বিশ্ব লিঙ্গ বৈষম্য রিপোর্ট ও আমাদের মেয়েরা
বিশ্ব লিঙ্গ বৈষম্য রিপোর্ট ২০১৪ প্রকাশিত হয়েছে গতকাল, ৩ নভেম্বর। বিগত দুই দশকে আমাদের দেশের যে অগ্রগতি, রাজনৈতিক হট্টগোল স্বত্তেও, তার একটা প্রতিফলন এই রিপোর্টে দেখা গেছে। গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট প্রকাশ করে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। শুরু করেছিল ২০০৬ সালে। এবারের রিপোর্ট হচ্ছে নবম রিপোর্ট। এবছর ১৪২টি দেশ এই ইনডোক্সের আওতায় এসেছে। নারীর উন্নতি হলে, সমাজে নারীর সমতা নিশ্চিত হলে, একটি জাতি অনেকখানি এগিয়ে যেতে পারে। নেপোলিয়নের কথা মনে আছে? ঐ যে বলেছিলেন সুজাতি পেতে হলে সুমাতা লাগবে। সেটাই কিন্তু আসল। কয়েক বছর আগে দেশের সবচেয়ে বড় মেয়েদের কলেজের ডিজিটাইজেশনের কাজের সময় অধ্যক্ষ আমাকে জিঙ্গাষা করেছিলেন – বাকীদের সবার কোন না কোন স্বা্থ আছে এখানে। আপনার কী?
আমি বলেছিলাম – আমি ২৭ হাজার ডিজিটাল মা দেখছি। ঔটাই আমার লাভ।
যাকগে, বলছিলাম বিশ্ব লিঙ্গ বৈষম্য রিপোর্টের কথা। আগের বছরের তুলনায় আমাদের অগ্রগতি ৭ ধাপ। গত বছর ছিলাম ৭৫, এবছরে উঠে এসেছি ৬৮তে।
এই সূচকের উদ্দেশ্য কয়েকটা। প্রথমটা অবশ্য হল সচেতনতা সৃষ্টি। আর এর পরেই হল জাতিতে-জাতিতে তুলনা। যে জায়গাগুলোতে আমরা পিছিয়ে আছি সেগুলোতে কেমন করে আগাতে হবে এবং কেন আগাতে হবে সেটা চিহ্নিত করার সুযোগ।
বিশ্বের ৩৫টি দেশ স্বাস্থ্য সেবায় নারী-পুরুষের বৈষম্য শূণ্যে নামিয়ে এনেছে। এর পর হচ্ছে শিক্ষা। ২৫টি দেশে এটি নাই। কিন্তু এখনো অর্থণীতিতে অংশগ্রহণ ও সুযোগের বেলায় এটি এখনো ৬০% এবং গত ৯ বছরে মাত্র ৪% গ্যাপ কমেছে। বরাবরের মত আইসল্যান্ড তালিকার শীর্ষেই রয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্য হল নিকারাগুয়া। ওরা আছে শীর্ষ দশে!
যারা নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে ভাবে তাদের নিয়মিত পর্যবেক্ষনে এই প্রতিবেদন থাকা দরকার। এটি পাওয়া যাবে এখানে।
গতকালের এই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে আজ প্রথম আলোতে প্রথম পাতার লিড স্টোরি হয়েছে। শিরোনাম ছিল –উন্নয়নসূচিতে আগাম সাফল্য : প্রাথমিক–মাধ্যমিকে অর্ধেকই ছাত্রী। এতে বলা হয়েছে- সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় ঠিক করা সময়সূচির আগেই বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রছাত্রীর সমতা অর্জিত হয়েছে। উপরন্তু মাধ্যমিক স্তরে মোট শিক্ষার্থীর ৫৩ শতাংশই ছাত্রী। উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায়ও মেয়েদের অংশগ্রহণ প্রতিবছর বাড়ছে। জেনেভাভিত্তিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ‘বিশ্ব লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদন ২০১৪’-এ প্রাথমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের (এনরোলমেন্ট) সূচকে এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের সূচকেও এই অঞ্চলের প্রথম সারির ১০টি দেশের একটি বাংলাদেশ। এই প্রতিবেদনে নারীশিক্ষায় গত বছর ১৩৬টি দেশের মধ্যে ১১৫তম অবস্থানে থাকলেও এবার বাংলাদেশ ১১১তম অবস্থানে উঠে এসেছে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, আগামী তিন বছরে উচ্চমাধ্যমিক ও সাত বছরে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও নারী-পুরুষের অংশগ্রহণ সমান করা হবে। তিনি বলেন, মানুষের সচেতনতা ও উপবৃত্তিসহ সরকারের নেওয়া বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগের ফলে নারীশিক্ষায় এই অগ্রগতি হয়েছে। এর ফলে এখন ওপরের শ্রেণিগুলোতেও নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে।
এর পাশাপাশি আরো একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম হল- মাথাপিছু আয় কম হলেও সামাজিক সূচকে এগিয়ে : ভারতকে ছাপিয়ে গেছে বাংলাদেশ। এটি করা হয়েছে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে। মূল কথা সহজ-সামাজিক প্রায় সব সূচকে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। যদিও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখনো ৬০ শতাংশ কম। অথচ ১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সব ক্ষেত্রেই প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল।
ভারতের মানুষ দ্বিগুণের বেশি আয় করলেও স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর বাংলাদেশের মানুষ গড়ে তাদের তুলনায় তিন বছর বেশি বেঁচে থাকে। তবে ভারতের তুলনায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে মেয়েরা। ভারতের মেয়েদের তুলনায় বাংলাদেশের মেয়েদের শিক্ষার হার ৬ শতাংশ পয়েন্ট বেশি, নারীপ্রতি জন্মহারও দশমিক ৩ শতাংশ পয়েন্ট কম।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গড় আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র ৩৯ বছর, একই সময়ে ভারতের ছিল ৫০ বছর। আর এখন বাংলাদেশের মানুষ গড়ে বেঁচে থাকে ৬৯ বছর, ভারতে ৬৬ বছর। ১৯৭১ সালে প্রতি এক হাজারে ১৫০টি শিশুর মৃত্যু হতো, আর ভারতে ১১৪ জন। আর এখন বাংলাদেশে নবজাতকের মৃত্যুর হার ৩৭ জন, ভারতে ৪৪ জন। পাঁচ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুর হার ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ছিল হাজারে ২২৫ জন, ভারতে ১৬৬ জন। এখন বাংলাদেশে সেই সংখ্যা অনেক কমে হয়েছে ৪৬ জন, ভারতে ৬৫ জন।
এবং এখানেও নারীর বিষয়টা প্রবলভাবে এসেছে। আমাদের দেশের অগ্রগতির একটি বড় কারণ কিন্তু নারীদের অগ্রযাত্রা।
আমরা অনেকেই ব্যাপারটা ঠিকমত খেয়াল করি না। কিন্তু যদি করতাম তাহলে সেটা আমাদের আরো এগিয়ে নিত।
বাংলাদেশের সব নারীর জন্য আমার সালাম।