আশা জাগানিয়া আবু ‘জন’ শোয়েব
২০০৯ সালের মাঝামাঝি। একদিন কথা প্রসঙ্গে জাফর স্যার (মুহম্মদ জাফর ইকবাল) আমাকে বললেন, ‘শোয়েবকে আমরা নেব বলে ঠিক করেছি। ওকে আমাদের দরকার। তুমি ওকে ছেড়ে দিয়ো।’ আমার মনে পড়ল, কিছুদিন আগে শোয়েব ছুটি নিয়ে সিলেটে গেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগে লেকচারার পদে নিয়োগ পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। জাফর স্যারের কথা শুনে বুঝলাম, শোয়েবের আমাদের প্রকল্পে কাজ করার মেয়াদ শেষ। বিদায় নেওয়ার দিন শোয়েব আমাকে বলে গেল, ‘স্যার, যা যা আপনারা করতে পারেননি, তার সবই আবার করার চেষ্টা করব।’ শোয়েব আমাদের শাবিপ্রবি ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের স্বেচ্ছাসেবক ছিল, আমার সহকর্মী ছিল সাত-আট মাস। কাজেই আমি জানি, ও যা বলে যাচ্ছে তা করবেই। তবে গিয়েই যে শুরু করে দেবে তা বুঝিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষার সময় শিক্ষার্থীদের যে ভোগান্তি হয়, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সেটি সহজে দূর করা যায়। এমন একটি বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাজি করানোর জন্য আমি চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। শিক্ষা বোর্ডের ডেটা ব্যবহার করার আমার ধারণার সঙ্গে জাফর স্যার মুঠোফোনে ভর্তি ফি নিয়ে যাওয়া যায় কি না, সেটাও বিবেচনা করতে বলতেন। কয়েক বছর ধরে তিনি এভাবে ভর্তি-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলে প্রস্তাব দিলেও সেটা পাস হতো না। মনে হলো, শোয়েব বিভাগে যোগ দিয়ে এ বিষয়টিকে তার প্রথম কাজ হিসেবে নিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য সালেহ স্যারও মুঠোফোনের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন। তবে কোনো একটি বায়বীয় ধারণাকে মাঠে নামিয়ে দেওয়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। কারণ তখনো আমরা জানতাম না, শিক্ষা বোর্ড তাদের এসএসসি আর এইচএসসি ডেটার মধ্যে কোনো সম্পর্ক রক্ষা করে না, এ/ও লেভেলের শিক্ষার্থীদের ডেটা কীভাবে পাওয়া যাবে। ১৯ আগস্ট ঢাকায় জাফর ইকবাল স্যারের বাসায় একদল প্রযুক্তিবিদ জড়ো হলো।
সেদিন বসে চূড়ান্ত করা হলো ডিজিটাল ভর্তি পরীক্ষা-পদ্ধতির পুরো প্রক্রিয়া। পরের ঘটনাগুলো আমরা জানি। একদল তরুণ সহকর্মীকে নিয়ে জাফর স্যারের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচিত হলো। সেই ইতিহাস রচনার সমন্বয় করেছে বিভাগের কনিষ্ঠতম শিক্ষক আবু আউয়াল মোহাম্মদ শোয়েব। শোয়েবের কারণেই এ কাজটি ভর্তি পরীক্ষা পর্যন্ত হয়ে থেমে যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়ার শেষ ধাপ পর্যন্ত এগিয়ে গেছে। সমন্বয় ছাড়াও প্রোগ্রামিং কোডিংয়ের বেলায়ও শোয়েবকে সমান তালে দৌড়াতে দেখা গেছে। ন্যূনতম কাগজের ব্যবহারে ২০০৯ সালের শাবিপ্রবির ভর্তি-প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। অহেতুক দুবার আসা-যাওয়া করতে হয়নি বলে এই ব্যাচে মেয়েদের ভর্তির হারও বেশি হয়েছে। ফটোকপি, ফরম আর বাড়তি যাতায়াতের ব্যাপার না থাকায় কতটা কার্বন নিঃসরণ কম হয়েছে, তা অবশ্য হিসাব করা হয়নি, তবে সামনে নিশ্চয়ই হবে। এই পদ্ধতি যখন সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চালু হবে, তখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সত্যিকারের দিনবদল দেখতে পাব।
