বিলিয়ন ডলার স্টার্টআপ কেন লিখলাম
১.
গণিত অলিম্পিয়াড শুরুর পর থেকে আমাদের বেশিরভাগ ঘটনার শুরু ওখান থেকে। শুরুতে আমরা নানা কিছু করতাম। যেমন প্রতিবছর একটা আলাদা থিম রাখা । এক বছর ছিল – আমাদের ধান, আমাদের মান। বাংলার হাজার জাতের ধানের কথা আমরা আমাদের ডাচ বাংলা ব্যাংক প্রথম আলো গণিত উৎসবে বললাম। আর একবার করলাম – আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের সংস্কৃতি। সেবার সংস্কৃতি জগতের নানা কিছু আমরা উৎসবে যুক্ত করার চেষ্টা করি। ২০১১ সালের উৎসবের সময় আমরা ভাবলাম দেশে উদ্যোক্তা হওয়ার ব্যাপাটাকে প্রমোট করা যাক। কীভাবে করবো? প্রতিটি উৎসবে একজন স্থানীয় উদ্যোক্তা হাজির হয়ে তার গল্প বলবেন। তারপর জাতীয় উৎসবে দুজন উদ্যোক্তা আসবেন। সেই সময় প্রথম আলো’র স্বপ্ন নিয়ে পাতা দেখতেন ফিরোজ জামান চৌধুরী। উৎসব শেষে বললেন উদ্যোক্তার ব্যাপারটা নিয়ে একটা লেখা লিখে দেন। আমি একটা লেখা লিখলাম। অন্যরকম গ্রুপের চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান সোহাগ আর ফিরোজ জামানের হাত ঘুরে লেখাটার শিরোনাম হলো – চাকরি খুঁজবো না চাকরি দেব । মানে সহজ। এখানে একদল লোকের কথা বলা হলো যারা আসলে চাকরির প্রতি আগ্রহ না দেখিয়ে নিজেরা উদ্যোক্তা হবে। লেখার শেষ লাইনটা ছিল – পথে নামলে পথ চেনা যায়। সেটি ২০১১ সালের ৭ এপ্রিলের কথা। ঐ লেখা প্রকাশের পর কয়েকজনের সঙ্গে একই বিষয় নিয়ে আলাপচারিতা। কীভাবে এই উদ্যোক্তা সহায়ক কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। শেষমেষ এর ৬ দিন পর ১৩ এপ্রিল ফেসবুকে একটা গ্রুপ খোলা হলো – চাকরি খুঁজব না চাকরি দেব নামে। কালক্রমে সেটা একটা প্ল্যাটফর্ম হয়ে গেল। সেখান থেকে নানা কিছু আমরা করছি। উদ্যোক্তা হাট, উদ্যোক্তা সম্মাননা, সভা-সমিতি, সেমিনার, কর্মশালা, বুট ক্যাম্প ইত্যাদি। তো, এসব করতে গিয়ে আমাকে প্রচুর পড়াশোনা শুরু করতে হলো। নানা কিছু পড়ি। সেটা নিয়ে আলাপ করি। পড়তে গিয়ে টের পেলাম আমাদের দেশে উদ্যোক্তা, বিজনেস কিংবা মার্কেটিং-এর বই পত্র সবই পাঠ্যপুস্তকের চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সেখান থেকে যে বের হবে সেটাও খুব একটা বোধ হচ্ছে না। ভাবলাম তাহলে বই লেখা যাক। কি নিয়ে লিখবো?
