ফ্রম একলাছপুর টু কিয়শু উইথ পাওয়ার অব ইনফরমেশন
এখলাছপুরের মানুষের গল্প-ভাবনা এগুলো কয়েকটি বিষয়ের মধ্যেই আবর্তিত থাকে। আশির আহমেদ দেখলেন এর অন্যতম একটা কারণ হল তারা তথ্য বঞ্চিত। ঢাকা থেকে এখলাছপুরের এরিয়াল ডিসট্যান্স মাত্র ৪০ মাইল। কিন্তু কতো দূর! সদরঘাট থেকে লঞ্চেও সেখানে যাওয়া যায়। আশির দেখলেন প্রতিদিনকার পত্রিকা সদরঘাট পর্যন্ত আসে কিন্তু নদী পার হয় না। গ্রামের কেও যদি কখনো শহরে যায় তাহলেই গ্রামে মাঝে মধ্যে পত্রিকা যায়।
তো, একটা ব্যবস্থা হলো এরকম। একজন হকার প্রতিদিন চারটি পত্রিকা প্রথম লঞ্চের সারেং-এর কাছে পৌছে দেবে। টাকা আগেই দেওয়া হলো। সারেং সে পত্রিকা এখলাছপুরে একজনের কাছে পৌছে দেবে। এখলাছপুরের ঐ বালক সে চারটি পত্রিকা পৌছে দেবে চারটি স্কুলে।
শুরু হলো কিন্তু দেখা গেল অনেক ঝামেলা। কেও কেও অভিযোগ করলো যে, অনেক প্রধান শিক্ষক দুপুরে পত্রিকা বাসায় নিয়ে যান আর ফেরৎ আসে না। তখন ঠিক করা হলো, পত্রিকা দেওয়া হবে কিন্তু পরেরদিন আগের দিনেরটা ফেরৎ দিতে হবে।
কিছুদিন পর আশির আবার দেশে আসলেন। দেখলেন গ্রামের একজন পত্রিকা ফেরি করে বেড়াচ্ছে। মানে?
জানাগেল, গ্রামের বেশ কিছু লোক এখন নিজেরাই বাড়িতে পত্রিকা রাখতে শুরু করেছে। কারণ তাদের সে সামর্থ আছে। আগে তাদের কাছে পত্রিকা পৌছাতো না বলে সেটা আর কেনা হতো না। এখন একজন উদ্যোক্তা দায়িত্ব নিয়ে ওদেরকে পত্রিকা পৌছে দিচ্ছে। আর ঢাকা থেকে সদরঘাটের ঐ হকার পত্রিকা পাঠিয়ে যাচ্ছে।
শুধু তাই নয়, গ্রামের লোকদের আলোচনায় অনেক নতুন নতুন বিষয়ও চমৎকার করে ঢুকে পড়েছে। যেমন সুনামি!
…
পরেরবার ঠিক হলো মতলব থানার ১১৯টি স্কুলে পত্রিকা দেওয়া হবে। শুরু হলো একই কাজ। কিন্তু দেখা গেল এখন আরো অনেকেই পত্রিকা রাথতে চায়। এবং অচিরেই এই সংখ্যা পৌছে গেল ৫০০-তে। টনক নড়লো ঢাকায় হকার্স ইউনিয়নের। তারা আশির আহমেদকে জানালো ৫০০ কপি পত্রিকা যদি সরাসরি তাদের মাধ্যমে নেওয়া হয় তাহলে তারা ৩৫% কমিশন দেবে। মানে আট টাকার পত্রিকা ছয় টাকায়।
ব্যাস, হয়ে গেল বিজনেস মডেল। ঢাকা থেকে ৫০০ পত্রিকা যাবে মতলবে। মতলবের চার উদ্যোক্তা এর মধ্যে ১১৯টি পৌছে দেবে বিভিন্ন স্কুলে। বাকী পত্রিকাগুলো সে বিক্রি করবে। প্রতি কপি বিক্রিতে তার লাভ ২ টাকা যার ১ টাকা সে পাবে আর বাকী ১ টাকা যাবে ফান্ডে। সহজে কর্মসংস্থান হয়ে গেল ৪ জনের!
আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে একটি উপজেলায় ৫০০ কপি পত্রিকা বিক্রি হওয়ার বিষয় একটা খবরই বটে। তাই সেটা ছাপা হলো প্রথম আলোতে। আর এই পরিবর্তনের চেঞ্জ মেকার আশির আহমেদ, এখলাছপুরের সন্তান এখন জাপানের কিয়শু বিশ্বিদ্যালয়ের গবেষক-সহযোগী অধ্যাপক!
আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে “আমার কাহিনি” শীর্ষক বক্তৃতায় এখলাছপুরের মানুষের তথ্য প্রাপ্তি ও তথ্য তৈরির এই গল্প শুনিয়েছেন আশির আহমেদ। বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের উদ্যোগে বিডিওএসএন টকসের তৃতীয় আযোজনের বক্তা ছিলেন আশির আহমেদ।
শুরু করেছেন ছোটবেলা থেকে। সিলেটে জন্মের ৬ মাস পরে ফেনীতে আসা এবং এরপর চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার এখলাছপুর ইউনিয়নে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা। স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ক্লাসে প্রায় ৭০-৮০ জন সহপাঠী পেয়েছে। কিন্তু ক্লাশ ফাইভ পাস করার সময় দেখা গেল মাত্র ১৪ জন!!!
