যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়…
আগেই বলেছি ফার্স্ট ইয়ারে সব নতুনের সঙ্গে ছিল সিভিলের সার্ভে। সিভিল বিল্ডিং-এর উচ্চতা মাইনাস হবে এটা আগে থেকেই জানতাম। সেকেন্ড ইয়ারে এসব কিছু ছিল না, ছিল রেফার্ড আর ইলেকট্রনিক্সের হাতে খড়ি। থার্ড ইয়ারে ওঠার পর মনে হল যাক এতোদিনে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ব্যাপারটা সামনে এসেছে। সবচেয়ে বেশি উত্তেজনা বোধ করলাম মেশিন পড়তে গিয়ে। মেশিন ল্যাবে দেখলাম জেনারেটর ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা যায়। মডেল ল্যাবের মতো কাগজে নয়, একেবারে বাস্তব। মেশিন ল্যাবে কতোগুলো মোটর-জেনারেটর সেট আছে। মোটরটা চালিয়ে জেনারেটরকে ঘোরানো যায়। আর তাহলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। তখন নানান যন্ত্রপাতি দিয়ে সেগুলোর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য পরখ করতে হয়। সত্যি কথা বলতে কী, বুয়েটে এসে আমি সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছি সেশনাল ক্লাশে এবং মেশিন ল্যাবে মনে হয় সবচেয়ে বেশি আরাম পেতাম। আমাদের মেশিন ল্যাবে আসতেন শাহীন স্যার আর মাহমুদ স্যার। দুই জনই নানানভাবে উৎসাহ দিতেন। আমাদের ৬ জনের গ্রুপটাও ছির চমৎকার। যাদের রোল সম্বর ১৯ থেকে ২৪ তারা ছিলাম এই গ্রুপে। তো, মেশিন ল্যাব, ইলেকট্রনিক্স ল্যাব এসবের ডামাডোল আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অংক ছাড়া আর কোন আউল-ফাউল সাবজেক্ট নাই।
তে, একদিন আযম আমাকে বললো থার্ড ইয়ারের শেষে একটা ইন্ডাট্রিয়াল এটাচমেন্ট আছে (সবাই কতো কি জানে)। সেটা খুবই মজার। আমার প্রথমেই মন খারাপ হলো। এর মানে হলো ফাইনাল পরীক্ষার পর চট্টগ্রাম যাওয়া হবে না। হলেই থাকতে হবে। তবে, কয়েকদিন পরেই একটা এক্সাইটমেন্ট হলো। যাক, এবার তাহলে সত্যিকারের একটা প্রোডাকশন হাউসে যাওয়া যাবে। সেকেন্ড সেমিস্টারের শুরুতে দেখা গেল সবাই নিজেদের অপশন খোঁজায় ব্যস্ত। আমি ওতো খোঁজ খবর রাখি না। শেষমেষ যখন দায়িত্বপ্রাপ্ত স্যারের কাছে হাজির হলাম ততোদিন এনার্জি প্যাক, সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন এসব শেষ। ঝাড়াঝুড়া কিছু আছে। স্যার আমাকে বললেন – তুমি কই যেতে চাও? বিটিভি?
আমি মনে মনে বললাম – বিটিভিতে যাবো ক্যান। আমি কি একটিং শিখতে আসছি নাকি বুয়েটে।
গম্ভীর গলায় বললাম – না, স্যার। একটা কোন ভারী জায়গাতে দেন।
স্যার, তাই দিলেন। মেহের ইন্ডাস্ট্রিজ। নিক্কন নামে একটা শাদা-কালো টেলিভিশন তৈরি করে বাংলাদেশে বাজারজাত করে। কাছেই ওদের ফ্যাক্টরি। তা, সই।
১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাসের ২ তারিখে আমাদের তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষ হলো। তারপর ডিপার্টমেন্ট থেকে একটা চিঠি দিল আমাদের। মনে হয়, আমরা ১২ জন হবো। আমরা ৮ বা ৯ তারিখে ঐ চিঠি নিয়ে মেহের ইন্ডাস্ট্রিজে হাজির হলাম। আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানানো হল। একটা রুমে বসানো হল। একটা ছোট কাপে, আধাকাপ করে চাও খেতে দেওয়া হল।
