ডোন্ট ট্রাই -চেষ্টা করো না

Spread the love
চার্লস বুকোস্কি (আগস্ট ১৬, ১৯২০- মার্চ ৯, ১৯৯৪)

চার্লস বুকোস্কির নাম জানার কোন কারণ নেই। ক’দিন আগে আমিও তাকে চিনতাম না। বুকোস্কি একজন পাঁড় মাতাল, পেয়ারে হাবীব খন্দকার, নিষ্টাবান জুড়ারি, পতিতাগামী, টাউট, বদমেজাজী। এরকম লোকেরা কখনো মোটিভেশনাল স্পিকার হয় না। যাদের নিয়ে আমি আমার ‘তুমি একটা আবর্জনা, তোমাকে দিয়ে কিস্যু হবে না‘ বইটি প্ল্যান করেছি বুকোস্কির তাদেরই একজন হওয়ার কথা ছিল। জার্মান বংশদ্ভুত একজন আমেরিকান। কাজ করতেন পোস্ট অফিসে কেরানি হিসাবে। আর কেরানিদের প্রতি আমার এক ধরণের দুর্ভলতা আছে। হয়তো মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন পেটেন্ট অফিসের কেরানি ছিলেন বলে আমার কেরানিপ্রীতি আছে।

 

 

কিন্তু ঝামেলা হলো বুকোস্কি একজন কবি। কবি মানে প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে যাদের জায়গা দেননি। যদিও কারও কারও কবিতা আমার খুবই প্রিয়। বুয়েটে পড়ার সময় আমার মন্ত্রই ছিল

 

শ্রমিক সাম্যের মন্ত্রে কিরাতের উঠিয়াছে হাত
হিয়েনসাঙের দেশে শান্তি নামে দেখো প্রিয়তমা,
এশিয়ায় যারা আনে কর্মজীবী সাম্যের দাওয়াত
তাদের পোশাকে এসো এঁটে দিই বীরের তকোমা ।
আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন,
পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ,
এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ
যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ ।

বুকোস্কির আজীবনের লালিত স্বপ্ন ছিল কবি হওয়া। কিন্তু জীবনানন্দের কথা মতো কখনো ভাবেননি – সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। কিন্তু দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, কিংবা বলা ভাল যুগ যুগ ধরে না কোন সাহিত্য সম্পাদক, না কোন প্রকাশক তাঁর কবিতা প্রকাশের কথা ভেবেছে। “এগুলো জঘন্য, পড়া যায় না, অসভ্যতার চূড়ান্ত এবং ফালতু”। এ ছিল তাদের বিশ্লেষন।
কাজে বুকোস্কি তাঁর কবিত লিখেই যান। দিনের বেলা বুকোস্কি চাকরি করতেন পোস্ট অফিসে। কাজ ছিল জমা পড়া চিঠিকে বিন্যাস করা। খুবই নগন্য টাকা পাওয়া যেত। তার বেশিরভাগই যায় মদের পেছনে। বাকীটা জুয়া। রাতে একাই একাই মদ খেতেন। আর নিজের পুরানো টাইপ রাইটারে কবিতা টাইপ করতেন। বেশিরভাগ দিন সকালে তাঁকে পাওয়া যেত মেঝেতে। সেখান থেকে উঠে রেডি হতেন, পোস্ট অফিসে যাওয়ার জন্য।

এরকম করে মাত্র ৩০ বছর অতিবাহিত হয়েছে। মদ, গাঁজা, ভাং, জুয়া – এসবই তাঁর প্রাণ। এরপর বুকোস্কির ৫০ বছর বয়সে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। একটি ছোট্ট পত্রিকার সম্পাদক তাঁর লেখার প্রতি আগ্রহী হলেন। বললেন – টাকাকড়ি বেশি দিতে পারবেন না কিন্ত তাঁর লেখা ছাপবেন। প্রস্তাব পেয়ে বুকোস্কি সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করলেন – আমার দুটো চয়েজ। হয় পোস্ট অফিসে কেরানিগিরি করা অথবা আপনার সঙ্গে এসে লেখালেখি করে অুভুক্ত থাকা। আমি অভুক্ত থাকাটাই বেছে নিবো”।

