বইমেলার বই -৪ : মহাজাগতিক সুর লহরী
আজ অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপচারিতায় বলছিলাম আমার নানান এক্সপেরিমেন্টের কথা। দুনিয়াতে হেন কোন কাজ নাই আমি করার চেষ্টা করি নাই। মাথার নিচে ইট দিয়ে খালি মেঝেতে ঘুমানো থেকে শুরু করে হারমোনিয়াম বাজিযে গান (না কি চিৎকার) বা গিটার বাজানো কিংবা হারমোনিকা। কী নয়।
তবে, বাসায় আসার পর মোস্তফা তানিমের রিংটোন এবং রং নাম্বার পড়তে গিয়ে মনে পড়লো, আরে আমার প্রকাশক হওয়ার কথা তো বলা হয়নি! মোস্তফা তানিম আর আমি একই সময়ে বুয়েটে পড়েছি। ও কেমিক্যাল আর আমি ইলেকট্রিক্যাল। দুজনই আউল্লাহ মানে আহসানউল্লাহ হলের। আর হলে ওঠার পর প্রথম যে ১০ জনের সঙ্গে আমার খাতির হয় তাদেরই একজন মোস্তফা। এসব কথার অনেককিছু আমি আমিার পড়ো পড়ো পড়ো বইতে লিখেছি।
তো, ও যখন বুয়েটে আসে ততোদিনে ওর বেশ ক’টা গল্প দৈনিক ইত্তেফাকের কচিকাঁচার পাতায় ছাপা হয়েছে। এটা জানার পর আমার প্রথম উপলব্ধি হলো “আমি একজন সত্যিকারের লেখকের” সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেছি!
তো, মোস্তফা ঠিক করলো তার গল্পগুলো নিয়ে একটি বই বের করবে। কিন্তু প্রকাশক পাবে কই। তখন তো রনির তাম্রলিপি বা মাহবুবের আদর্শ ছিল না। তখন আমি ঠিক করলাম আমিই হবো প্রকাশক। বেশ। ছাপবো কই।
আমার মনে পড়লো আমার এক আপার আস্ত একটা প্রেস আছে, আরজত পাড়ায়। প্রেসের নাম অন্যধারা মুদ্রণালয়। ব্যাস আমি পেয়ে গেলাম আমার প্রকাশনার নাম। নাম দিলাম অন্যধারা প্রকাশনী। আর সেখান থেকে প্রকাশ হলো মোস্তফা তানিমের প্রথম গল্পগ্রন্থ “ম্যাকগাইভার মামা”। বইটার বেশিরভাগ আমরা বইমেলাতেই বিক্রি করে ফেললাম। অন্য অনেক কাজের মতো একটা বই বের করেই আমার প্রকাশক জীবনের ইতি হলো।
তো, এবার একদিন ফেসবুকে মোস্তফা জানালো তার নতুন সায়েন্স ফিকশন প্রকাশ হবে মেলায়। ফেসবুকে প্রচ্ছদও দেখলাম। ভাবলাম কিনতে হবে। তবে, মোস্তফার প্রকাশক বেশ তৎপর সে আমাকে একটা লেখক কপি পৌছে দিয়ে গেল।
সায়েন্স ফিকশনের একটা জটিল আবহ আছে। সেখানে থাকে রোবট। ঘটনা হয় বেতাল্লিশ শালের। সেখানে চতুর্থ মাত্রার রোবটরা সব থাকে। তারা মানুষের ওপর ছড়ি ঘোড়াতে থাকে। মানুষগুলো হয় দাস টাইপের। ওদের মাথা বন্ধক থাকে কেন্দ্রীয় কম্পিউটারের সঙ্গে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু রিংটোন পড়তে গিয়ে দেখলাম আরে এ তো পুস্পিতার গল্প। ওই যে পুস্পিতা, আমাদের পাশে যে বড় ফ্ল্যাটবাড়িটা হয়েছে সেটাতে থাকে। ওর বাবা-মাকে আমি চিনতাম। পুস্পিতা আমাদের বিজ্ঞান কংগ্রেস ভলান্টিয়ারও ছিল। কিন্তু ছ্যাকা খেয়ে ও অসুস্থ হয়ে যায়। আর ওর বাবা-মাও মারা যায়। মেয়েটা একা একা থাকে দেখে উপদেশ দেওয়ার অনেক লোকের আবির্ভাব হয়। আমিও দীর্ঘদিন খোঁজ খবর করতে পারিনি।
