আশিক ও তাঁর প্রিয়শপ ডট কম
“চাকরি খুঁজব না, চাকরি দেব” এই গ্রুপটা করার কারণে কার কী লাভ হয়েছে হিসাব করে বলতে পারবো না, কিন্তু সবচেয়ে বেশি লাভ হয়েছে আমার। একঝাঁক স্বপ্নবান তরুন তরুনীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে, তাদের সঙ্গে কতা বলতে পারি। তাদের কেও ভাই ডাকে আবার অনেকেই স্যার ডাকে। স্যার কেন ডাকে সেটা আল্লাহ ভাল জানেন।
এই এক ঝাঁক তরুন তরুনী যারা আমাকে নিয়ত বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায় তাদের সবার সম্পর্কে আমার লেখার অনেক ইচ্ছে। কিন্তু অলস লোকদের বেলায় কাজটা যে কতোটা কঠিন সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এদের মধ্যে প্রিয়শপের উদ্যোক্তা আশিকুল আলম খাঁন একজন। গ্রুপের মাধ্যমে আশিকের সঙ্গে যখন প্রথম দেখা ততদিনে ও পথে নেমে পড়েছে। স্প্লেন্ডর আইটি নামে একটি আইটি ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেছে ২০১০ সালে। আউটসোর্সিং আর আইটি প্রজেক্টের কাজ করে। কয়েকজন কর্মীও আছে। আইটি ফার্ম বলে আমি প্রথমে ভেবেছিলাম ওর আইটিতেই পড়াশোনা করেছে। পরে বুঝলাম সেটা ঠিক নয়। আশিকের ডিগ্রী ব্যবসা প্রশাসনে। কলেজে পড়ার সময় শখের বমে প্রোগ্রামিং-এ হাতে খড়ি। ছোটবেলা থেকে বিভিন্ন কাজে সামনে থাকার অভ্যাস থাকাই নিজেই একটা কিছু করার ইচ্ছে ছিল। বিবিএ পড়ার সময় প্রথম একটা শিক্ষামূলক ওয়েবসাইট তৈরি করে। ওর ভাষায় “২০০৬ সালে স্টুডেন্ট-উইশের মাধ্যমেই নিজের উদ্যাক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ।”
তবে কেবল আইটিতে মন ভরছিল না। কারণ “মূল্য লক্ষ্য ছিল ই-কমার্স নিয়ে কাজ করার। আমি এবং আমার টিম মূলত ই-কমার্স বিষয়ে বিভিন্ন কিছু শেখার লক্ষ্য নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছিলাম। অতঃপর আমাদের স্বপ্ন সফল করে ২০১৩ সালের ০৭ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করি প্রিয়শপ ডটকমের।” ওদের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের অনুষ্ঠানে আমি হাজির ছিলাম। অবশ্য তার আগে থেকে আমাদের উদ্যোক্তাগ্রুপে আশিক ভাল সময় দিয়েছে। অন্যরকম গ্রুপের কার্যালয়ে আমরা একটা কর্মশালা করি। সেটা ও চালায়।
প্রিয় শপ কেন?