বাকীরা ঝড়ে পড়েছে। ঝড়ে পড়ার ব্যাপারটা মাথার মধ্যে ঢুকে গেছে এরপর। ক্লাসে পড়তে গিয়ে আশির আবিস্কার করেন, পড়া না পারলে স্যারের বেতের বাড়ি বেশি খায় গরীবের সন্তানেরা। তাদের সেরকম কোন গল্পও থাকে না। এতে আস্ত আস্তে তাদের পড়ালেখার উৎসাহ কমে যায়। ভাবলেন ওদের যদি এমন কিছু করা যেত যার মাধ্যমে ওদেরও গল্প বলার উপকরণ তৈরি হয়?
যখন সুযোগ হলো তখন প্রথম কাজই হলো স্কুলের ৭০ জন ছেলে মেয়েকে খুব ভোরে বাসে-লঞ্চে করে ঢাকায় নিয়ে আসা। তাদের ঢাকা দেখিয়ে আবার এলাকায় ফেরৎ নিয়ে যাওয়া। দেখা গেল ওদের গল্পের উপকরণ ওরা পেতে শুরু করেছে। কয়েক বছর পরে মনোবসু বৃত্তি নিয়ে জাপান যাওয়ার পর ভাবলেন স্কুলে আসলেই একটা বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। করলেনও। সে থেকে প্রায় ২০-২২ ধরে প্রতিবছর ৫০ জনকে বৃত্তি দেন। বৃত্তির শর্ত হলো স্কুলে আসতে হবে। দেখলেন যাদের জন্য ঘোরাফেরা আর বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে তাদের মধ্যে ঝরে পড়ার হার কম! শুরু করেছেন নিজের বৃত্তির টাকা দিয়ে এখনো নিজের টাকায় সেটি চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি ২০ বছর ধরে যারা এই বৃত্তি পেয়েছে তাদের একটা সম্মিলনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোলে বাচ্চা নিয়ে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় উত্তীর্ণ তরুনী, এমবিএ করছে এমন, ভাল চাকরি করছে এমন অনেকে। এদের সবারই ঝড়ে পড়ার কথা ছিল, আশিরের কারনে হয়নি সেটা।
এই কাজটা করার শুরুতে আশির তাদের ইউনিয়নের নাগরিকদের একটি ডেটাবেস তৈরি করে। কাজটা হযেছে এক্সেলে। ঔ ডাটা তাকে সাহায্য করেছে ঝুকিপূর্ণ শিশুদের চিহ্নিত করার কাজে।
পত্রিকার গল্প কিংবা ঝড়ে পড়ার হার রোধ – দুটোতেই খুব সহজে বোঝা যায় তথ্যের শক্তি। জানা-অজানার পার্থক্য। সেই সঙ্গে নতুন করে প্রমাণিত হয় – যেখানে সমস্যা সেখানেই উদ্যোক্তার সম্ভাবনা। আশির এরপর বলেছেন তার গ্রামওয়েবের কথা, পোর্টেবল হেলথ ক্লিনিকের কথা। সঙ্গে ছিল বিষমুক্ত সবজি চাষের ই-কমার্সের গল্প যেখানে ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকে একটা আইভিআর।
“আপনি আলু বেঁচবেন তাহলে ১ চাপুন, কলা বেঁচলে ২ চাপুন…
এটা ২০০৯ সালের কথা। সে প্রকল্প পেয়েছে জাপান সরকারের ৫০ মিলিয়ন ইয়েনের প্রকল্প সহায়তা, পাইলট প্রকল্পের জন্য। সেটি এখন শেষ পর্যায়ে। তৈরি হয়েছে বিজনেস মডেল। পত্রিকার ব্যবসার মতো হয়তো এখান থেকেও সরে আসবেন আশির। ব্যাটন দিয়ে দেবেন একদল নতুন উদ্যোক্তার হাতে যারা এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবে।
নিজের জীবনেরকথাও বলেছেন। বলেছেন সব কিছু কেমন করে সামাল দেওয়া যায় তার কথা।
জোর দিয়ে বলেছেন – কাজে আনন্দ পাওয়ার কথা। আনন্দের সঙ্গে কাজ করলে তবেই জীবনকে উপভোগ করা যায়। সঙ্গে পাওয়া যায় নতুন নতুন কাজ করার স্পৃহা।
আশিরের কারণে এখন প্রতিবছর একদল জাপানী ছেলে-মেয়ে বাংলাদেশে আসে, সংযোগ করতে। এখলাছপুরে এরই মধ্যে ঘুরে গেছে পাঁচ শতাধিক জাপানী।
আর আশিরের জাপান যাওয়ার কাহিনিটাও অন্যরকম এক জিদের গল্প।
আশিরের আর কোন গল্প আমি বলতে চাই না। তাহলে, আজ যারা এই অসাধারণ অনুষ্ঠানে এসেছিলেন তাদের গল্প করার বাকী থাকবে না। তাই সবটুকু আমি বলছি না।
শুধু এটুকু বলতে পারি, যারা আসবে বলেও আসে নাই কিংবা যারা ভেবেছে কোথাকার কোন আশির আহমেদ, সে আবার কী বলবে, তাদের দু:খ ও বেদনা হবে আকাশ সমান।
কোন কোন অনুষ্ঠান, উপলব্ধি আর আনন্দ কেবল অনুভব করা যায়, লিখে অন্যকে বোঝানো যায় না। যারা আসতে পারলো না, তাদের জন্য করুনা।
আর আশির আহমেদের জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। আমাদের বিডিওএসএন টকসের তৃতীয় পর্বটিকে এক অসাধারণ উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য।
আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন।
আর যারা আজকের অনুষ্ঠানে এসেছেন, তাদেরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
[অনুষ্ঠান শেষে আমরা জাপান কাহিনির দ্বিতীয় খন্ড, জাবেদ পারভেজের “তুমিও পারবে” এবং আমিনুল ইসলামে “উদ্যোক্তার অ আ ক খ” বই-এর মোড়ক উন্মোচন করে সবাই মিলে স্টারে ফালুদা-চা খাইছি।]