অনেকক্ষন পরে একজন আসলেন। নিজের পরিচয় দিলেন। বললেন – তিনি এই কারখানার ইনচার্জ। আমাদের মতো বুয়েটে পড়ার সৌভাগ্য ওনার হয় নাই কিন্তু কাজ করেছেন, চেষ্টা করেছেন বলে আজ এই ফ্যাক্টরির ইনচার্জ হয়েছেন। আমরা তো আপ্লুত। তারপর তিনি আমাদের নিয়ম কানুন বলে দিলেন। ওনাদের তিনটা প্রোডাকশন লাইন আছে। আমাদের চারজন করে সেই লাইনে ৭দিন ধরে কাজ করবো। পরের সপ্তাহে অন্য লাইনে চলে যাবো।
তারপর উনি আমাদের ফ্যাক্টরির সব কিছু ঘুরে দেখালেন। দেখলাম জাপান থেকে সিকেডি ফর্মে সব কিছু আসে। এখানে কেবল ঝালাই, বাক্সবন্ধী করা আর টেস্টিং করা হয়। টেস্টিং অংশ গিয়ে আমি খুবই আহ্লাদিত হলাম। কারণ টেস্টিং হল সবচেয়ে সহজ। এখানে প্রোডাকশন শেষে একটা টিভি আসে। সেটিকে দীর্ঘসময় চালিয়ে রাখা হয়। যদি ঠিক-ঠাক মতো চলে তাহলে টেস্টিং-এ পাস। যদি গোলমাল করে তাহলে আবার প্রোডাকশন লাইনে ফেরৎ। ভাবলাম যদি কোনদিন এরকম কোথাও চাকরি করতে হয় তাহলে টেস্টিং-এ করবো।
যাহোক দ্বিতীয় দিন যাবার পরে, ঐ ইনচার্জ জানিয়ে দিলেন যা যার লাইনের সুপারভাইজরের কাছে রিপোর্ট করতে হবে। ওনার সঙ্গে আর দেখা হবে না। আর ২১ দিন শেষে আমাদের সার্টিফিকেট দেওয়া হবে, যদি আমরা চাই। তারপরই উনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটা জানালেন, যেটা শোনার জন্য আমরা সবাই উৎসুখ হয়ে বসে ছিলাম।
উনি সেটাই বললেন যা আমরা শুনতে চাই।
“আপনাদের আসা বা না আসাটা সম্পূর্ণ আপনাদের ওপর। যদি আসেন আমার সুপারভাইজররা আপনাদের কাজ শেখার ব্যাপারে সাহায্য করবেন এবং বিভিন্ন বিষয় দেখিয়ে দেবেন। ইচ্ছে করলে আপনারা নাও আসতে পারেন। আমরা কোনদিনই আপনাদের উপস্থিতি চেক করবো না এবং আপনারা যদি না আসেন তাহলে সেটা আপনাদের বিভাগকেও জানাবো না। আপনারা শেষ দিন এসে হাজিরা খাতায় সই করতে পারেন। আপনারা না করলে, আমরাই সেটা করে দিব।”
আমরা তো পারলে একটা চিৎকার দেই। কী আনন্দ। ক্লাশ না করেই এটেনডেন্স। তাৎক্ষণিকভাবে আমরা সিদ্ধান্ত যা নেওয়ার নিয়ে ফেললাম। আমাদের সকলের পক্ষ থেকে ইনচার্জ প্রকৌশলীকে আমাদের হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসা জানালাম। মনের আনন্দে সেদিন বিকেল পর্যন্ত সেখানে থাকলাম। তারপর সেলাম দিয়ে এসে পড়লাম হলে।
পরদিন থেকে রুটিন পাল্টে গেল। অন্যান্য জায়গার খবরও দেখলাম প্রায় একই রকম। যারা হলে থাকে তাদের বেশিরভাগই ঘুরতে টুরতে চলে যায়। আমিও ভাবলাম তাহলে এসব করা যাক। বাড়িতো আর যাচ্ছি না। কাজে সকালে একটু দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা। সাত্তার মিয়ার দোকান থেকে নাস্তা করে গ্যাজানো। তারপর গোছলে যাওয়া। তারপর মধুর কেন্টিনের দিকে রওনা হওয়া। এরশাদ ব্যাটাকে এবার ফেলতেই হবে। মধুর কেন্টিনে তখন প্রবল উত্তেজনা। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রতিদিনই মিছিল করে। সেই মিছিলে যোগ দেই। বিকেলে মধুর কেন্টিন থেকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। তারপর সন্ধ্যায় তোপখানা রোডে পার্টির অফিসে।
পকেটে বাড়তি টাকা নাই। কাজে বুয়েট থেকে মধুর কেন্টিন – হাটো। সেখান থেকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র – হাটো। সেখান থেকে তোপখানা – হাটো। আবার হেটে আইসান উল্লাহ হল। পরের দিনের প্রস্তুতি।
নভেম্বরের ১৫ তারিখটা একই ভাবে শুরু হলো। আমি গোছল সেরে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দারোয়ান চাচা বললেন – আপনার খালার বাসা থেকে লোক এসেছিল।
আমি বললাম – চলে গেল কেন?