দেখলাম আমাদের নবীন উদ্যোক্তাদের একটা বড় অংশই মার্কেটিং-এ হাবুডুবু খায়। লিখলাম ‘গ্রোথ হ্যাকিং মার্কেটিং’। অনেকেই পড়লেন। তারপর লিখলাম ‘শরবতে বাজিমাত’। তিন ব্রিটিশ উদ্যোক্তার গল্প। এবার মজার কিছু ঘটনা দেখলাম। অনেকে জানালো তারা এই বই পড়ে উদ্যোক্তা হওয়ার শক্তি পেয়েছে। ২০২০ সালেও ইমোশনাল মার্কেটিং নামে একটা বই লিখেছি। এর মধ্যে লক্ষ্য করলাম আমাদের মার্কেটিং গুরু, অধ্যাপকরা মার্কেটিং-এর বই লিখতে শুরু করেছেন। প্র্যাকটিশনাররাও এখন দুইহাতে লিখছেন। ভাবলাম আমরা আর এ লাইনে না গেলেও চলবে।
২০২০ সালে করোনা আসার পর ভাবলাম “ধাপে ধাপে গ্রোথ হ্যাকিং নামে” একটা বই লিখি। উদ্দেশ্য থাকবে সহজ। গ্রোথ হ্যাকিং-এর গুরুদের জানানো পদ্ধতিগুলো ধাপে ধাপে কেমনে নিজে প্রয়োগ করবে তার একটা দলিল। কিন্তু কে জানি (নাম ভুলে গেছি) বললো – বই না লিখে একটা কোর্স করান। এতে যে কোন পরিবর্তন ও নতুন কিছু সহজে সমন্বয় করা যাবে। সেই ভাবনা থেকে ই-মেইলে গ্রোথ হ্যাকিং মার্কেটিং নামে একটা কোর্স চালু করেছি। সেটি এখন চালু আছে।
তো, হ্যাকিং নিয়ে তাহলে আর বই লেখার দরকার নেই। তাহলে কি লিখি। হাত তো নিশপিশ করে। এই সময় মনে পড়লো ই-জেনারেশনের শামিম আহসান তাঁর সাম্প্রতিক একটি লেকচারে বাংলাদেশের স্টার্টআপের একটা স্বপ্নের কথা বলেন। সেটি হলো ২০২৫ সালের মধ্যে ৫টি ইউনিকর্ন তৈরি করা। ইউনিকর্ন হলো একটি কাল্পনিক প্রাণী। যে সকল স্টার্টআপের ভ্যালুয়েশন ১ বিলিয়ন ডলার হয় তাদেরকে বলা হয় ইউনিকর্ন। ভাবলাম ইউনিকর্নের খবর নেওয়া যাক।
প্রথমে বোঝার চেষ্টা করলাম বিলিয়ন ডলার মানে কতো টাকা? শূণ্য ঠিকঠাকমতো বসিয়ে সেটিকে ৮৫ টাকা দিয়ে গুণ করার পর বুঝলাম ঘটনাটি জটিল। কারণ টাকার পরিমাণ হচ্ছে ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা!!! এতো টাকা কেমন করে হিসাব করা যায়। তারপর দেখলাম হাতের কাছে আছে আমাদের পদ্মা সেতু। পদ্মা সেতু বানাতে খরচ হচ্ছ/হবে ৩০ হাজার কোটি টাকা। তার মানে চার বিলিয়ন ডলারের একটু কম। টাকার অঙ্ক বোঝার পর একটু মন খারাপ হয়ে গেল। বুঝলাম কঠিন কাজ।
তারপর ভাবলাম না দেখি অন্যদের ইউনিকর্নগুলো কেমন করে ইউনিকর্ন হয়েছে। তো সেজন্যই বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিগুলোর খোঁজখবর নিতে শুরু করলাম। তারপরই সাহস ফিরে পেলাম। কারণ এগুলোর কোনটিই মঙ্গলগ্রহের প্রতিষ্ঠান নয়। এমন বিশাল কোন ঘটনাও নয়। তাহলে তারা কেমন করে ইউনিকর্ন হলো?
সেটা জানার জন্যই বিলিয়ন ডলার স্টার্টআপ।
২.
