আমাদের জাহিদ হাসান
আজকের ডিজিটাল যুগের প্রাণভোমরা হল ছয় দশক আগে উদ্ভাবিত ট্রানজিস্টর। আর এই ট্রানজিস্টরের বদৌলতে আজকের কম্পিউটার, স্মার্টফোনসহ সকল ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর জয়জয়কার। কিন্তু এরই মধ্যে ট্রানজিস্টর তার কর্মদক্ষতার প্রায় সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে। তাই বিজ্ঞানী-প্রকৌশলীরা খুঁজছেন নতুন কোনো বস্তু কিংবা বস্তুর নতুন কোনো অবস্থা যা দ্রুতগতির কম্পিউটিং-এর সহায়ক হবে এবং পাশাপাশি তাতে শক্তির ক্ষয়ও হবে কম।
ঠিক এমনই একটাকিছু খুঁজে পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, জার্মানি ও সুইডেনের একদল বিজ্ঞানী। আর এই বিজ্ঞানীদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক জাহিদ হাসান, বাংলাদেশের মন্তান। বিজ্ঞানীদের আবিস্কৃত নতুন এই বস্তু-দশার (state of the matter) দেওয়া হয়েছে ‘টপলোজিক্যাল ইনসুলেটর’ বা ‘জ্যামিতিক অন্তরক’। বস্তুর ভিতরে ঋনাত্বক বিদ্যুৎবাহী ইলেকট্রন কনার চলাচলের ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা বস্তুকে কয়েকভাগে ভাগ করেন। যার মধ্যে ইলেকট্রন সহজে চলাচল করতে পারে (পরিবাহী), যার মধ্যে পারে না (অন্তরক) এবং এই দুই-এর মাঝামাঝি (অর্ধ-পরিবাহী বা অর্ধপরিবাহীর ভিতরে ঋণাত্মক ইলেকট্রনের পাশাপাশি ধনাদ্মক চার্জেরও ছোটাছুটি থাকায় এটি হয়ে ওঠেছে ইলেকট্রনিক্সের মূল উপকরণ। বালির মূল উপাদান সিলিকন এবং জার্মেনিয়াম হল অর্থপরিবাহীর উদাহরন। এই কারণে আমেরিকার ডিজিটাল কর্মকাণ্ডের এলাকাটি সিলিকন উপত্যকা নামে পরিচিত। এছাড়াও রয়েছে অতিপরিবাহী বা সুপার কন্ডাক্টর। অতিপরিবাহীয় ভেতর দিয়ে ইলেক্ট্রন কোন শক্তি খরচ না করেই চলাচল করতে পারে কিন্তু বাস্তব তাপমাত্রায় এখনো কোন অতিপরিবাহী পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে জাহিদ হাসান বিভিন্ন মৌলিক পদার্থে তথা বিসমাথ, থ্যালিয়াম, সালফার ও সেলেনিয়ামের সংমিশ্রনে যেযৌগ তৈরি করেছেন সেটি এমনিতে অন্তরক। কিন্তু এটির উপরিতলে ক্ষুদ্রতিক্ষুদ্র কণার জগতে ইলেকট্রন খুবই কম বাঁধার মধ্যে ছুটাছুটি করতে পারে। অনেকটা অতি-পরিবাহীর মত।
‘এটি একটি বড় বিষয়।’ টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলে জাহিদ হাসান। ‘কারণ দেখা যাচ্ছে আগের বিসমাথ-নির্ভর বস্তুর তুলনায় নতুন এই বস্তুতে ইলেক্ট্রন পায় ১০ হাজার গুণ বেশি গতিতে চলাচল করতে পারছে।’
১৯৯৭ সালের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ফিলিপ এন্ডারসনের মতে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ আবিস্কার। কারণ কেবল তত্ত্বের কারণে নয় বরং এর কারিগরি দিকটিও তাৎপর্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে অনেকদিন ধরে তত্ত্বীয় পর্যায়ে থাকা কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করা যাবে।
জাহিদ হাসান আরো বলেন, ‘কেবল কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের নতুন জোয়ার নয় এর ফলে বস্তু জগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশে যেখানে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা কাজ করে সেটির অধ্যায়নও খুবই জোরালো হয়ে উঠবে।’ আর যেহেতু কার্যকর তাপমাত্রায় এটি বানানো যাবে। শুরু হবে এক নতুন ইলেকট্রনিক্সের যুগের। যার কেন্দ্রে থাকবে এই জ্যামিতিক অন্তরক। হয়তো তখন সিলিকন ভ্যালির নাম পাল্টে হবে টপোলজিক্যাল ভ্যালি।
অ্যাডভোকেট রহমত আলী ও গৃহিনী নাদিরা বেগমের দুই ছেলে ও একমেয়ের মধ্যে জাহিদ সবার বড়। ধানমন্ডি সরকারি বালক বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে সম্মিলিত মেধা তারিকায় দ্বিতীয় ও ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসিতে প্রথম স্থান অধিকার করে জাহিদ ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু প্রায় সোয়াবছরেও ক্লাশ শুরু না হওয়ায় পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে।