দারোয়ান চাচা – আপনি রুমে নাই দেখে আমি ভাবছি আপনি নাই।
দেখলাম খাতার ভিজিটর বই-এ খালার বাসার বাবুর্চি মান্নান ভাই লিখেছে, আমি যেন খালার সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমি একটু ভয়ও পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে দাদীর কথা মনে হলো। আমার দাদী, আমাদের বাড়ির ফিল্ড মার্শাল, বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ। কোন নিয়মকানুন মানেন না বলে তার ডায়াবেটিস প্রেসার কিছুই নিয়ন্ত্রণে নেই।
আামি রুমে গিয়ে কয়েন খুঁজলাম। দেখলাম নাই। তারপর বের হলাম কয়েন খুঁজতে। সিরাজ ভাই-এর দোকানে নাস্তা করে দুইটা কয়েন জোগাড় করে নজরুল ইসলাম হলের হলরুমে চলে গেলাম। এই কয়েনবক্সটাই ঠিক থাকে বেশিরভাগ সময়।
“তোমার দাদা মারা গেছেন আজ সকালে।” ফোনের ও মাথাতে খালার কণ্ঠস্বরটা মনে হল অনেক দূর থেকে শোনা যাচ্ছে।
আমি বললাম – দাদা? দাদা কেন হবে? ওনাকেতো সুস্থ্য দেখে আসলাম। শেষবার হলে আসার আগে বহদ্দারহাটে দাদার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। দাদা আমাকে দেখে বললেন – করিডরের বাতিটা ফিউজ হয়ে গেছে। টাকা দিয়ে বললেন একটা বাল্ব কিনে আনতে। আমি সেটা কিনে এনে লাগিয়ে দিলাম। এসব দেখে দাদী গজ গজ করতে থাকলো – ছেলেটা কালকে ঢাকায় চলে যাবে। তাকে দিয়ে কাজ করাচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। তো, দাদা ঠিক মতো পড়াশোনা করার কথা বললেন আর দাদী বলেন খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করতে।
দাদাকে তো অসুস্থ দেখি নাই।
খালা বললেন – দাদাই। তোমার চাচার বাসাতে ছিল। আজ সকালে ওনার হার্ট ফেইলওর হয়েছে। তুমি বাড়ি চলে যাও।
তখন দুপুর প্রায় ১টা বাজে। এক হলো রূপালীতে যাওয়া। কাজে ব্যাগ গুছালাম। যদিও মেনে নিতে পারছি না। মনে হচ্ছে এমন কেন হবে। রুমমেট-এর জন্য একটা কাগজে লিখলাম – দাদা মারা গেছে। বাড়ি যাচ্ছি। তারপর দারোয়ান চাচাকে বললাম। তারপর ফুলবাড়িয়ায় হাজির হলাম রুপালীর কাউন্টারে। ওরা জানালো দুপুরে কোন বাস চট্টগ্রাম যায় না। বললো কোন ডিরেক্ট বাস এখন সায়েদাবাদেও পাওয়া যাবে না। নন-ডিরেক্ট বাসে সায়েদাবাদ থেকে যাওয়া যাবে।
আমি ভাবলাম তাহলে ট্রেনেই যাই। সায়েদাবাদের আগে তাই কমলাপুরে গেলাম। খোঁজ নিয়ে উর্মি গোধুলির একটা টিকেটও কিনে ফেললাম। তারপর ব্যাগ কাঁধে নিয়ে উঠে পড়লাম ৩টার ট্রেনে। ট্রেনে উঠেই মনে হল – ট্রেন তো আসলে সময় মতো ছাড়ে না। আজকে যে কবে ছাড়বে। তবে, দেখা গেল ঐ দিন ট্রেন ঠিকমতো ছাড়লো।
ট্রেন ছাড়ার পর পরই আমি আমার সহযাত্রীদের অবাক করে ডুকরে কেঁদে উঠলাম।
ততোক্ষণে আমি বুঝে ফেলেছি আমার দেখা প্রথম আধুনিক মানুষটির সঙ্গে আমার আর কখনো দেখা হবে না।
[আমার শিক্ষাজীবনের স্মৃতি চারণ করছি আমি আমার প্রকাশিতব্য বই পড়,পড়, পড়-তে। সময়ে সময়ে তার অংশ বিশেষ থাকে আমার ব্লগে।]