চুক্তি স্বাক্ষর করার মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে বুকোস্কি তাঁর প্রথম উপন্যাসটি লিখে ফেলেন – পোস্ট মাস্টার। উৎসর্গ পত্রে লেখা – কাউকে উৎসর্গ করছি না (Dedicated to Nobody)।

এরপর বুকোস্কি হয়ে উঠলেন জনপ্রিয়। মোট ৬টা উপন্যাস তাঁর প্রকাশ হয়েছে। আর শত শত কবিতা। তাঁর জনপ্রিয়তা সকলের কল্পনাকে হার মানিয়েছে। এমনকী বুকোস্কি নিজেও কখনো ভাবেননি তাঁর বইগুলো মাত্র ২০ লক্ষের বেশি কপি বিক্রি হবে!!!

এতোক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন বুকোস্কির গল্প কেন ফেঁদেছি। কারণ এমন একটা গল্পই তো আমাদের মোটিভেশনাল স্পিকারদের দরকার। একটা লোক দিনের পর দিন কবিতা লিখে যাচ্ছে। কেউ তার খোঁজ নিচ্ছে না। মদ, মেয়েমানুষ আর জুয়া খেলেই যাচ্ছে। অথচ ঠিকই ৩০ বছর পর ফিনিস্ক পাখির মতো জেগে উঠেছে। তারপর সফল হয়েছে। এরপরই তো বলা যায় – “সি? হি নেভার গিভ আপ। হি নেভার স্টপ ট্রাইং। হি অলওয়েজ বিলিভ ইন হিমসেল্ফ। সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লেগে ছিল বলেই বুকোস্কি সফল হয়েছেন”। হল জুড়ে তালিয়া। কেউ কেউ আবেগে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়েও পড়বে।

কাজে, এটি খুবই আশ্চর্যের যে, বুকোস্কির এপিটাফে লেখা – Don’t Try – চেষ্টা করো না।

কেন?

বই-এর ব্যাপক বিক্রি স্বত্ত্বেও বুকোস্কি জানতেন তিনি পরাজিত, লুজার। সেটা মেনে নিয়েই ৩০ বছর ধরে তিনি ‘কোবতে’ লিখে গেছেন। আমরা ঠিক জানিও না তিনি কোন কোন কোবতে লেখার পর ‘দেড় মাস পাগল থাকতেন’ কি না। কিন্তু লিখে যেতেন। এ জন্য নয় যে, একদিন না একদিন সফল হবেন বলে তিনি মনে করতেন। তিন জানতেন তাঁর কবিতা কেউ ছাপবে না। কিন্তু লিখতেন কারণ ঐটাই তিনি পারেন। কাজে ছাপা হবে না জেনেও তিনি লেখা চালিয়ে গেছেন। তাঁর কবিতাগুলো পড়লেই সেটা বোঝা যায়। হতাশাবাদী, হতাশা ছড়ানো কোবতে!

এ কারণে সফল এবং জনপ্রিয় হওয়ার পরও বুকোস্কি কিন্তু পাল্টাননি। তিনি তাঁর মতোই ছিলেন। মদ্যপ, জুয়ারি, ডন জোয়ান। কবিতা পড়ার সময় তাঁর পাঠক-শ্রোতাকে যন্ত্রণা দে্ওয়া থেকে শুরু করে পরিচিত সকল মেয়ের সঙ্গে শুয়ে পড়ার প্রচেষ্টা তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চালিয়ে গেছেন।

আত্ম-উন্নয়ন এবং সফলতা অনেক সময় একসঙ্গে আসে বটে কিন্তু আসলে দুটো সমার্থক নয়। সেটির দরকারও নাই।

বুকোস্কি মনে করেন, সাফল্যের পেছনে দৌড়াদৌড়ি কোন লাভ নেই। দরকার হলো নিজের ভাল লাগার কাজটা, কেউ শুনবে না-মানবে না জেনেও, করে যাওয়া। সক্রেটিসের সেই কথাটা ‘নিজের কাজ ঠিক ভাবে করাটাই হলো দেশপ্রেম”। আমি আর একধাপ এগিয়ে বলি – এ সর্বোত্তম ইবাদতও বটে।

সাফল্যে আসলে আসবে, না আসলে নাই। সাফল্যের পেছনে ‘চেষ্টা করো না’।

 

 

Leave a Reply