“২০০৭ সালে আমেরিকায় বসবাসকারী একজন বাঙালীর কাজ পাই, ই-কমার্স সাইট করবেন তিনি। ঐ কাজটি করতে গিয়ে বাংলাদেশে একটি পূর্ণাঙ্গ অনলাইন শপিং সাইট শুরুর প্ল্যান মাথায় আসে। মানুষের কাছে যখন সময় কমে এসেছে এবং যানজট ও ব্যস্ততার কারণে যখন শপিং হয়ে উঠেছে দুর্লভ তখন ইচ্ছা জাগে মানুষের দোরগোড়ায় সহজে পণ্য পৌঁছে দিতে। যখন এ প্ল্যান মাথায় আসে তখন এত সময় ও সুযোগ ছিল না। নিজেকে আরো বেশি দক্ষ করে গড়ে তুলতে এই সেক্টরের বিভিন্ন বিষয় শিখতে ও জানতে শুরু করি। সাথে সাথে একটি দক্ষ ও বিশ্বস্ত টিম গঠনে কাজ করি। স্ট্যাডি করি বিভিন্ন অনলাইন শপিং সাইটের যাত্রার কথা ও পরিচালনা পদ্ধতি। কোডিং, এসইও, এসএমএম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনে নিজেকে ব্যস্ত রাখি। সাথে সাথে করি ফ্রিল্যান্সিং ও লোকাল প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন আইটি কাজ। যখন পড়াশোনা শেষ করলাম এবং মনে হলো পুরো উদ্যমে শুরু করতে পারবো তখন পূর্ণরূপে শুরু করি প্রিয়শপ ডটকম।
প্রিয়শপের সেবা
এটি ই-কমার্স সাইটে যা যা থাকে সেগুলো আছে। ক্রেতারা জনপ্রিয় এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য থেকে বিলাসবহুল পণ্যও ক্রয় করতে পারেন সেখান থেকে। বিশেষ ছাড়ে প্রিয়শপ ডটকমে ছেলে-মেয়ের ড্রেস, টি-শার্ট,ফ্যাশন প্রোডাক্ট, প্রসাধনী, ম্যানিব্যাগ, জুয়েলারী, বিভিন্ন উৎসবের গিফট আইটেম, এন্টি-ভাইরাস, জুতা এবং বিভিন্ন সেবা পাওয়া যাবে।আমরা চেষ্টা করছি যেন একজন মানুষের যতরকম পণ্য প্রয়োজন হয় সকল পণ্যের ক্যাটেগরি অনুযায়ী সাজিয়ে ক্রেতাদের কাছে উপস্থাপন করা যায়।
উদ্যোক্তা গ্রুপে আশিক অনেক সময় দেয়। সেই সঙ্গে চেষ্টা করে নতুন উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে। এ জন্য প্রিয়শপ ডটকমের একটি ফিচার হলো এটি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সহায়ক। এসএমই উদ্যোক্তাদের কোন প্রকার সার্ভিস চার্জ ছাড়াই তারা তাদের মার্চেন্ট পার্টনার করে।একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার পক্ষে অনেক টাকা বিনিয়োগ করে বিভিন্ন জেলা শহরে ব্রাঞ্চ খোলা কিংবা তার পণ্য সহজলভ্য করা সম্ভব নয়। কিন্তু সে চাইলে কোন প্রকার বিনিয়োগ ছাড়াই প্রিয়শপ ডটকমের মাধ্যমে পণ্য সরবারহ করতে পারবেন সমগ্র দেশে। ছড়িয়ে দিতে পারবেন নিজের ব্র্যান্ডকে বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্তে।
শুরুর মূলধন
বাংলাদেশের আর দশজন উদ্যোক্তার মতো আশিকের শুরু টিউশন করে জমানো ও বোনদের থেকে টাকা ধার নিয়ে। সেজন্য সে বলে তাঁর মূলধন হলো স্বপ্ল। প্রিয়শপ ডটকম শুরু হতে নিজের অর্থেই এই পর্যন্ত এসেছে।
নিজের চ্যালেঞ্জ