তো, পুস্পিতার ঝামেলা হলো সে একটা শব্দ শুনতে পায় যেটা আর কেউ শোনে না। সে শব্দটা শুনতে মনে হয় মোবাইলের রিংটোন। প্রথমেই সে এমনটা ভাবে। কিন্তু মোবাইল সে খুঁজে পায় না। তখন সে ঐ শব্দ সুরের তর্জমা করতে উঠে পড়ে লাগে। সেটা করার জন্য তাকে অনেক গুগল করতে হয়, অনেক কিছু ডাউনলোড করতে হয়। তখন আমার মনে পড়ে মোস্তফা বুয়েটে কেমিক্যালে পড়লেও এখন সে মস্ত বড় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। কম্পিউটার নিয়েই ওর কাজ কারবার। আর এই গুগল করা ‘সুরকে বাক্য করা বা বাক্যকে সুরে” রুপান্তরের কথা পড়তে পড়তে আমি বুঝতে পারি আমি সায়েন্স ফিকশন পড়ছি। তো, মুশকিল হলো এদেশে ২৭-২৮ বছরের একটি মেয়ের পক্ষে এরকম একটা গবেষণা করা নিতান্তই কঠিন। বিশেষ করে আশেপাশের লোকজনের আচরণ। ফলে, ওদের কারণে পুস্পিতা তার গবেষণা শেষ করতে পারে না। পারে না বলে লেখককে আমদানী করতে হয় একজন বিজ্ঞানীকে। এ যেন ব্যাক টু দ্যা ফিউচারের সেই আইনস্টাইন। শেষমেষ মুধরেন সমাপয়েৎ।
কিন্তু যতোটা সহজ করে আমি এক প্যারাতে লিখলাম ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই তা না। কারণ এই শব্দ আসলে একটি আন্ত:নাক্ষত্রিক সংকেত যা কেবল পুস্পিতাই ধরতে পারছে এবং তার আগে ঐ বিজ্ঞানী পেরেছেন। সেটি ডিসাইফার করার জন্য পুস্পিতার গবেষণার যে ধাপগুলো অতিক্রম করতে হয়েছে সেটি অসাধারণ। তখনই আমি বুজতে পেরেছি বিজ্ঞান কংগ্রেসের অভিজ্ঞতাটা তার কেমন কাজে লেগেছে।
এই গল্পটার বর্ণণাটা অসাধারণ। এটি আগাগোড়াই একটি অতি সাধারণ কাহিনী। কেবল মহাজাগতিক ছোঁয়াটি এটিকে অন্য এক মাত্রায় পৌছে দিয়েছে। সায়েন্স ফিকশন হলে সেটি কেবল রোবটদের নিয়ে হবে এমনটা ভাবাটা অন্যায়। অন্তত মোস্তফার এই গল্প পড়ে আমার মনে হয়েছে, বা কী সুন্দর একটা সায়েন্স ফিকশন হয়ে গেল আমাদের অতি পরিচিত পুস্পিতাকে ঘিরে। এবং সেটি মোটেই আরোপিত মনে হলো না।
গল্পের শেষটা খুবই চমৎকার। মনে হচ্ছে পুস্পিতার স্বামীটিও আমাদের ভাল জুনিয়র বন্ধু হবে। ভাবছি ওদের দুজনকে আগামী বিজ্ঞান কংগ্রেসের যৌথ কংগ্রেসে দাওয়াত দেবো।
রিংটোন ও রং নাম্বার
মোস্তফা তানিম
ভিন্নচোখ প্রকাশনী
৯৬ পৃষ্ঠা।১৫০ টাকা