যদ্যপি আমার গুরু …
[এই পোস্টটি অনেকের কাছে বিজ্ঞাপন মনে হতে পারে। সিদ্ধান্ত নিয়ে তারপর পড়বেন]
একটা সময় আমরা প্রিয়জনকে বই উপহার দিতাম। কারণ আমরা মনে করতাম বই মনের দীনতাকে ঢাকে। এখন আমাদের শরীরের দীনতা অনেক বেশি। কাজে প্রিয়জনকে ঈদে কাপড় উপহার দেওয়ার প্রবণতাই আমাদের বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলামনাই এবং বাংলার চার্লি চ্যাপলিন লর্ড ভানু বন্দোপাধ্যায় বেঁচে থাকলে আমার একথায় সায় মনে হয় দিতেন না। কারণ, পত্রিকা আর ইন্টারনেটে দেখলাম (আমার ফেবু বন্ধ) এবছরের হার্ট থ্রব জামা নাকি সানি লিওনের পোষাক। সেটি আসলে কিসের ময়লা ঢাকে তা বলা মুশ্কিল। ভানু থাকলে বলতেন – “অপচয় না করা হল শিক্ষা। তাই নারীদেহের আবরণ কমতে কমতে সানি লিওনি হয়েছে!!!”
যাক গে, পোষাক আমার এই পোস্টের উপজীব্য নয়। আজ বাসায় ফিরে ঈদের উপহার পেয়েছি। এই উপহারটি গত বছর থেকে পাচ্ছি। স্নেহের ছোট ভাই, অন্যরকম গ্রুপের চেয়ারম্যান সোহাগ এবং এমডি লিটনের পাঠানো ঈদ উপহারের মোড়ক। খুলে পাওয়া গেল বই। প্রথমটা খুলতেই সেখানে আমার গুরুর – যদ্যপি আমার গুরু শুড়িবাড়ি যায়, তদ্যপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায় – মানে আহমদ ছফা রচনাবলীর প্রথম খন্ড!
ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আমার আহমদ ছফার কিছু পুস্তক পড়ার সোভাগ্য হয়েছিল। আহমদ ছফার কিছু চ্যালা চামুন্ডা আমার বন্ধু তালিকায়ও ছিল। তারা সবসময় আমাকে বলতো – একদিন ছফা ভাই-এর কাছে আমাকে নিয়ে যাবে। তবে নয় মন তেলও পুড়েনি, রাঁধাও নাচেনি। আমার আর ছফা ভাই-এর সঙ্গে দেখা হয়নি।
হওয়া দরকার ছিল। কারণ আমার বন্ধুদের ধারণা ছিল আমার ওপর ছফা ভাই-এর একধরণের প্রভাব ছিল???
তো, ছফা ভাই-এর কথা পরে আরো সবিশেষ জানি যখন জাফর স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। জানি যে, স্যারদের মোহাম্মদপুর বাসা থেকে বের করে দেওয়ার প্রচেষ্টার সময় ছফা ভাই একায় লড়েছিলেন।
ছফা ভাই-এর লেখাগুলো আমাদের দেশের হিসাবে সম্ভবত অন্যরকম। এবারের ঈদে তার রচনাবলীর প্রথম খন্ড পড়ে অনেকটা ভাল সময় কাটবে।
সোহাগ আর লিটন বই-এর সঙ্গে একটি ছোট শুভেচ্ছা কার্ডও দিয়েছে। সেখানে লিখেছে বই উপহার দেওয়ার বাঙ্গালি রীতি কীভাবে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। অথচ আমাকে যদি জিঙ্গাষা করে কেও- হোয়াট ইজ দ্যা ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার?
আমি অবলিলায় বলব, নলেজ।
বিশ্বব্যাপী লোকজনের পড়ার আগ্রহ বেড়েছে কয়েকগুন। ইন্টারনেটের প্রবল চাপেও মুদ্রিত বই-এর বিক্রিও বেড়েছে কয়েকগুন। কিন্তু আমাদের দেশে এর উল্টো। আমাদের বই কিনতে হলে সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় মনে হয় – ও, বই। সে তো আমার একটা আছে!!!
এই আশ্চর্য বদ্বীপের সবকিছু হয় ঢাকাতে। সে কারণে ঢাকার বাইরের ভুক্তভোগীরা সহজে বই কিনতে পারে না। সোহাগ-লিটন এটা খেয়াল করেছিল। পরে ওদের সঙ্গে যুক্ত হয় আরো তিন তরুন। যারা সবাই মিলে চালু করেছে রকমারি ডট কম নামে একটি অনলাইন বই-এর দোকান।
আমাদের ই-কমার্সজীবীরা যখন কেমন করে নেটে টাকা নেবে তার জন্য চিন্তিত তখন রকমারি “আগে বই পরে টাকা” নামে একটা পদ্ধতি বের করে ফেলে এবং সারাদেশে মাত্র ৩০টাকায় যে কোন সংখ্যক বই পৌঁছে দিতে শুরু করে।
কাজে এখন ইচ্ছে করলে বাংলাদেশের প্রায় সকল জায়গা থেকে বই কেনা যায় কোন চিন্তা না করে।
৩০ টাকা [এখন মনে হয় ৫০ টাকা] দিয়ে নিশ্চয়ই তোমরা সারা দেশে পাঠাতো পারো না?