তো, বিলিয়ন ডলার স্টার্টআপের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। সেখান থেকে ১০-১২টা কেমন করে বাছাই করবো? ভাবলাম আগে পড়ি, জানি। তারপর নিজের মতো করে বাছাই করি। শেষ মেষ যেগুলো এই বই-এ এসেছে সেগুলোর মূল আইডিয়া কিন্তু আলাদা। মানে দুইটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের স্টার্টআপ কিন্তু এখানে নেই। চেষ্টা করেছি আইডিয়ার বৈচিত্র্য ধরতে। এর মধ্যে আমি একটা বিষয় বুঝে ফেলেছি সেটা হলো আইডিয়ার খুব বেশি দাম নেই। লোকে বরং দেখে যে কাজটা হচ্ছে সেটা কেমন, আগাতে পারবে কি না। অনেক সময় সিনিয়ররা ঠিকই পাশ কাটিয়ে যান। এয়ারবিএনবির কথা ধরা যাক। শুরুতে এর উদ্যোক্তারা ১৫ জন বিনিয়োগকারীর শরণাপন্ন হয়। এদের মধ্যে ৮ জন কোন উৎসাহ দেন নাই। ৭ জন তো সময়ই দেননি। অন্যদিকে ফেসবুকের বেলায় মনে হবে সবাই বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। ইয়াহু, গুগল, মাইক্রোসফট – সবাই। কাজে বিনিয়োগের কেমেস্ট্রি বোঝার ব্যাপারটা খুব বেশি জটিল মনে হয়নি। তারপর দেখলাম সব কোম্পানিই একটা দর্শন তৈরি করে নিয়েছে কর্মী রিক্রুট করার আগে। এটার ফলাফলই টের পেয়েছি। সবারই অসাধারণ টিম। এই কেমেস্ট্রিটা হলো সেটা যার কারণে শেরিল শ্যান্ডবার্গ গুগল থেকে এসে ফেসবুকের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা হন। এর মধ্যে নেটফ্লিক্সের ব্যাপারটাও জানা গেল। “নো রুলস, রুলস” হলো ওদের নীতি। সেখানে কর্মীরা যখন খুশি তখন ছুটি নিতে পারে। অদ্ভুত। অথচ তারা অস্কার পাওয়া মুভি বানায়! স্টার্টআপগুলোর কালচার এমন হয় যে, সেখানে চাকরি করলেও লোকের উদ্যোক্তা মনোভাব চাঙ্গা হয়ে উঠে। এ কারণে দেখা যায় পেপালের উদ্যোক্তা ও প্রথম ৫০ কর্মীর অর্ধেকই পরবর্তী সময়ে নিজেরাই ইউনিকর্নের জন্ম দিয়েছে! পশ্চিমাজগত তাই আদর করে তাদের “পেপাল মাফিয়া” নামে ডাকে।
একটা দারুন মিল দেখেছি। সবাই নিজের ব্যবহারকারীকে অসম্ভব দাম দেয়। তাদের যত্ন করে। তাদের নিয়ে ভাবে। বোঝা যায় এটুকু আছে বলে তারা লক্ষ-কোটি কাস্টোমার পায়। পৃথিবীর প্রতি তিনজন বাসিন্দার একজন ফেসবুক ব্যবহার করে। এয়ারবিএনবি বছর জুড়ে হোস্টদের নিয়ে মিটআপ করে। তার সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠানও হোস্টদের নিয়ে।
যেগুলো তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সেগুলোও মুক্ত দর্শনের অনুসারী। ফেসবুক যেমন তার এপিআই উন্মুক্ত করে দিয়েছে ডেভেলপারদের জন্য। ফলে ফেসবুককে কেন্দ্র করেই টেকাটুকার সমাধান হয়ে গেছে এক বড় ডেভেলপার গোষ্ঠীর।
তবে, আমি শুধু আইটি কোম্পানিতে থাকিনি। খুঁজে বেড়িয়েছি অন্যদেরও। তাই ঈসা ভাইদের পেট্রোল পাম্পের কথাও এসেছে। শুধু আমেরিকাতে না থেকে অন্যত্রও দেখেছি।