আশিকের মতে দেশে ই-কমার্সের বিকাশের জন্য যে সহায়ক পরিবেশ দরকার তা এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি। বিশেষ করে ডেলিভারি, নিরাপত্তা ইত্যাদির কথা ও বলে। পাশাপাশি বাংলাদেশে এখনও কাস্টোমাররা ই-কমার্সে আগ্রহী হয়ে ওঠেনি। গত ৬ ফেব্রুয়ারি ই-ক্যাবের একটি সেমিনারে আমি এই কথাটা জানতে চেয়েচিলাম। দেখলাম প্রায় ২৫% অংশগ্রহণকারী গত একমাসে একবার হলেও ই-কমার্সে পণ্য/সেবা কিনেছেন।
আগামীর পরিকল্পনা
আশিকের প্ল্যান সামনে আরো বেশি প্রোডাক্ট ক্যাটাগরি এবং নতুন ও ইউনিক পণ্য ও সেবা নিয়ে আসা। ব্র্যান্ডেড প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি লোকাল ভেন্ডর উন্নয়নে কাজ করা। এছাড়া ইকমার্স-এর প্রতি মানুষের আস্থা অর্জনে কাজ করবে প্রিয়শপ ডটকম। ওর ভাষায়, “বাংলাদেশে অনলাইন শপিং-এ ‘প্রিয়শপ ডটকমকে’ বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সর্বোত্তম গন্তব্য হিসেবে দেখতে চাই। শপিংকে কিভাবে আরো সহজ, নিরাপদ এবং আনন্দদায়ক করা যায় এই নিয়ে কাজ করছি আমরা। আশা করছি প্রিয়শপ ডটকমের মাধ্যমে অনেক কিছু শিখতে পারবো, জানতে পারবো, অনেক কিছু করার সুযোগ পাবো। নিজের অর্জিত শিক্ষাকে কাজে লাগাতে চাই।”
আশিকের বাবা ছিলেন সেনাবাহিনীতে। ১৯৯৫-এ বাবাকে হারান আশিক। ৪ বোন ২ ভাই-এর মধ্যে সবার ছোট আশিক। কলেজ জীবনের বান্ধবি এবং এখন স্ত্রী প্রথম প্রতিষ্ঠান থেকে আশিকের সহ-উদ্যোক্তা। গ্রামীণফোনের চাকরি ছেড়ে এখন প্রিয়শপেই থিতু হয়েছেন।
নতুন যারা এই ব্যবসায় আসতে চান তাদের জন্য আশিকের পরামর্শ:
এখন প্রতিদিন নতুন নতুন ই-কমার্স সাইট আসছে। আবার অনেক সাইট আসছে কিন্তু কিছুদিন পর তাদের অস্তিত্ব থাকছে না। যারা এই সেক্টরে প্রবেশ করতে চাচ্ছে তাদের জন্য বলবো, প্রথমে ব্যবসায়ের কাঠামো এবং ব্যবসায় পরিচালনা সম্পর্কে ধারণা নিন। বিভিন্ন কেস স্টাডি করুন, দক্ষ ও বিশ্বস্ত টিম গঠন করুন। তারপর শুরু করুন আপনার উদ্যোগ। হুজুগে পরে সবাই ই-কমার্স ব্যবসায় নামার চেয়ে এর বিভিন্ন সহায়ক সেক্টরে ব্যবসায় উদ্যোগ নিয়ে আসুন যেমন, প্রোডাক্ট ভেন্ডর, ফটোগ্রাফি, কুরিয়ার, ই-মার্কেটিং, কন্টেন্ট রাইটিং এবং এসইও ।
বর্তমানে ২৭ জনের চাকুরির সুযোগ সৃষ্টি করতে পেরেছে আমাদের উদ্যোক্তা আশিকুল আলম খান। প্রায় ২৫০-এর বেশি মার্চেন্টের প্রায় ২০ হাজার পণ্য রয়েছে প্রিয়শপ ডটকমে। নেসলে, স্কয়ার, পিএন্ডজি, এসিয়ান কনজিওমার কেয়ার, ইউনিলিভার, মেরিকো বাংলাদেশ, রোমানিয়া ফুড এন্ড বেভারেজ, ডিগো মোবাইল, সীমান্ত গার্মেন্টস,মাইক্রোম্যাক্স, স্ট্রবেরি মোবাইল, গ্লোবাল ব্র্যান্ডসহ নামিদামি ২০টি ব্র্যান্ডও যুক্ত হয়েছে প্রিয়শপ ডটকমে। প্রায় দশ লক্ষের অধিক ভিজটরের মধ্য হতে ৩ বছরে প্রায় ২লক্ষ গ্রাহককে সেবা দিয়েছে প্রিয়শপ। তাদের ৫০ ভাগ ক্রেতাই ঢাকার বাইরে।
প্রিয়শপ ডট কম নিয়ে আশিক আরো এগিয়ে যাক, প্রিয়শপের তৃতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এই কামনা থাকলো।