গণিতে ভাল করতে হলে
১.
গণিতে কেমন করে ভাল করা যায়?
এই প্রশ্নটা আমাকে হর হামেশা শুনতে হয়। প্রশ্নকর্তাকে দেখে আমি নানান বিষয়ে জোর দেই। তবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমি সেই কথাগুলো বলি যেগুলো গণিত অলিম্পিয়াডে বলি। শুরুতে আমি বলি ‘গণিতে ভাল করার কোন শর্টকার্ট পদ্ধতি নেই’। এই কথাটা অনেকে মানতে চান না। তখন আমাকে ইউক্লিডের কথা বলতে হয়।
জ্যামিতির ব্যাপারগুলো সুবিন্যস্ত করার পর ইউক্লিড শিষ্যদের পড়ানো শুরু করেন। অচিরে ব্যাপারটা বেশ ডালপালা গজিয়ে ফেলল। মূল কারণ হলো যুক্তির সৌধ। ইউক্লিডের সময় ব্যাপারটা যখন অনেক বাজার পেয়ে যায়, তখন রাজদরবারের লোক এসে হাজির হয় ইউক্লিডের কাছে। জানতে চায় জ্যামিতি শেখার কোনো রাজকীয় পথ আছে কি না? মানে শর্টকাট। ইউক্লিড তখন বলেছিলেন, (জ্যামিতি) শেখার কোনো রাজকীয় পথ নেই।
গণিতে ভালো করতে হলে আসলে ইউক্লিডের এই উপদেশ মনে রাখতে হবে।
গণিতে ভালো করার কোনো সহজ পথ নেই। গণিতের কয়েকটি শাখার দক্ষতা আমাদের কাজে লাগে। এগুলো হলো সংখ্যাতত্ত্ব, জ্যামিতি ও বীজগণিত। বাকি শাখাগুলো এদেরই বিকাশমান ধারা। কাজেই স্কুল-কলেজের গণিতটা মন দিয়ে করতে হবে, যাতে ভিত্তিটা মজবুত হয়।
২
সংখ্যাতত্ত্বের কথাই ধরা যাক। ১০টি ডিজিট বা অঙ্ক দিয়েই সংখ্যার যত মারপ্যাঁচ। সংখ্যাতত্ত্ব বোঝার তাই প্রথম কাজই হলো সংখ্যাকে চেনা। সংখ্যাকে চেনা মানে সংখ্যাপাতন। ১৩৪৭ যে আসলে ১ হাজার ৩ শতক ৪ দশক ও ৭ একক এটা বোঝা খুব জরুরি। এর মানে হলো
১৩৪৭= ১×১০০০+৩×১০০+৪×১০+৭×১।
তারও আগে আমাদের বুঝতে হবে ’১১’ এ হচ্ছে এগারো, মোটেই ২ নয়। মানে রোমান সংখ্যাপদ্ধতির চেয়ে দশমিক সংখ্যা পদ্ধতি ভিন্ন। কারণ আর্যভট্টের কারণে আমাদের আছে শূণ্য (০)। শূণ্যের কারণে আমরা সংখ্যা লেখার এই পদ্ধতিটা বের করতে পেরেছি। এখানে সংখ্যার (Number) মধ্যে যে সকল অঙ্ক(digit) থাকে তাদের দুটো মান। একটি তার নিজের মান বা পরম মান। আর একটি হলো স্থানিক বা স্থানীয় মান। ফলে দশকের ঘরে ১ এর মান হয় ১০ কিন্তু হাজারের ঘরে থাকলে সেটা হয়ে যায় ১০০০!
শূণ্যের কারণে যে দশমিক পদ্ধতি সেখানে তাই আমরা অনেক বড়ো সংখ্যা লিখতে পারি। যেমন ১-এর পরে ১০০টি শূণ্য দিয়ে আমরা লিখে ফেলতে পারি এক গুগোল! তো, এই ফাঁকে আমাদের একক দশকের সারিটাএ জেনে রাখা যায়
পরার্ধ, মধ্য, অন্ত্য, জলধি, শম্ভু, মহাপদ্ম, নিখর্ব, খর্ব, পদ্ম, অর্বুদ, কোটি, নিযুত, লক্ষ, অযুত, হাজার,শতক,দশক,একক
বামদিকের প্রতিটি ঘর তার ডানদিকের ঘরের মানের দশগুণ। এর অর্থ হলো ১ এর পরে ১৭টি শূণ্য দিলে হয় পরার্ধ।
এভাবে সংখ্যাকে ভেঙে বুঝতে পারলে অনেক কিছুই খুব সহজ হয়ে যায়। যেমন বিভাজ্যতার নিয়ম। ওপরের ১৩৪৭ সংখ্যাটা দেখেই কিন্তু আমরা বলতে পারি এটি ১০ বা ৫ দিয়ে বিভাজ্য নয়। যদিও এর প্রথম তিনটি রাশি কিন্তু ৫ ও ১০–এর গুণিতক। কিন্তু একক স্থানের অঙ্কটি কিন্তু তা নয়। ফলে পূর্ণ সংখ্যাটিও কিন্তু ৫ বা ১০–এর বিভাজ্য হলো না। একই ভাবে একক স্থানের অঙ্কটি যেহেতু জোড় নয়, কাজে এটি ২ দ্বারাও বিভাজ্য নয়। এভাবে সংখ্যাকে ভেঙে লিখলেই আমরা এর গভীরে পৌঁছাতে পারি।
