রক্ত দিন, জীবন বাঁচান

Spread the love

আমি যখন চট্টগ্রাম কলেজে পড়ি তখন থেকে মনে হয় স্বেচ্ছায় রক্তদানের কথা জানতে পারি। যদিও নিজে রক্ত দেবো এটা ভাবতে সময় নিয়েছি। সে সময় রহমতগঞ্জের নবীনমেলার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। টেবিল টেনিস খেলতে যেতাম বটে, তবে তেমন ভাল খেলোয়াড় ছিলাম না। কিন্তু আড্ডা গল্পে সময় ভাল কাটতো। কোন একদিন (এইচএসসির আগে না পরে, মনে নাই) নবীন মেলার প্রাণ পুরুষ জামাল ভাই ঘোষণা করলেন নবীন মেলার উদ্যোগে একটি স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি পালন করা হবে। সে মোতাবেক সব প্রস্তুতি নেওয়া হলো এবং নির্ধারিত দিনে আমরা প্রায় ৩০+ লোক হাজির হলাম চট্টগ্রাম মেডিকেলের ব্লাড ট্রান্সফিউশেনর দপ্তরে। আমার ভাগে পড়লো সবার রেজিস্ট্রেশন ও অন্যান্য তথ্য লেখার কাজ। দায়িত্বরত ডাক্তার ও কয়েকজন কর্মী আমাদের ওজন নিল। সে সময় ১০০ পাউন্ড ওজন না হলে রক্ত নেওয়া হতো না (মনে হয় এখনও তাই)। আমার ওজন নেওয়ার পালা আসার পরে দেখা গেল আমার ওজন মাত্র ৯৮ পাউন্ড! কাজে আমাকে রক্তদানে অযোগ্য ঘোষণা করা হলো।

আরও একজন ওজনে বাদ পড়লাম। মনটা খুব খারাপ হলো। সে সময় ঘরে ঘরে ওজন মাপার যন্ত্র থাকতো না। সে জন্য নিজের ওজন জানতাম না। নবীন মেলাতে ফেরার পর জামাল ভাই বললেন, “মুনির আহমদ, পকেটে একটা ইট নিয়ে ওজন নিতে পারতা”! তো, মনে মনে ঠিক করে রাখলাম যখনই ১০০+ পাউন্ড হবো তখনই রক্ত দেওয়া শুরু করবো।

তো, সুযোগ হলো বুয়েটে পড়তে আসার কিছুদিন পরে, ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। শিশু একাডেমিতেও সেই সময় একটা কোন মেলা হচ্ছিল। মেলায় গিয়ে দেখলাম সন্ধানীর একটা স্টল ও সেখানে রক্ত দেওয়া যায়। গেলাম দিতে। ওজনের বার অতিক্রান্ত। কাজেই আমাকে শুইয়ে দেওয়া হলো এবং কোন কষ্ট ছাড়াই আমি রক্ত দিলাম। কোন সমস্যা হলো না। সুই খোলার পর একটা কিছু (Band aid) দিয়ে রক্ত নেওয়ার ফুটোটা আটকে দেওয়া হলো। তারপর আমি উঠে বসলাম। আমাকে একটা সেভেন আপ খেতে দেওয়া হলো। কোন এক সিনিয়র ভাই (ডাক্তার বা মেডিকেল স্টুডেন্ট) আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন। আমি উঠে দাড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার ব্যান্ডএইডটা খুলে পরে গেল এবং হাতের ফুটো দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসলো। রক্তের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আমি জ্ঞান হারালাম (ভয়েই মনে হয়)!

একটু পড়েই জ্ঞান ফিরে দেখলাম আমি যে বেডে রক্ত দিয়েছি সেখানে আমাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। আশে পাশে কয়েকজন। খুবই লজ্জা পেলাম। বুঝলাম আজকে ওরা যখন ক্যাম্পাসে ফিরে যাবে তখন গিয়ে গল্প করবে এক বুয়েট ছাত্রের রক্ত দিতে এসে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কথা। ওরা আমার প্রেশার মাপলো। তারপর বললো সব ঠিক আছে। হাতের দিকে তাকালাম। দেখলাম রক্ত আর পরছে না। ওখানে এবার তুলাসহ আটকে দেওয়া হয়েছে। ওরা বললো আপনি একটু বসে থাকুন।

এই আমার প্রথম রক্তদানের অভিজ্ঞতা। পরেরবার বুয়েট ক্যাম্পাসেই দিলাম। তারপর থেকে বুয়েটে থাকতে  এবং পাশ করার পর অনেকবার রক্ত দিয়েছি। নিজের জন্মদিনে আমার একটা কাজ ছিল ঢাকা মেডিকেলের সন্ধানী অফিসে গিয়ে রক্ত দেওয়া। বুয়েটে পড়ার সময় একবার রক্ত দেওয়ার ২৭ দিন পরে আবার রক্ত দিতে হলো।  আহসানউল্লাহ হলের ১২০ নম্বর রুমের নাসিরের বড় বোনের জন্য। অন্য কাউকে না পাওয়াতে সকালে আমি সন্ধানীতে গেলাম। দেখলাম জন্মদিনে যে রক্ত নিয়েছে সেই ওখানে। আমাদে দেখে বললো- ক’দিন আগে না দিলেন। তারপর তারিখ দেখে বললেন – দিতে পারবেন। তারপর রক্ত দিয়ে ক্লাসে গেলাম। সেদিন সেশনাল ক্লাশ ছিল। স্যার খুবই এপ্রিসিয়েট করলেন এবং প্রায় ঘন্টাখানেক পরে গেলেও আমা উপস্থিতি কাউন্ট করলেন। ক্লাশ থেকে বের হওয়ার সময় বললেন, ‘রুম যাওয়ার পথে একটা কোক খেয়ে নিও’।

সর্বশেষ রক্ত দিয়েছি বেশ কয়েক বছর আগে। রুবাইকে ছোটবেলায় দেখাশোনা করতো যে মেয়েটি, সেই তহুরা তার বাড়ি থেকে এসে ঢাকা মেডিকেলে বাচ্চাকে ভর্তি করেছে। রাত ১২টার দিকে যেতে হলো। গিয়ে জানলাম রক্ত দিতে হবে। রাত দেড়টায় দুই দফায় মাত্র ১০০ এম এল। নিয়েছে সিরিঞ্জ দিয়ে, ব্যাগে নয়।

এর কিছুকাল পরে, তারপর এক বন্ধুর জন্য রক্ত দিতে গিয়ে শুনলাম, “রক্ত দেওয়ার বয়স আপনার পার হয়ে গেছে”। এখন তো আর নেবেই না।

পৃথিবীতে অন্য মানুষকে বাঁচানোর সবচেয়ে সহজ বুদ্ধি হলো রক্ত দেওয়া। ১৮-৪৫ বছর বয়স এবং ১০০+ পাউন্ড ওজন হলেই রক্ত দিতে পারবে।

রক্ত দিয়েই তুমি শুরু করতে পারো মানবিক তুমি হয়ে ওঠার প্রচেষ্টা।

আজ বিশ্ব রক্তদান দিবসে সকল স্বেচ্ছাব্রতী রক্তদাতাকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন ও কৃজজ্ঞতা।

হ্যাপি ব্লাড ডোনেশন

Leave a Reply