আরব বসন্তের সূচনা
রয়টার প্রতিনিধি জনি ওয়েস্ট খুব ভাল আরবী বলতে পারেন। আরব সংস্কৃতিটাও ভাল বোঝেন। এক দশকের বেশি সময় তিনি এলাকাকে কাটিয়েছেন। ২০১১ সালের আরব ঘটনাবলীর পর তিনি আবার সেই শহরেগুলোতে যান, সেখানকার তরুনদের সঙ্গে কথা বলেন, যোগাযোগ করেন তার পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে। নিজের মতো করে তিনি আরব বসন্তকে দেখতে চেয়েছন যা প্রকাশিত হয়েছে তার এই বইতে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফোরার সময় দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে কিনেছি। আহা কেন যে আমাদের এখানে কোন ভাল বইএর দোকান নাই!!
আমার পড়া মানে সেটি সবার সঙ্গে শেয়ার করা। দক্ষিণ আফ্রিকাতে থাকতে ক্রাচের কর্নেল পড়েছি। তার সিকুয়েল হিসাবে এই বইএর কোন বিকল্প হয় না বলে আমার মনে হচ্ছে। এতোটা টাচ্ড যে এয়ারপোর্টেই পড়তে শুরু করেছি।
আবর বসন্তের প্রতি আমার আকর্ষনের অনেক কারণের একটা হলো এর সঙ্গে ইন্টারনেট আর তথ্যপ্রযুক্তির সম্পর্ক। দক্ষিণ আফ্রিকাতে যে কর্মশালায় আমরা গিয়েছিলাম সেখানেও দেখা হল ৫ গ্রুপের মধ্যে তন গ্রপই প্রযুক্তির মাধ্যমে তরুনদের রাজনীতিতে সম্পৃক্তার ব্যাপারটা বিশ্লেষন করা চেষ্টা করেছে। আমি অবশ্য নির্মোহ ভাবে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছি।
বইটির ভূমিকাটি অন্য রকম। কেন অন্য রকম এটা বোঝানোর জন্য শুরুটা আমার ভাষায় লিখে দিলাম।
১.
অন্য দিনগুলোর সঙ্গে তেমন আলাদা ছিল না ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর। দক্ষিণ তিউনিশিয়ার সিদি বও জিদ শহরের মুহামেদ বউয়াজিজি অন্য দিনের মতো তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছে। পাইকারি বাজার থেকে ফল কিনে বউয়াজিজি প্রতিদিন দেড় মাইল দূরে একটি বাজারে বিক্রি করেন। তার নিজের ঠেলাগাড়ি নিয়ে তিনি প্রতিদিন সেখানে যান। কিন্তু ১৭ তারিখ তাকে রাস্তায় আটকালো মহিলা পুলিশ ফাতিহা হামদি। তার অভিযোগ ব্যবসা করার কোন লাইসেন্স জিজির নাই। ঠিক কী হয়েছে এর পরে তা সঠিকভাবে বলা মুশ্কিল। কিন্তু দেখা গেল হামদি একটু পর তার দুজন পুরুষ সহকর্মীকে ডেকে এনেছে। তারা জিজিকে মেরে মাটিতে ফেলে দেয়, তাঁর দাড়িপাল্লা এবং পণ্য সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করে। কেও কেও বলছে হামদি সে সময় প্রকাশ্যে জিজিকে গালে চড় দিয়েছে। অন্য কয়েকজন বলছে সে নিজে কিছু করে নাই খালি তামাশা দেখেছে। অপমানিত ও ক্ষুব্দ জিজি আধা মাইল দূরে পৌরসভাতে গিয়ে মেয়রের সঙ্গে দেখা করতে চান। কিন্তু তাকে জানানো হয় মেয়র মিটিং করছেন, দেখা হবে না।
মুহামেদ বউয়াজিজি তখন একটি দোকানে গেলেন এবং রং করার স্পিরিট কিনলেন। তারপর রাস্তায় দাড়িয়ে সব স্পিরিট তিনি নিজের গায়ে ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিলেন!!!
“আমি আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না” ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আইনজীবী ডাফার আল শালিহি বললেন, “রাস্তার মধ্যে একজন জ্বলন্ত মানুষ”।
সেদিন বিকেলে বউয়াজিজির মা, মেনোবিয়া পৌরসভাতে যান তার ছেলের প্রতি পুলিশের অত্যাচারের কথা বলে তার প্রতিকার চাইতে। কিন্তু কেও তার কথা কানে দিল না। বেচারি, পৌরভবন থেকে বের হয়ে একাই দাড়িয়ে পড়েন রাস্তায়। এক-মানুষ প্রতিবাদে তিনি দাড়িয়ে থাকেন রাস্তায়!