সংখ্যা চেনার পরই আমাদের এটি নানা দলে ফেলার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। যেমন জোড় বা বিজোড়, মৌলিক, সহ–মৌলিক নাকি যৌগিক ইত্যাদি। এসবের জন্য ধারণাগুলো পোক্ত করতে হবে। এমন পদ্ধতিগুলো কেন সে রকম, সেটাও কিন্তু বুঝতে হবে। সরাসরি পদ্ধতিতে যাওয়া যাবে না। যেমন মৌলিক সংখ্যা। একটি সংখ্যা কেন মৌলিক সেটা মুখস্ত করা যাবে না বরং জানতে হবে কেন সেটিকে আমরা মৌলিক বলছি।
সংখ্যার পরের ভাবনাটা হলো এর গুণিতক বা গুণণীয়ক। এর মানে হলো সংখ্যাটিকে কি ভাঙা যায়? একটি সংখ্যা কি একাধিক সংখ্যার গুণফল হতে পারে? গুণিতক ও গুণনীয়কের আলোচনায় আসলেই এসে পড়ে লসাগু বা গসাগুর কথা। ছোটবেলাতেই আমরা দুইটি সংখ্যার গসাগু নির্ণয়ের ইউক্লিডের পদ্ধতিটা জেনে যাই। কিন্তু কখনো কি ভেবেছি এভাবেই কেন গসাগু নির্ণয় করতে হবে?
এ জন্য গণিত কেবল করলেই হয় না, এ জন্য প্রচুর পড়তেও হয়। আর এটা করা যাবে, যদি তুমি তোমার গণিত বইয়ের প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতে যে বিষয়গুলো বর্ণনা করা হয়েছে, সেগুলো ভালোমতো পড়ে আয়ত্ত করো। সেটি আয়ত্ত হওয়ার পর তোমার কাজ হবে উদাহরণ হিসেবে করে দেওয়া সমস্যাগুলোর সমাধান আত্মস্থ করা। এরপর নিজে নিজে অনুশীলনীর অঙ্ক তোমার করতে হবে। আমি আবার বলছি। অনুশীলনীর অঙ্কগুলো তোমার নিজে নিজেই করতে হবে কোনো সাহায্য ছাড়াই। হতে পারে তুমি সব পারবে না। কিন্তু সেটাই সই। তুমি সে অধ্যায়ের না পারা অঙ্কগুলো রেখে পরের অধ্যায়ে চলে যাবে এবং একই নিয়মে পড়া, উদাহরণ বোঝা ও অনুশীলনী নিজে করা চালিয়ে যাবে এবং এ অধ্যায় শেষে আবার আগের অধ্যায়ে ফিরে গিয়ে নতুন করে না পারা অঙ্কগুলো চেষ্টা করবে। এভাবেই তুমি ক্রমাগত নিজের দক্ষতা যেমন বাড়াতে পারবে তেমনি তুমি গণিতের ধারণাগুলোও ক্রমাগত উপলব্ধির পরের ধাপে পৌঁছাতে পারবে।
৩
জ্যামিতির ব্যাপারটাও একই। এইচএসসি পর্যন্ত আমরা ইউক্লিডের জ্যামিতিই পড়ি। এই জ্যামিতি কিন্তু ৫টি স্বীকার্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং রয়েছে কিছু সাধারণ অনুমান। এগুলোর ওপর ভিত্তি করেই কিন্তু জ্যামিতি। কাজেই ইউক্লিডের জ্যামিতি ভালো করতে হলে তোমাকে এই স্বীকার্য ও অনুমানের তাৎপর্যগুলো বুঝে নিতে হবে। এগুলোর কোনো কোনোটি তোমাকে অবাক করতে পারে। যেমন পৃথিবীর সব সমকোণ পরস্পরের সমান। এটি কিন্তু প্রমাণ করা যায় না, মেনে নিতে হয়! আবার দুটি বস্তু যদি আলাদাভাবে তৃতীয় কোনো বস্তুর সমান হয়, তাহলে তারা পরস্পর সমান। এটিও কিন্তু একটি কমন নোটেশন। তারপর কিছু সংজ্ঞা আছে সেগুলো জানা ও বোঝার কাজ।
জ্যামিতিতে এর পরের কাজটাই হলো জ্যামিতিক চিত্র থেকে বের হয়ে আসা। জ্যামিতিক চিত্রই কিন্তু জ্যামিতি নয়, জ্যামিতি হলো যুক্তির পর যুক্তি দিয়ে সাজানো একটি সৌধ। এ জন্য কিছু কৌশল বোঝার জন্য পদ্ধতির তাৎপর্যও তোমাকে বুঝতে হবে। যেমন দুটি রেখাংশ পরস্পরের সমান—এ কথার তাৎপর্য কী? এ কথার তাৎপর্য হলো একটির ওপর অন্যটিকে যদি একই দিকে ফেলা হয়, তাহলে এরা সমাপতিত হবে। ঠিক একইভাবে যদি দুটি কোণ সমান হয় তাহলে এরাও সমাপতিত হবে। এই দুটি বিষয় যদি তুমি ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারো তাহলে টের পাবে, দুটি সমান বাহুবিশিষ্ট ত্রিভুজ যে সর্বসম সেটি প্রমাণ করতে আমাদের কেন অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। একইভাবে দুটি ত্রিভুজের দুই বাহু ও একটি কোণ সমান হলেই তারা সব সময় সর্বসম হয় না।