গল্পগুলো একই। যতো না আইডিয়া তার চেয়ে বেশি ইমপ্লিমেন্টেশন, বাস্তবায়ন। দলীয় কাজ। দাঁতে দাঁত চেপে লেগে থাকার গল্প। বেশিরভাগ সময়ই বড় ভাইরা মানা করেছে। সবাই বলেছে, “ইট উইল নেভার ওয়ার্ক”। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উদ্যোক্তার জিদ, উদ্যম আর কাজের নিষ্ঠারই জয় হয়েছে।
উদ্যোক্তারা বেশিরভাগই তরুণ। এই বই তাই তারুণ্যের জয় জয়কার। তাদের বিজয়ের কাহিনী।
৩. এই বই কেমন করে লিখেছি? সহজ কোন রাস্তা পাইনি। কারণ অনেক উদ্যোক্তাই এখন পর্যন্ত নিজে কোন বই লেখেননি। তবে, পশ্চিমাদের একটা বড় গুণ হলো কেউ না কেউ বইগুলো লিখে ফেলেছে। কাজে পেপাল হোক, ফেসবুক হোক বা এয়ারবিএনবি হোক। বই লেখা হয়েছে। আমি চেষ্টা করেছি ইনফোগুলো বই থেকে নিতে। সঙ্গে উইকিপিডিয়া আর মিডিয়াম ব্লগে লেখা নানা নিবন্ধ। আর সবশেষে কিছু বিখ্যাত মার্কেটিং সাইট যেমন হাবস্প্ট, গ্রোথহ্যাকিংআইডিয়া-এর লেখা। বেশ কিছু কোম্পানিকে নিয়ে কেস স্টাডি লেখা হয়েছে হার্বার্ড বিজনেস রিভিউ এবং অন্যান্য মিডিয়াতে। সেগুলোও দেখেছি। আমি অবশ্য কেস স্টাডি লিখতে চাইনি। শুধু গল্পটা বলতে চেয়েছি। কোন কোন গল্প খুবই সংক্ষেপে বলেছি। কোন কোনটা বিস্তারিতভাবে বলেছি। কারণ হলো যে গল্পটা বা বলা ভাল উদ্যোক্তাদের লড়াইটা জটিল সেটাতে সময় বেশি দিয়েছি। যেটা সহজ মোটামুটি সেখানে গল্পটা বলেছি। লেখার সময় জটিল কারিগরি দিক নিয়ে মাথা ঘামায়নি। যেমন এয়ারবিএনবি কর্তৃক ক্রেইগলিস্ট হ্যাক করা। এটার কারিগরিদিকে না যেয়ে বাহির থেকে দেখেছি। কারণ এ ধরণের কাজ নানাভাবেই করা সম্ভব। সেটি প্রোগ্রামারদের কল্পনার ওপর ছেড়ে দিলাম।
৪. এই বইটি আমি উৎসর্গ করেছি বাংলাদেশে আধুনিক স্টার্টআপ ধারণার প্রবর্তক ও গ্রামীণ ফোনের প্রতিষ্ঠাতা ইকবাল কাদিরকে। আমাকে যারা চেনেন তারা সবাই জানেন আমার জীবনের মটোগুলোর প্রধান হলো – কানেকটিভিটি ইজ প্রোডাক্টিভিটি – সংযুক্তিই উৎপাদনশীলতা। এই জন্য আমি দীর্ঘদিন ধরে সারাদেশে ব্রডব্যান্ড পৌঁছে দেওয়ার দাবী করে আসছি। কানেকটিভিটি ইজ প্রোডাক্টিভিটি এই দর্শনের প্রবক্তা ইকবাল কাদির। বর্তমানে হার্বার্ড ইউনিভার্সিটির একজন প্রফেসর। কাজ করছেন তৃতীয় বিশ্বে অন্ট্রপ্রিনিয়র ডেভেলপমেন্ট নিয়ে। ২০২০ সালে তাঁর একটি ইন্টার্ভিউ করেছি আমি প্রথম আলো’র টেপটক অনুষ্ঠানে। সেখানে অনেক কথাই বলেছেন। সবচেয়ে ভাল লেগেছে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে আমাদের তুলনার বিষয়টি। বলেছেন – আজ থেকে ১০০ বছর আগে উন্নত অনেক রাষ্ট্রই আমাদের বর্তমান অবস্থার মতো ছিল। তারা যদি পারে, তাহলে আমরা পারবো না কেন।
সেটাই কথা। আমরা পারবো। আমার মতো কেউ একজন তখন আমাদের ইউনিকর্নের গল্প লিখবে।
(আদর্শ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত আমার “বিলিয়ন ডলার স্টার্টআপ” বই-এর ভূমিকা]
2 Replies to “বিলিয়ন ডলার স্টার্টআপ কেন লিখলাম”