খবর পেয়ে তার ভাগনে, মুহামেদের খালাতো ভাই আলি বউয়াজিজি একটি হাতের ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে সেখানে হাজির হয় এবং কিছু ভিডিও ফুটেজ নেয়। পরে সেটি সে ইন্টারনেটে আপলোড করে। একই দিন, কাতারে আলজাজিরা টিভির সদর দপ্তরে সেটি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করে এবং পুন: প্রচার করে তাদের লাইভ অনুষ্ঠানে !
২৪ ঘন্টার মধ্যে মুহামেদ বউয়াজিজি একটি ছোট্ট শহরের একজন ফেরিওয়ালা থেকে পরিণত হোন লক্ষকোটি আরব তরুনদের প্রতীকে।
এক সপ্তাহের মধ্যে বউয়াজিজি পরিণত হয় জনতার বিপ্লবের প্রতীকে যা এক দশক ধরে ক্ষমতা কুক্ষীগত করে রাখা স্বৈরাশাসককে উৎখাত করে!!!
https://www.youtube.com/watch?v=jHw_auqod6Y
২.
২০১০ সালের জুন মাসের কোন একদিন মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ার উপকূলবর্তী একটি জেলা শহর ক্লিওপেট্ট্রায় ইন্টারনেট ক্যাফেতে আসেন ২৮ বছরের খালেদ সাইদ। খালেদ ইন্টারনেট সেন্টার থেকে বের হওয়ার পর শাদা পোষাকের পুলিশ তাকে ঘিরে ধরে। শুরু হয় সবার সামনে অত্যাচার। মিশরের লোকেরা এধরণের পুলিশি অত্যাচারকে মেনে নিয়েছে কয়েক দশক ধরে। খালেদও হয়তো তাই করতো। তার আত্মীয় স্বজনরা চেষ্টা করতো সে যেন বিচারের আশায় সবাইকে বিপদে না ফেলে। কিন্তু খালেদ মারা গেলেন! তার ভাই, তার অত্যাচারিত মুখের ছবি ইন্টারনেটে প্রকাশ করে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে খালেদের বিষয়টি তার নিজের শহরে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এবং মিসরে বিরোধী দলের আন্দোলনে ঘি ঢেলে দেয়।
কিছুদিন পরে, ভেল ঘোনিম. একজন ইন্টারনেট এক্টিভিস্ট নাম প্রকাশ না করে ফেসবুকে একটি পেজ খুলেন, “We are all Khaled Said” । যখন সে কায়রোর প্রানকেন্দ্র তাহরির স্কোয়ারে একটি সমাবেশের ডাক দেয় তখন প্রায় ৫৫ হাজার লোক সেখানে যোগ দেয়। ২৫ জানুয়ারির সমাবেশে তাদের প্রায় সবাই যোগ দিয়ে সূচনা করে সে বিপ্লবের যার ফলশ্রুতিতে এর মাত্র ১৮ দিনের মধ্যে দেশ ছাড়তে হয় ৩০ বছরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারককে!
৩.
এদিকে লিবিয়ার বেনগাজি শহরের তরুন এডভোকেট ফাতিহ তেরবেল আপীল করেন যেন ১৭ ফেব্রয়ারিকে রাগের দিন (Day of Anger) হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ১৫ বছর আগে আবু সালিম কারাগারে সংগঠিত হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে। জনশ্রুতি আছে সে ঘটনায় ১০০ জনের মতো বন্দী মারা গিয়েছিল। ফাতিহকে গ্রেফতার করা হয়। যখন তার স্বজনরা এর প্রতিবাদ করতে আসে তখন তাদের উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়া হয়। দেশের পুরো পূর্বাঞ্চল ক্ষেপে উঠে ৪১ বছরের শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে!!!
সিরিয়ার দক্ষিণের শহর ডেরাতে একদল স্কুল ছাত্র সরকার বিরোধী চিকা মারার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়। বাহরাইনের রাজধানী মানামার পার্ল স্কোয়ারে প্রতিদন হাজার হাজার জনতা জড়ো হয়ে শ্লোগান দিচ্ছে জনতার স্বাধীনতার। ইয়েমেনের সব শহরে হাজার হাজার জনতা প্রতিদিন প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহর অনুগত বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়!!!
এভাবেই শুরু হয় ২০১০-১১ সালের আরব বসন্তের।
One Reply to “আরব বসন্তের সূচনা”