অন্যদিকে স্কুলজীবনে তোমাকে খুঁজতে হবে, জ্যামিতিটা বাস্তব জীবনে প্রযোগের বুদ্ধি কী? যেমন কীভাবে সদৃশ ত্রিভুজের ধারণা থেকে তুমি কোনো ভবনের ছায়া মেপে সেটার উচ্চতা জেনে ফেলতে পারো। কাজেই জ্যামিতি শেখার বুদ্ধি হলো ইউক্লিডের শেখানো পথে হাঁটা। অর্থাৎ স্বীকার্য ও সাধারণ বুদ্ধি প্রয়োগ করে একটির পর একটি জ্যামিতিক উপপাদ্যে নিজে থেকে পৌঁছানো। তা যদি তুমি পারো, তাহলে উপপাদ্যের স্বতঃসিদ্ধান্তে যেমন তুমি নিজেই পৌঁছাতে পারবে, তেমনি অনুশীলনীর সমস্যাগুলোর সমাধান করতে তোমার বাড়তি কারও সহায়তার দরকার হবে না।
৪
বীজগণিতের আলাপে প্রথমে আসে সূত্র বা ফর্মুলা। তবে তুমি যদি বীজগণিতে সত্যিকারের দক্ষ হতে চাও, তাহলে মাথা থেকে তোমাকে সূত্রের ব্যাপারটা ফেলে দিতে হবে। তোমাকে বুঝতে হবে, বীজগণিতের তথাকথিত সূত্রগুলো আসলে পরে অঙ্ক করার জন্য শর্টকাট মাত্র। আমি দেখেছি অনেক শিক্ষার্থী (a+b)2 = a2+2ab+b2 জানলেও এটি কেমন করে এসেছে, সেটি বলতে পারে না। এটি যে আসলে (a+b)কে (a+b) দিয়ে গুণ করে পাওয়া যায়, সেটি না জানলে সামনে এগোনোটা কঠিন। পাটিগণিতের তুলণায় বীজগণিতের শুরুতে একটু খটকা লাগে, কারণ এখানে সংখ্যার পরিবর্তে প্রতীক ব্যবহৃত হয়। কাজেই শুরুতে মৌলিক বিষয়গুলো তোমাকে ভালোমতো বুঝে নিতে হবে। এখানেও ২ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত নিয়ম তোমাকে মেনে চলতে হবে। অর্থাৎ পাঠ্যপুস্তকের প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতে যে বর্ণনা, সেটি পড়া ও আত্মস্থ করা, উদাহরণগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখা এবং দরকার হলে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া এবং সবশেষে নিজেই অনুশীলনীর অঙ্ক করা।
৫
পাঠ্যপুস্তকের সমস্যা সমাধানে যখনই তুমি সড়গড় হয়ে উঠবে তখনই তুমি আমাদের গণিত অলিম্পিয়াড পরিবারের বইগুলো জোগাড় করে পড়তে ও করতে শুরু করতে পারো। তোমার অধীত শ্রেণি অনুসারে এ বইগুলোর তালিকা তুমি গণিত অলিম্পিয়াডের ওয়েবসাইটে পেয়ে যাবা। এগুলো তুমি সংগ্রহ করে নিতে পারো।
শুরুতেই বলেছি গণিতে ভাল করার কোন ম্যাজিক পদ্ধতি নেই। তোমাকে ভালভাবে বিষয়গুলো আত্মস্থ করতে হবে এবং তারপর অনুশীলণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে কঠিন ও দীর্ঘ অনুশীলন তোমার গণিতের রাজপথে বিচরণকে সহজ করে তুলবে।
তোমার জন্য শুভ কামনা
(সংক্ষিপ্ত ভার্সন কিশোর আলো’তে প্রকাশিত)
2 Replies to “গণিতে ভাল করতে হলে”
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.
অনেক হেল্পফুল।গনিত নিয়ে আপনার বিস্তারিত আরো লেখা চাই।
৪র্থ থেকে ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছেলে-মেয়েদের জন্য একটা বই লিখছি এখন – গণিতের ভিত্তি নামে। সেটার একটা ই-লার্নিং কোর্সও থাকছে। এছাড়া ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণির দুইটি কোর্সও ডিজাইন করেছি। প্রতিটি দুই পর্ব করে। আগামী মাসে ইনশা আল্লাহ রিলিজ করবো। বই সেপ্টেম্বর অক্টোবরে প্রকাশ হতে পারে ইনশাআল্লাহ।