বইমেলার বই-৩ : চোখ রাঙ্গালে না হয় গ্যালিলেও লিখে দিলেন পৃথিবী ঘুরছে না

Spread the love

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময়কালটা আমার জীবনের মোড় ঘোরানোর সময়কাল। তাই আমার অনেক লেখা শুরু হয় – ‘আমি যখন বুয়েটে পড়তাম’ (হা হা ইমো)। অনেকেই এতে আপত্তি করেন, কিন্তু আমি খুব একটা পাত্তা দেই না। কারণ আমি তো বুয়েটে পড়েছি, তাই না?
তো, আহসানউল্লা হলের ১১৯ নম্বর কক্ষে থাকার পুরো সময়টা জুড়ে আমার একটা কাজ ছিল খালি বই পড়া। এই সময়ে আমি মানিক বন্দোপাধ্যায় থেকে শুরু করে শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, আবার আর্নেস্ত্রো কার্দেনালের কবিতা আর রসুল গামজাতভের আমার জন্মভূমি সবই পড়ে ফেলেছি। (এসবই আমি আমার আত্মানুসন্ধানের প্রথম পর্ব “পড়ো পড়ো পড়ো” তে বিস্তারিত লিখেছি)। তো, এসব পড়া দিয়ে আমার দুইটি কাজ হতো। কোন অংশ ভাল লাগলে সেটা কাগজে, নিউজপ্রিন্টে, লিখে আমি আমার টেবিলের ওপরে লাগাতাম। আর সুন্দর কোটেশনগুলো মনে রাখতাম। জুনিয়রদের প্রেমপত্রে ব্যবহারে জন্য সেই সব কোটেশন সাপ্লাই দিতাম। তো, এক সময় ইতালীয় দেশের এক বিজ্ঞানীকে নিয়ে লেখা একটা ছড়া বা কবিতার কয়েকটা লাইন আমার খুব পছন্দ হয়ে গেল। ফলে, ফাইনাল ইয়ারের সব সময় ঐ কবিতাটাই আমার টেবিলের সামনে থাকতো।
ভার্সিটি জীবনের এসব কথা মনে পড়েছে গতকাল বাতিঘর থেকে আমার ভাগনে, আবার বুয়েটের অধ্যাপকও, ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীর গ্যালিলেও বই কিনে আনার পর। গতকাল শুরুতেই দেখলাম পুস্তানীর পর পর উৎসর্গের পরের পাতায় দুইটি কোটেশনের একটি হলো বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ঐ বিখ্যাত লাইন। আমি খুব অবাক হয়ে দেখি সে সময়ের আইন কানুনের সঙ্গে আমাদের ৫৭ কিংবা ৩২ ধারার কতো মিল!
তো, সেই সময়ে কোন ডিজিটাল আইন কানুন বা ফেসবুক ছিল না। ফলে, কোন মতামত প্রকাশ করতে হলে বই লিখতে হতো যা কিনা আজকাল কেউ কেনে না। তারপরও বেচারা গ্যালিলেও গ্যালিলেই বই লিখেই ধরাটা খেয়েছিলেন! সেই হিসাবে পড়তে শুরু করার সময় ভেবেছিলাম বইটাতে এসব বিশ্লেষন একটি বেশি থাকবে ঘটনার ঘনঘটা থেকে। কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমার মতো ফারসীমও বুয়েটে পড়েছে। ও আবার সেখানে পড়ায়!!!
তো, বুয়েটে পরীক্ষার আগে আগে একটা বন্ধ থাকে। পরীক্ষা প্রস্তুতি অবকাশ। আমাদের সময় আমরা এই অবকাশের শুরুতে বেড়াতে বের হয়ে যেতাম। দিন কতক পর ফিরে আবিস্কার করতাম সিলেবাস বড়। তখন রেলগাড়ি চালাই দিতাম। উপভোগ করার সময় থাকতো না। গড়গড়গড়! তারপর মনে হতো, ধুর পরীক্ষা পেছানো হোক। ব্যাস দিন দশেক মিছিল টিছিল করে দুই সপ্তাহ পরীক্ষা পিছিয়ে খুশি মনে আউল্লাহর কেন্টিনে ফিরতাম! ততোদিনে নালায় অনেক পানি গড়িয়ে যেতো। কাজে শুরু হতো চোথার সন্ধান আর শর্টকার্টের বুদ্ধি!
এসব কথাই আমার মনে পড়ে গেল ফারসীমের বই-এর আকার দেখে। ৭০ পৃষ্ঠাতে কেন গ্যালিলেওকে ধরতে হবে। কেন এটা প্রিপারেটরি লিভের পড়া হবে?

