরাহা হয়।
আর এ কারণেই দরকার সারা দেশে ব্রডব্যান্ডকে ছড়িয়ে দেওয়া। আমরা আগে শুনেছিলাম, ব্যান্ডউইথের উচ্চমূল্যের কারণে এটি সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু সরকারের নানা চেষ্টায় ২০০৬ সালে যে ব্যান্ডউইথের দাম ছিল ৮৪ হাজার টাকা, সেটি এখন নেমে এসেছে মাত্র দুই-তিন হাজার টাকায়। অথচ তার পরও রাজধানীর বাইরে বলতে গেলে ব্র্যডব্যান্ড সেবার কোনো প্রসার নেই। সম্বল বলতে মোবাইল অপারেটরদের উচ্চমূল্যের দুর্বল সেবা এবং কোথাও কোথাও ওয়াইম্যাক্সের সেবা। সত্যিকারের ব্রডব্যান্ড বিকাশের জন্য দরকার ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি। আশ্চর্য হলেও সত্য যে বাংলাদেশের প্রায় সবখানেই এখন ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক পৌঁছে গেছে। কেবল ‘শেষ মাইল সংযোগ’ বা ব্যবহারকারীর কাছে সংযোগ পৌঁছানোর সমাধান করতে পারলেই সবখানে ব্রডব্যান্ডকে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হতো।
যেসব বাণিজ্যিক সংস্থা ব্রডব্যান্ডকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করছে, তাদের বক্তব্য হলো, অবকাঠামোগত সুবিধা তৈরি করে একটি জেলা বা উপজেলা শহরে ব্রডব্যান্ড সেবা চালু করে সেটি বাণিজ্যকভাবে লাভজনক করার মতো পর্যাপ্ত গ্রাহক সেখানে নেই। গ্রাহক তৈরি হলেই কেবল এই সেবা সম্প্রসারণ করা সম্ভব। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোতে দেখা যায়, দেশের আনাচে–কানাচে তরুণ-তরুণীরা ব্রডব্যান্ডের আশায় চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করছে।
এ ক্ষেত্রে সরকারকেই একটি বড় উদ্যোগ নিতে হবে। একটি দুই বছর মেয়াদি উদ্যোগ হতে পারে, দেশের সব জেলা ও উপজেলা সদরে অন্তত ৫০০ থেকে ৬০০ বিনা তারের ও বিনা মূল্যের ব্রডব্যান্ড সেবা চালু করা। সরকারের কাজ হবে এই সেবাগুলো চালু করে সেখানে দুই বছরের জন্য ব্যান্ডউইথ ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ দেওয়া। তবে এই সেবাগুলো নামকাওয়াস্তে চালু করলে হবে না। কমপক্ষে সেকেন্ডে ১০ মেগাবিট ব্যান্ডউইথের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই এই সেবা চালু রাখার জন্য তা স্থানীয় উদ্যোক্তাদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। পরবর্তী সময়ে তারাই এটি চালু রাখবে। অন্যদিকে, এই কার্যক্রমের ফলে প্রতিটি স্থানে ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। ফলে ইন্টারনেট সেবাদানকারী সংস্থাও বাণিজ্যিকভাবে সেবা দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই কার্যক্রম সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয় অর্থের জন্য সরকারকে কোনো দাতা সংস্থার কাছে হাত পাততে হবে না।
দেশের মোবাইল ফোন সেবা প্রদানকারী অপারেটররা ইউনিভার্সাল সার্ভিস অবলিগেটরি ফান্ডে প্রতিদিন প্রায় কোটি টাকার মতো জমা দেন। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) এই টাকা নিয়ে বসে আছে। গত দুই বছরের এই
খাতে কমপক্ষে কয়েক শ কোটি টাকা জমা হয়েছে, কিন্তু কোনো টাকা খরচ হয়নি। এই টাকা থেকেই সারা দেশের এই হট স্পটগুলো তৈরি করে ফেলা সম্ভব। পাবলিক স্পটের পাশাপাশি সব বিশ্ববিদ্যালয় ও বড় কলেজগুলোতেও এই বিনা মূল্যের ব্রডব্যান্ড সেবা সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন।
কাজেই রপ্তানিযোগ্য হলে রপ্তানি করা হোক, তবে তার আগে দেশের সবখানে সাধারণের নাগালমূল্যে ব্রডব্যান্ড ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগটা আমরা দেখতে চাই।