ছোট বেলায় উপহার পাওয়া একটি কম্পাস জাহিদকে প্রথম জগতের রহস্য অনুসন্ধানে আগ্রহী করে তোলে। কম্পাসের কাঁটা ভেঙ্গে যাওয়ার পর কোনো এক ‘অদৃশ্য শক্তি’র প্রভাবে সেটি উত্তর-দক্ষিণ হয়ে থাকে তা ছিল শিশু জাহিদের পরম বিস্ময়। পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞান-লেখক আবদুল্লাহ আল মুতীর বিজ্ঞান বিষয়ক বই জাহিদকে বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় জাহিদ নিজেই লিখে ফেলেন বই—এসো ধূমকেতুর রাজ্যে।
বিজ্ঞানের নানান বিষয় পড়তে পড়তে জাহিদের মনে আইনস্টাইনের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার ইচ্ছা তৈরি হয়। ‘কিন্তু সে সময় গণিত অলিম্পিয়াড ছিল না। যুক্তরাস্ট্রে ভর্তির ব্যাপারে সাহায্য করারও কেউ ছিল না।’ জাহিদ জানালেন—‘আমি আইসস্টাইনের বিশ্ববিদ্যালয় প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলাম না।’ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন ভাইনভার্গের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ নিতে জাহিদ ভর্তি হলেন অস্টিনের টেক্সাস বিদ্যালয়ে। সেখানে পদার্থবিজ্ঞান থেকে স্নাতক হয়ে পরে স্ট্যানফোর্ডে পিএইচডি করেন। পিএইচডি করার সময় জাহিদ বের করেন কঠিন বস্তুর মধ্যে ইলেক্ট্রনের চারটি কোয়ান্টাম সংখ্যা বের করার কৌশল। এই কাজের ফলে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে পড়ানোর জন্য আমন্ত্রণ জানায়।
‘আমি একটা বক্তৃতা দিতে গিয়েছি প্রিন্সটনে। বক্তৃতা শেষেই তারা আমাকে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। আমার তখন, এমন কী কোন জীবন বৃত্তান্তও তৈরি ছিল না। পিএইচডিও শেষ হয়নি।’ আরাধ্য স্বপ্ন ধরা দেওয়ার কথা বলছিলেন জাহিদ। বিজ্ঞানী মহামতি আইনস্টাইন, নীলস বোর, ওপেন হাইমারের স্মৃতিবিজড়িত প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়ে আর কোন দ্বিধা করেননি জাহিদ। সেই ২০০২ সাল থেকেই প্রিন্সটনই তার কাজের ক্ষেত্র। এরই মধ্যে প্রায় ২০ জন শিক্ষার্থী তার তত্ত্বাবধানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছে। এদের মধ্যে একজন ছাড়া বাকি সবাই কোনো না কোনো পরীক্ষাগারে বিজ্ঞানী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে বর্তমানে কাজ করছেন।
শুরুর দিকে দুনিয়ার জন্ম-মৃত্যুর তত্ত্ব নিয়ে কাজ করলেও বিজ্ঞানী স্টিভেন ভাইনবার্গ জাহিদকে ব্যবহারিক পদার্থ বিজ্ঞানে আগ্রহী করে তোলেন। সেখানে আইনস্টাইনের আলোর তড়িৎ ক্রিয়ায় ব্যবহৃত পদ্ধতি ব্যবহার করেই নতুন এক জগতের সন্ধান পান জাহিদ। ক্রমেই হয়ে ওঠেন এই জগতের একেবারেই সামনের কাতারের বিজ্ঞানী। তার প্রকাশিত শতাধিক বৈজ্ঞানিক নিবন্ধের দুই তৃতীয়াংশই ছাপা হয়েছে ‘নেচার’, ‘ফিজিক্স টুডে’, ‘সায়েন্স’, ফিজিক্যাল রিভিউর মতো বনেদি, অভিজাত ও বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকীতে।
মাইক্রোসফট কর্পোরেশনে কর্মরত স্ত্রী প্রকৌশলী সারাহ আহমেদ, পুত্র আরিক ইব্রাহিম ও কন্যা সারিনা মরিয়মকে নিয়ে জাহিদের সংসার। শেকড়ের টানে যুক্ত আছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা বোর্ডে । সুযোগ পেলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করার আগ্রহ রয়েছে জাহিদের।
2 Replies to “আমাদের জাহিদ হাসান”
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.
আবারও স্যারের অসাধারণ উপস্থাপন শৈলীতে জানলাম আমাদের স্বেচ্ছা ঢাবি ত্যাগী ও ইলেক্ট্রনকে ১০ হাজার গুণ বেশি গতিতে দৌড়ানি দেয়া জাহিদ হাসানকে!
তবে এই মহান মানুষটি সুযোগ পেলেও আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কোন ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে মনে হচ্ছেনা! তার আগে আমাদের ক্লাস ফাইভে পি.এইচ.ডি করানোর অন্যতম পথিকৃৎ আমাদের মহাক্রমশালী শিক্ষা মন্ত্রি তাকে ২০ হাজার গুন গতিতে দৌড়নি দিয়ে দিবেন!
ধন্যবাদ স্যার জাহিদ হাসানকে জানানোর জন্য। আমাদের দেশের সোনার ছেলেদের গল্প শুনলে গর্ব হয় যে আমি একজন বাংলাদেশী।