বইমেলার বই ১১: আমি জেলে আসার পর
আমাদের যৌবনকালটা বড় আশ্চর্য সময়। এরশাদ শাহীর বিরুদ্ধে দ্রোহে-সংগ্রামে আমাদের সময় কেটেছে। সে সময়ে আমার পরিচয় ঘটে কয়েকজন অত্যাশ্চর্য কবির কবিতার সঙ্গে। এদের একজন কবি আল মাহমুদ। পুরো বুয়েট লাইফে আমার বালিশের পাশেই থাকতো সোনালি কাবিন।
শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতের উঠিয়াছে হাত
হিয়েনসাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,
এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত
তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা ।
আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন,
পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ,
এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ
যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ ।
আর একজন এদেশর কবি নন, ঠিক কবিও হয়তো নন। আর্নেস্ত্র কার্দেনাল। নিকারাগুয়ার সংস্কৃতি মন্ত্রী।
যখন তুমি যদি নিউইয়র্কে থাকো
নিউইয়র্কে কেবল তেমাকেই দেখি
যখন তুমি নিউ ইয়র্কে থাকো না
তখন নিউইয়র্কে কাউকে দেখি না।
তবে, রাতের বেলায় দলবেধে যখন ক্যাম্পাসে হাটতাম তখন সবাই গাইতাম বাফেলো সোলজার।
https://www.youtube.com/watch?v=rNYo6UFYCsM
আর শহীদ মিনারে ভরাট কন্ঠে কারো কন্ঠে উচ্চারিত হতো –
যে বছর জেলে এলাম
একটা পেন্সিল ছিল
লিখে লিখে ক্ষইয়ে ফেলতে এক হাপ্তাও লাগেনি।
পেন্সিলকে জিজ্ঞেস করলে বলবে :
‘একটা গোটা জীবন।’
আমি বলব :
‘এমন আর কী, মোটে তো একটি সপ্তাহ।’
এই কবিতার কবির নাম নাজিম হিকমত। তুর্কি কবি। বিপ্লবের কবি। ততোদিনে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গলায় শুনে ফেলেছি তার লেখা কবিতার সুর-
ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না!
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের করা অনুবাদের বইটা থাকতো টেবিলেই।
তবে, আগে কখনো শুনিনি, নাজিম হিকমত ছোট ছোট কবিতা বা রুবাই লিখেছেন। আগে কেউ সেগুলো বাংলায় অনুবাদ করেছেন তাও শুনিনি। আমার বন্ধু জিললুর একদিন জানালো নাজিম হিকমতের একগুচ্ছ রুবাই সে অনুবাদ করেছে আর বইমেলাতে সেগুলো “নাজিম হিকমতের রুবাইয়াৎ” নামে প্রকাশিত হয়েছে।
হাফিজের রুবাই কিছু পড়া ছিল বলে রুবাইয়াৎ বললেই ওমর খৈয়ামের “ঢালো মদ, ঢালো সাকী”ই কেবল মনে হয় না। তাই, নাজিম হিকমতের রুবাই-এর কথা শুনে আশ্চর্য হইনি। বাংলা একাডেমির বইমেলা থেকে তাই একদিন কিনে এনেছি বাতিঘরের সুন্দর স্টল থেকে।
বিপ্লবী কবিরা বেশিরভাগই প্রেমিক হয়। নাজিম হিকমতের বেলায় জেলখানার চিঠি তার প্রমাণ। তবে, প্রেমের চেয়ে দর্শন এসকল রুবাইতে অনেক বেশি প্রকাশিত। আর আছে দ্বন্ধ।
বাঁধাকপি, গাড়ি, প্লেগের জীবাণু, নক্ষত্র:
আমরা সকলেই আত্মীয় স্বজন মাত্র
নাহে, আমার সৌরচুক্ষ প্রেম, “আমি ভাবি বলেই আমি আছি”
তবে, আমাদের বিশিষ্ট পরিবারে, আমরা আছি বলেই আমরা ভাবতে পারি…
এমন সিদ্ধান্তও আপনি পাবেন। আমি অনেক কবিতা পড়লেও কবিতার ব্যকরণ জানি না। আমি কেবল বোঝার চেষ্টা করি রুবাইয়াৎ কী আমার মাথার মধ্যে গুনগুন করে? করলেই সেটি ভাল। চারপর্বে অনেকগুলো রুবাই। পড়তে হবে সময় নিয়ে। রয়ে সয়ে। তাই কয়েকটা রেখে দিয়েছি। সবচেয়ে ভাল লেগেছে –
আমাদের বাহুগুলো ফলভারানত শাখা,
শুত্রূরা ঝাকুনি দেয় বারবার,
আর মঙ্গেলতম আমাদের ফল-ফলাদি ফলানো
ওরা দেয় না পায়ে বেড়ি, পরায় শৃঙ্খল মনে …
শেষের তিন শব্দে মনে হয় নাজিম হিকমত বলেছেন ফেসবুকের কথা!
পড়ে মনে পড়লো আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর সেই লাইন-
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।
নাজিম হিকমতের রুবাইয়াৎ
অনুবাদ জিললুর রজমান
বাতিঘর, চট্টগ্রাম
১৫০ টাকা।