“আমরা ভর্তুকী দেই। একদিন সেই ভর্তুকীর অবসান হলে, রকমারি লাভ করবে। আমাদের তাড়া নাই।“ এই হল রকমারির পরিচালকদের মটো।
এখন বই উপহার দেওয়াটাও রকমারির মাধ্যমে সহজ। বই ঠিক করে অর্ডার প্লেস করে যাকে উপহার দিতে হবে তার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলে হবে আর বই-এর দাম দিয়ে দেওয়া যাবে বিকাশের মাধ্যমে।
বিকাশের সঙ্গে যেদিন রকমারির চুক্তি স্বাক্ষর হয় সেদিন আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে থাকার। তার একটা ছবিও আছে দেখলাম!!!
তো, আহমদ ছফায় শেষ নন। কারণ প্যাকেট ছিল দুটো। ছফা ভাই আমার মনোযোগ কেড়ে নেওয়ায় বাকী প্যাকেট খুলি নাই। খুলেছে আমার প্রিয়তমা স্ত্রী। সেখানেও আমার দুইটি প্রিয় বই।
একটি শাহাদুজ্জামানের ক্রাচের কর্নেল।
কর্নেল তাহের আমার ছোটবেলার নায়কদের অন্যতম। গত বছর [২০১২] জোহানেন্সবার্গে একটা ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কশপ করার সময় এই বইটা সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। এবং মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়েছি। ৭৫ এর ঘটনাবলীর এমন চমৎকার লেখা আমি আর পড়ি নাই।
কর্নেল তাহেরের কথা ইদানীং আমার অনেক বেশি মনে পড়ছে পাকিস্তানে ইমরান খানের উত্থান দেখে। ইমরান প্রায় ১৭ বছর আগে ৭-৮জন লোককে নিয়ে একটা যাত্রা শুরু করেছিলেন এবং এবার সেখানকার জাতীয় নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন যদিও আসন বেশি পাননি। ইমরানের সঙ্গে তাহেরের কার্য পদ্ধতির কোন মিল নাই, দেশপ্রেম ছাড়া!
আর শেষ বইটি এমন একজনের লেখা যার উদাহরণ আমি আমার দুইট কর্মস্থলে প্রায়শ দিতাম। তিনি যথন কেবিনেট সচিব ছিলেন তখন ৫টা বাজলেই অফিস থেকে বের হয়ে যেতেন। কেও কোন কাজের কথা বললে তিনি নাকি বলতেন – এখন এই কাজ করে কী হবে, অন্যরাতো নেই। কাল সকালেই এই কাজ করা যাবে। আর আমি যদি রাতে মরি, তাহলে তো তুমি কালকে আর একজনকে পেয়ে যাবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মহাপরিচালকের কাছে আকবর আলি খানের এই গল্প শুনেছি। তার এই কথায় আমি খুজে পেতাম আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাক্যটির প্রকাশ। বুয়েটের কম্পিউটার সেন্টারে (এখনকার আইআইসিটি) আমার বস আলী মর্ত্তুজা স্যার (পরে বুয়েটের ভিসি) প্রায় সময় এই কথাটি আমাকে বলতেন-
নোবডি ইজ ইনডিসপেনসেবল। গ্রেভইয়ার্ড ইজ ফুল অব ইনডিসপেনসেবল পিওপল। পৃথিবীতে কেও অপরিহার্য হয়। সব অপরিহার্য লোকেরা কবরস্থানে শুয়ে আছে।
স্যারের আন্ডারে কাজ করার আগ পর্যন্ত প্রায়শ আমার মনে হত – বেঁচে থাকার কারণ কী? সেই সময় আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জীবন দর্শন পূর্ণতা পায়।
তো, আকবর আলি খান অবসরের পর অর্থনীতি এবং রাজনীতি নিয়ে অনেক লেখা লিখেছেন। এই বইটি তার সংকলন।
সোহাগ আর লিটনের ঈদ উপহার আমার মনের অর্গল খুলে দিয়েছে। আমি ভাবছি আমিও আমার কয়েকজন প্রিয়জনকে ঈদে বই উপহার দেবো। রকমারির মাধ্যমেই দেবো।
আমরা যে জ্ঞানভিত্তিক সমাজেরকথা ভাবি সেটার মূল উপকরণ কিন্তু বই। কারণ সেটি জ্ঞানের আকর। আমি খুশী যে, আমার ছেলের আমার মত বই পড়ার আর কেনার অভ্যাস হয়েছে। ওর মধ্যে বই উপহার দেওয়ার তাগিদটা ঢুকিয়ে দিতে পারলেই আমরা কাজটা হয়ে যাবে।
যারা প্রিয়জনকে এই ঈদে কী উপহার দেবেন সেটা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে আছেন, তারা অবলিলায় বই-এর কথা ভাবতে পারেন। আর যদি জ্যাম ঠেলে বই-এর দোকানে যেতে না চান তাহলে বই পৌছে দেওয়ার কাজটা রকমারির হাতে ছেড়ে দিতে পারেন।
সবার ঈদের আনন্দের সেকেন্ড ডিফারেন্সিয়াল নেগেটিভ হোক।
পুনশ্চ: যারা রকমারির মাধ্যমে আমাকে বই উপহার দেবার কথা ভাবছেন তাঁরা আমাকে মেসেজ পাঠালে আমার বাসার ঠিকানা দিয়ে দেবো। তাহলে আপনাদের এবং আমার- সকলের ঈদ আনন্দ পূর্ণ হবে!!!