ইতিহাস একা রচনা করা যায় না। শোয়েব নিজের কৃতিত্বের চেয়ে বেশি কৃতিত্ব দেয় তার সহকর্মী, শিক্ষক আর বিভাগের অ্যালামনাইদের। তবে আমি আর জাফর স্যার জানি, শোয়েবের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে।
শোয়েবের লেগে থাকার ব্যাপারটা আমি দেখেছি, যখন সে ইউএনডিপিতে আমার সহকর্মী ছিল তখন। আমাদের প্রকল্পের কম্পিউটার ল্যাবটিকে ওপেন সোর্স সফটওয়্যারভিত্তিক ল্যাবে পরিণত করা, সরকারের কয়েকজন কর্মকর্তার ম্যাট প্রকল্পের একটি পাইলট উদ্যোগে সহায়তা করা কিংবা আমাদের প্রকল্পের কাজকর্মে একটি গোছানো ভাব এনে দেওয়া—সবকিছু সম্ভব হয়েছে শোয়েবের উদ্যোগে। এসব কাজের ফাঁকে ফাঁকে শোয়েবের গবেষণাকাজেও কমতি ছিল না। এরই মধ্যে তার তিনটি পেপারও প্রকাশিত হয়েছে এবং বিভিন্ন কনফারেন্সে যোগদান করেছে।
শোয়েবের মাথা আর হূদয়ের মাঝখানে এই ছোট্ট দেশটি রয়েছে প্রবলভাবে। ঢাকা ছেড়ে সিলেটে ফিরে যাওয়ার দিন বলেছিল, ‘স্যার, আমাদের শিক্ষার্থীদের নানা রকম সমস্যা। তাদের সমস্যা সমাধানে কাজে লাগতে চাই। কেবল পড়িয়ে নিজের দায়িত্ব শেষ করতে চাই না।’
শোয়েব সে কাজটি করছে বিশ্ববিদ্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে। সিলেটে গিয়ে সংগঠিত করেছে শাবিপ্রবির কম্পিউটারবিজ্ঞানের অ্যালামনাইদের। তাদের রাজি করিয়েছে শহরে আইটি প্রশিক্ষণ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করা, সদ্য পাস করা স্নাতকদের নানাভাবে সহায়তা করা এবং তাদের কাজের ক্ষেত্র শনাক্তকরণে সহায়তা করার জন্য।
মাত্র কয়েক দিন আগে (৮-১০ এপ্রিল, ২০১০) শাবিপ্রবিতে হয়েছে সিএসি কার্নিভাল, যেখানে আবার শুরু হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জাতীয় প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আসর। যথারীতি আয়োজকদের মধ্যমণি ‘শোয়েব স্যার’।
সদা হাস্যময় শোয়েব বই পড়তে ভালোবাসে। একটি জ্ঞানভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে, শোয়েবের মতো শিক্ষকেরা সেটিকে একটি চূড়ান্ত গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।
[২০১০ সালে শোয়েবকে নিয়ে এই লেখাটা লিখেছিলাম। এখন তো বেচারাকে আমার মেজোমেয়ের সকল অথ্যাচার সহ্য করতে হয়। আশা করি ভাল আছে। আমার ধারণা শোয়েবকে নিয়ে আমারে আরও লিখতে হবে। সেজন্য তার জন্মদিনে এই লেখাটা আমার সাইটে এনে রেখে দিলাম। শোয়েব এখন পিএইচডি করছে আমেরিকায়]
পুনশ্চ: আবু শোয়েব নামে জিমেইল একাউন্ট খুলতে না পারে শোয়েব জনশোয়েব নামে একাউন্ট খোলে। আনীরের তাতে জিজ্ঞাষা – স্যার জন?