গণিত অলিম্পিয়াড- দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব
৬ জন প্রতিযোগী, ৭২ ঘন্টার বিমানযাত্রা, ২৪২ নম্বরের মধ্যে মোট প্রাপ্তি ৩ নম্বর, অনলাইন ফোরামগুলোতে ব্যাপক সমালোচনা (তখন ফেসবুক এরকমভাবে ছিল না, আল্লাহ বাঁচাইছে) এবং আমাদের আত্মবিশ্বাস। ২০০৫ সালে আইএমও (আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড)-তে আমাদের যাত্রা শুরু। যদিও ঘটনা শুরু হয়েছে তারও কয়েকবছর আগে থেকে। দেশে গণিত অলিম্পিয়াড শুরুর গল্পটা আমি আগে অনেকবার লিখেছি তাই নতুন করে লিখছি না। জাফর ইকবাল স্যার আর কায়কোবাদ স্যারের হাতে এর সূচনা।
২০০৫ সালের ৩ পয়েন্টের পর বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভায় আমরা একটা লক্ষ্য ঠিক করি যা ছিল এরকম –
২০০৭ – প্রথম সম্মানজনক স্বীকৃতি, ২০১০ – প্রথম মেডেল, ২০১৩ – প্রথম রূপার মেডেল ইত্যাদি। সেভাবে আমাদের একটা পরিকল্পনা আমরা দাঁড় করাই।
২০০৫ সালের শেষেই মাহবুব মজুমদার দলের কোচ হতে রাজী হলেন। মাহবুবের অসাধারণ একটা ক্ষমতা আছে অন্যদের অনুপ্রাণিত করার। তাঁর সঙ্গে কথা বললে এটা বোঝা খুবই মুশ্কিল হয় যে, এই লোকটি স্ট্যানফোর্ড, এমআইটি আর কেমব্রিজ থেকে যথাক্রমে স্নাতক, মাস্টার্স আর পিএচডি ডিগ্রী নিয়ে ইমপেরিয়াল কলেজের চাকরি ছেড়ে বাংলাদেশে এসে গণিত দলের সদস্যদের কোচিং করান!
মাহবুব কোচের দায়িত্ব নেওয়ার পর আমরা একটা সোয়াট এনালিসিস করি যাতে আমরা বের করি আমাদের শিক্ষার্থীরা কিছুটা হলেও জ্যামিতিতে ভাল। যে কোন কারণেই হোক আমাদের মাধ্যমিক পর্যায়ের জ্যামিতির সিলেবাসটা ভাল। আর নাম্বার থিউরি ও কম্বিনেটরিক্স আমরা পড়িই না। বীজগণিতে সীমাবদ্ধ সূত্রের মধ্যে।
মাহবুব আমাদের দলের জন্য একটা রণকৌশল ঠিক করলো। ২০০৫ সালের ক্যাম্পে আমরা সবকিছু ট্রাই করেছি। জ্যামিতি, নাম্বার থিউরি, কম্বি, বীজগনিত সবই। কিন্তু এখন আমরা পুরো ব্যাপারটাকে একটু অন্যভাবে সাজালাম।
আমরা ঠিক করলাম, যেটা আমাদের শিক্ষার্থীরা পারে, সেটাতে আগে ভাল হতে হবে। মানে জ্যামিতি। ২০০৬ থেকে আমাদের ক্যাম্পগুলোর মুল বিষয় হল জ্যামিতি। আর্ট এন্ড ক্রাফট অব প্রবলেম সলভিং-এর সঙ্গে যুক্ত হল জিওমেট্রি রিভিজিটেড আর জিওমেট্রি আনবাউন্ড। আমরা ঠিক করলাম জ্যামিতিতে সবাই যখন সরগড় হবে তখন আমরা আস্তে আস্তে অন্যগুলোতে আগাবো।
ম্যাজিক দেখলাম স্লোভেনিয়ায়। সোহান আর সৌমেন একটা করে প্রবলেম সলভ করে ফেললো। মানে ২০০৭ এর লক্ষ ২০০৬ এ পূরণ। পরের ইতিহাস প্রায় সবাই জানে। ২০০৯ এ নাজিয়া আর নায়েলের প্রথম ব্রোঞ্জ, ২০১২ তে ধনঞ্জয়ের প্রথম রূপা।
