মাঠে যখন বদলায় ধান
[বাংলার ঐতিহ্য হাজার জাতের ধান। এর বেশির ভাগই বিকশিত হয়েছে প্রকৃতিতে, মাঠে। বাংলার কৃষকবিজ্ঞানীর হাতে পরিবর্তিত হয়েছে ধান, বদলে গেছে। আধুনিক বিজ্ঞানের ব্রিডিং, জিন-প্রকৌশল এবং হালের এপিজেনেটিক্স এই বদলে যাওয়ায় এনেছে নতুন আলোড়ন। ল্যাবরেটরির বদ্ধ গণ্ডি থেকে ধানের বিজ্ঞানকে বাংলার কৃষকবিজ্ঞানীদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন জিনবিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী। মৌলভীবাজার জেলার হাজীপুর গ্রামে মাঠে মাঠে ধানের বদলে যাওয়ার এই কাব্যটি লিখেছিলাম প্রথম আলোর বিজ্ঞান প্রজন্ম পাতায় ]
মৌলভীবাজার জেলার শমশেরনগর রেলস্টেশন থেকে হাজীপুর গ্রামের দূরত্ব প্রায় ছয় কিলোমিটার। রিকশায় প্রায় আধা ঘণ্টা লাগে। সেই গ্রামের যে কাউকে বললে আপনাকে দেখিয়ে দেবে বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরীর বাড়ি। তাঁর বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে, ধানক্ষেতে গড়ে উঠেছে এক আধুনিক পরীক্ষামাঠ। দূর থেকে দেখলে বোঝা যায়, এতে নানা জাতের ধানের আবাদ হচ্ছে। বলা ভালো, ‘এক্সপেরিমেন্ট’ হচ্ছে। ‘এখানে প্রায় ১০১ রকমের ধান লাগানো হয়েছে।’ ছোট্ট একটি ব্লক দেখিয়ে জানালেন ব্রিডার মজিবর রহমান। ভাইটা গ্রেইন সংস্থার অন্যতম ব্রিডার। উদ্দেশ্য, ১০১ রকমের ধানের প্রাকৃতিক সংকরীকরণের ব্যবস্থা করা।
আমাদের দেশীয় জাতের এই ধানগুলোর কোনোটির ফলন বেশি, কিন্তু স্বাদ কম। কোনোটি সুগন্ধি, কিন্তু ফলন কম। প্রকৃতির পরীক্ষাগারে অবাধে সংকরীকরণের সুযোগ পেলে নতুন কোনো জাত কি পাওয়া যাবে, যার ফলন বেশি, আবার সুগন্ধিও?
‘পাওয়া যেতেও পারে।’ বলেন বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী। ‘ধানের বিবর্তন যে কেবল ডিএনএর পরিবর্তনের ফলেই হবে, তা চূড়ান্ত নয়। এখন আমরা এপিজেনেটিক্সের কথা বলছি। বার্তাবাহক আরএনএ যদি ঠিক সময়ে ঠিক বার্তা পৌঁছাতে না পারে, তাহলেও বদলে যেতে পারে মাঠের ধান। আমরা সেই বদলটাই দেখতে চাইছি।’
১০১টি ধানের প্লটে দেখা গেল, কোনো কোনো ধানগাছ বেশ সরেস। সেগুলোর ধানে চিটা কম। আবার কিছু কিছু ধান চিটাসর্বস্ব। একাধিক ট্রায়ালের পর বেশ কিছু নতুন উচ্চফলনশীল জাতের খোঁজ পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন বিজ্ঞানী।
কেবল নিজেদের প্লটে নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে বিজ্ঞানীর চোখ নিয়ে খুঁজে বেড়ানো হচ্ছে নতুন ধানের জাত। এমনি একটি বিশেষ জাতের খোঁজ পেয়েছেন মজিবর রহমান। সেটিও লাগানো হয়েছে মাঠের এক কোণে। ‘দেশীয় এই জাতের ফলন বেশ ভালো। গড়পড়তা হাইব্রিড ধান থেকেও বেশি।’ এটি একটি নতুন জাত কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য এর জিন-নকশা উন্মোচন করা হবে। এর আগে আরও কয়েকটি ট্রায়াল দেওয়ার পর তার মান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে ।
১ দশমিক ৮ মিটার উঁচু!
মাঠের এক কোণে কয়েকটি ধানগাছ দেখা গেল বেশ লম্বা, উঁচু। পাশে দাঁড়ানোর পর তা ছাড়িয়ে গেল বিজ্ঞানীর মাথা! ‘এই ধান গাছ উচ্চতায় প্রায় ১ দশমিক ৮ মিটার হয়েছে।’ জানালেন ব্রিডার মজিবর। এটি তাঁদের প্রতিষ্ঠানের একটি নিজস্ব হাইব্রিড ধান। বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরীর গবেষণা থেকে প্রাপ্ত। এটির ফলন আমাদের উফশী জাতের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি হবে বলে আশা করা হচ্ছে!