আমি ভেবেছিলাম ছোটদের জন্য গ্যালিলেও অনন্ত দুইটা চিন্তার উপলব্দি কেমনে হলো তার একটা বিবরণ থাকবে। প্রথমত গতির প্রথম সূত্র। গ্যালিলেও দেখলেন উচু জায়গা থেকে একটা বল গড়িয়ে দিলে সেটা কতো তাড়াতাড়ি নিচে নামবে এটা নির্ভর করে তলটা উচু নিচু কিনা তার ওপর। কাজে উনি একটা কাঠের পাঠাতন বানালেন। এবং সেটা দিয়ে বল গড়াতে শুরু করলেন। যতোই তিনি কাঠটাকে মসৃন করেন, ততোই উপর থেকে ছেড়ে দেওয়া বল ক্রমাগত দূরে যায়। মসৃন মানেই হলো কম বাধাঁ। কাজে তিনি বুঝতে পারলেন যদি কোন বাঁধা না থাকে তাহলে গড়িয়ে দেওয়া বল গড়াতেই থাকবে!!! দেখা, করা, দেখা থেকে একটু নতুন সত্য আবিস্কার।
কিংবা শুক্র গ্রহের কলা দেখা। ঐ গ্রহ যদি পৃথিবীর চারদিকে ঘুরে তাহলে সে ব্যাটা তো যে দিক থেকে ওঠবে তার উল্টোদিকে অস্ত যাবে। শুক্রের বেলায় তো এই ঘটনা ঘটে না। ঝামেলাটা কোথায়?
আমি বুঝেছি ফারসীমের তাড়া ছিল। সামনে পরীক্ষা কি না কে জানে। মনে হয়েছে এটি একটি দ্রুত পাঠ গ্রণ্থ।

একটা খটকার জায়গাও আছে। “ওপর থেকে ফেলে দিলে হাল্কা বস্তু ধীরে পড়ে, আর ভারী বস্তু দ্রুত পড়ে। তাহলে গ্যালিলেওর প্রশ্ন ছিল, শিলাবৃষ্টির সময়ো ছোট-বড় সব শিলাই দেখা যায় একই সময়ে মাটিতে পড়ছে। সেটা কেন হবে? অধ্যাপকরা তত্ত্ব দিতেন, বড় শিলা কাছের মেঘ থেকে আর ছোট শিলা তৈরি হয় আরো উপরের মেঘ থেকে”। ছোট শিলা যদি আরও উপর থেকে আসে তাহলেতো সেটির আরও দেরিতে পড়ার কথা! যাকগে, অধ্যাপক মশাই নিশ্চয়ই ব্যাপারটা দেখবেন (যদিচ তিনি বুয়েটের)।
এবার বলি বইটার ভাল দিক। ৭০ পৃষ্ঠায় গ্যালিলেও-র মতো একজন বিজ্ঞানী নিখুত ভাবে ধরা হয়েছে। অনেকগুলো মিথ ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। ফারসীমের গদ্যটা ঝরঝরে। এমন ঝরঝরে যে, এক বসাতেই আপনি পড়ে ফেলবেন।

যারা বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করে, যারা বিজ্ঞানী হতে চায় তাদের সবার জন্য এটা পাঠ্য।
যারা বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির সদস্য হতে চায় তাদের সবারতো এটি কিনতে হবে এবং পড়তে হবে! নতুবা ভাইভাতে পাস করতে পারবে না।

৩২ ধারা আর ৫৭ ধারার দুনিয়ায় গ্যালিলেও একটি অবশ্য পাঠ্য পুস্তক!

গ্যালিলেও
ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী
বাতিঘর
৭০ পৃষ্ঠা, ১২৫ টাকা।

Leave a Reply