আমাদের গণিত অলিম্পিয়াডের আইওমও টার্গেট স্ট্র্যাটেজির বেশিরভাগই ঠিক হয় আইওমওতে। কারণ আমি আর মাহবুব প্রায় সপ্তাহখানেক খালি এই বিষয়ে আলোচনা করার সুযোগ পাই। ফলে পরবর্তী বছরগুলোর একটা কাঠামো সেখানে দাড় হয়। তারপর এটা শেয়ার করা হয় একাডেমিক ভলান্টিয়ারদের সঙ্গে যেখানে সুপারিশ হয় একশন প্ল্যানের যা কী না শেষ পর্যন্ত ফাইনাল করে কমিটি।
২০১৩ সালে আমরা একটু মনোযোগ ভিন্ন করি। মাহবুবের হিসাবে সোনার পদক পেতে আমাদের একটু সময় লাগবে আর তাছাড়া সোনার পদকের চেয়ে সবার পদক আগে হোক। এবারই সেটা হয়ে যেত যদি সোয়াদ আর ১ নম্বর পেত! মাহবুব আর একটা লক্ষ ঠিক করে – ভারতকে হারানো। তার হিসাবে আমরা ২০১৬তে সেটা পারবো (২০১৩ এর হিসাব)।
কিন্তু, আমাদের খুদে গণিতবিদরা সেটা ২০১৫তেই করে দেখালো।
এবারের অলিম্পিয়াডে প্রায় সব দেশের নম্বর আগের বছরের চেয়ে কমেছে, চীন, আমেরিকাসহ। কিন্তু আমাদেরটা অনেক বেড়েছে। ২০১৪তে ৮৪ পয়েন্ট নিয়ে আমরা ছিলাম ৫৩ নম্বরে। এবার ৯৭ নম্বর নিয়ে ৩৩ তম। ভারত ৩৭তম, পাকিস্তান৮১, শ্রীলংকা ৫১। মানে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবার ওপরে।
ভাবা যায়।
আমাদের রেজাল্ট দেখা যাবে এখানে।
এবারে আমাদের অর্জান একটি রূপা, চারটে ব্রোঞ্জ এবং একটি সম্মানজনক স্বীকৃতি। দলে ছিল সানজিদ আনোয়ার, আদিব হাসান, আসিফ ই এলাহী, সাব্বির রহমান, সাজিদ আখতার তুর্য এবং নাইমুল ইসলাম। সবার রেজাল্ট
এই আমাদের টিম।
তবে, এই অর্জনের দিনে আমার মনে দুটো দু;খ আছে। একটা বিষাদ। আমাদের গণিত অলিম্পিয়াড অনেকের কঠোর পরিশ্রমে আজকের এই অবস্থায় এসেছে। এদের মধ্যে প্রয়াত গৌরাঙ্গ স্যার অন্যতম। তিনি থাকলে আজ অনেক বেশি খুশি হতেন।
আমি একটু বিষাদে আচ্ছন্ন কারণ এই দলে কোন মেয়ে নেই! ২০১১ এর পর থেকে আমাদের দলে কোন মেয়ে নেই। এই নিয়ে আমার মনটা সবসময় একটু বিষাদে আক্রান্ত থাকে। আমি অবশ্য আশাও রাখি যে, আমাদের মেয়েরা নাজিয়া, প্রমির মত আবারও দলে তাদের জায়গা পাকাপোক্ত করে নেবে। পাশাপাশি আমরা ভাবছি বাংলাদেশ গার্লস ম্যাথ অলিম্পিয়াড করার কথাও। দেখা যাক আল্লাহর কী ইচ্ছে।
আগামী শুক্রবার ৩০ অক্টোবর বিকেল তিনটায় আমরা আমাদের গণিত দলের সদস্যদের সংবর্ধিত করবো। সংবর্ধনা হবে কারওয়ান বাজারের সিএ ভবনের ১০ তলার মিলনায়তনে।
আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করবো বিকেল ৩টায়। চলবে ৫-৫.৩০ পর্যন্ত। সবার জন্য এটা উন্মুক্ত।
আমাদের খুদে গণিতবিদদের উৎসাহিত করার জন্য সবাইকে আসতে বলি।
সবার আমন্ত্রণ।
সবার জীবনের সেকেন্ড ডিফারেন্সিয়াল নেগেটিভ হোক।