চাষ একবার, ফসল তিনবার
সাধারণভাবে ধানগাছ থেকে ফসল পাওয়া যায় একবার। কাজেই কেউ কখনো এক গাছ থেকে একাধিকবার ফসল পাওয়ার কথা ভেবেছেন কি না, তা এই প্রতিবেদকের জানা নেই। তবে সেটি যে অসম্ভব নয়, তা জানা গেল হাজীপুর গ্রামে।
ভাইটাগ্রেইনের বিজ্ঞানী-ব্রিডাররা এমন ধান খুঁজে পেয়েছেন, যার চারা একবার রোপণ করে তিনবার ফসল পাওয়া সম্ভব! জানা গেছে, এ ধান লাগানোর ১০০ দিনের মাথায় প্রথম ফসল দেয়। একটি বিশেষ নিয়মে সেই ধান কেটে নেওয়া হয়। মাঠে থেকে যায় ধানগাছের অবশিষ্ট অংশ। এরপর সেখানে পানি ও সার দেওয়া হলে পরবর্তী ৫০ দিনের মাথায় আবার ধান পাওয়া যায়। এবার অবশ্য প্রথমবারের তুলনায় ৬০ শতাংশ ফলন পাওয়া যায়। তারপর আবার কেটে নিয়ে পরিচর্যা। আর শেষ ৫০ দিন পর তৃতীয়বারের ফলন পাওয়া যায়, প্রথমবারের ৪০ শতাংশ। অর্থাত্ ২০০ দিনের মধ্যে তিন বারে দ্বিগুণ ফলন! বন্যা মৌসুমে নতুন বীজতলা তৈরি করা কৃষকের জন্য যেমন কঠিন, তেমনি বন্যার পানিতে ডুবে থাকা মাঠে সেই চারা রোপণ করাও সহজ নয়। এ ধান কৃষককে সেই কষ্ট থেকে বাঁচাবে। কারণ, নতুন করে বীজতলা তৈরি করতে হবে না। ‘চ্যালেঞ্জ হলো এক মৌসুমের ধানকে অন্য মৌসুম পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া’—জানালেন আবেদ চৌধুরী। ধানের সেই বৈশিষ্ট্যটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে হাজীপুর গ্রামে। সে ক্ষেত্রে বোরো মৌসুমে চাষ করে শাইল মৌসুম পর্যন্ত ফসল তোলা যাবে।
উচ্চফলনশীল, সুগন্ধি
দেশীয় জাতের সুগন্ধি চাল, যেমন- কালিজিরা বা স্বর্ণজিরার ফলন কম। জিন-প্রকৌশল করে উচ্চফলনশীলের বৈশিষ্ট্য যদি এসব ধানে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে কালিজিরার ফলনও হবে বেশি। কালিজিরা, কাটারিভোগের মতো চিকন ধানগুলোর ফলন বাড়ানোর চেষ্টাও হচ্ছে হাজীপুর গ্রামে। ভবিষ্যতে উচ্চফলনশীল সুগন্ধি চাল খুঁজে পাবেন বলে আশা করছেন হাজীপুরের বিজ্ঞানীরা।
এসবের পাশাপাশি সাদা মাদার, কালো মাদার নামের দুটি বিশেষ জাতের ধানের পরীক্ষা করা হচ্ছে সেখানে। এ দুটি জাতই বেশ উন্নত এবং উচ্চফলনশীল। রয়েছে দক্ষিণবঙ্গের ধানের চাষও।
বিশ্লেষণ, পরীক্ষা, বিশ্লেষণ
দুই বছর ধরে মাঠে ধানের এই পরীক্ষা শুরু করেছেন বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরী। সংকরীকরণ এবং ডিএনএ সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে দেশীয় ধানগুলোর বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করা হচ্ছে। এগুলোর কোনোটি লবণাক্ত সহনীয়, কোনোটি বন্যার পানি বাড়লে নিজেই বেড়ে ওঠে। কোনো কোনোটি সুগন্ধি চাল দেয়, কোনোটি মাত্র ৬০ দিনে ফলন দেয়। দেশীয় ধানের নানা বৈশিষ্ট্যের একটি সমৃদ্ধ তথ্যভাণ্ডার গড়ে তোলার ইচ্ছা বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরীর। নতুন উন্নতজাতের ধান খুঁজে বের করার পাশাপাশি তিনি আমাদের কৃষকবিজ্ঞানীদের পরিচয় করিয়ে দিতে চান আধুনিক ধানবিজ্ঞানের সঙ্গে। তাঁর মাঠে আমাদের দেখা হয়েছে বর্ষীয়ান কৃষক আবদুর রহিমের সঙ্গে। তিনি জানালেন, নতুন যে জাতগুলো দেখা যাচ্ছে, তার কোনো কোনোটিতে এমন বৈশিষ্ট্য দেখেছেন, যা তাঁর বাবা-দাদাদের কাছে শুনেছেন।
মাঠে মাঠে ধানের বদলে যাওয়ার গল্প নতুন নয়। মাঠের ধানের এই বদলকে নিজেদের জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়েছেন আমাদের কৃষকবিজ্ঞানীরা। দক্ষিণবঙ্গের হরিপদ কাপালি ও তাঁর হরিধান এভাবে ধানের দিনবদলের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। আমাদের কৃষকের রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত চোখ, রয়েছে ফসল ও মাঠের প্রতি পরম মমতা। এখন তাঁদের হাতে তুলে দিতে হবে নতুন বিজ্ঞানের উপকরণ, জিনবিজ্ঞানের হাতিয়ার, বীজ সংরক্ষণের কৌশল। তাহলেই তাঁরা আমাদের খাদ্যনিরাপত্তার প্রাচীর গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন। বদলাবে আমাদের কৃষকের জীবন।
কৃষিকে ভিত্তি করেই রচিত হবে বাংলাদেশে দিনবদলের কাব্য।