একটি বিজ্ঞাপন ও একটি নতুন যুগের সূচনার গল্প
১৯৭৮ সালের অক্টোবর মাসের দুই তারিখ। সকাল থেকেই মধুর কেন্টিনে ব্যাপক উত্তেজনা। কারণ স্বাধীনতার পর আর কোন রিক্রুটমেন্ট কাজে এত বড় বিজ্ঞাপন ছাপা হয়নি।একাধিক পত্রিকাতে ছাপা হয়েছে এমন এক চাকরির খবর যা আগে কেও কখনো ভাবেনি। বিজ্ঞাপনটিও বিশাল। ডিসি ম্যাটার, পুরো পত্রিকা জুড়ে।
ঐ বিজ্ঞাপন অন্যান্য ভার্সিটির মতো ঢাবিতেও আলোড়ন তুলে। মধুর কেন্টিনের পেছনেই আইবিএ। তরুনদের বেশিরভাগই আনন্দিত, কিছুটা দ্বিধাগ্রস্তও বটে। তবে, অনেকেই হামলে পড়ে সব নোট নিতে শুরু করেছে নতুন এক সম্ভাবনার। বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে দেশ গার্মেন্টেসের। চাহিদা ১৩০ জন তরুন-তরুনী যারা ছয় মাসের জন্য চলে যাবেন দক্ষিণ কোরিয়ার পুষন শহরে। সেখানে দাইয়ুর কারখানায় শিখতে হবে শার্ট বানানোর কাজ।
শার্ট বানানোর কাজ!!! বিজনেজ গ্র্যাজুয়েটদের জন্য!!!
হ্যা। তবে, চ্যালেঞ্জটা নিলেন অনেকেই। সময়টা কেমন? ১৯৭৪ সালে আমেরিকা তার সহোদরদের নিয়ে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ তৈরি করেছে, বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় দরিদ্রতম দেশ। ১৯৭৫ সালে হ্ত্যা করা হয়েছে জাতির জনককে। চারিদিকে হতাশা। চাকরি-বাকরি বলতে তেমন কিছু নেই। ষাটের দশকের দোর্দন্ড প্রতাপের সিএসপিদের ঐতিহ্য থাকা স্বত্ত্বেও মেধাবীদের সরকারি চাকরির প্রতি তেমন আগ্রহ নেই। নতুন কিছু করবে সেরকম ক্যাপিটালও নেই। কাজে তরুণদের এক বড় অংশের সময় চলে যায় রাজা উজির মেরে।
এমন সময় ঐ বিজ্ঞাপন। গার্মেন্টস-এ চাকরি? তাও আবার বিদেশে প্রশিক্ষণ?
১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে রপ্তানী করে এমন মোট নয়টি গার্মেন্টস ইউনিট ছিল। এগুলোর মিলিত রপ্তানীর পরিমাণ ছিল বছরে ১০ লক্ষ ডলারেরও কম। এগুলোর বেশিরভাগই খুব ছোট এবং তারা দেশের জন্যও গার্মেন্টস বানাতো। সেই রকমই একটা হল ৬০-এর দশকে প্রতিষ্ঠিত রিয়াজ গার্মেন্টস। রিয়াজ স্টোরের টেইলারিং শাখা হিসাবেই সেটির জন্ম। ১৫ বছর ধরে এই কাজ করার পর, স্বাধীনতার পর, এটি স্বতন্ত্র ইউনিট হিসাবে যাত্রা শুরু করে । নাম দেওয়া হয় রিয়াজ গার্মেন্টস লিমিটেড। ১৯৭৮ সালে রিয়াজ গার্মেন্টস পুরুষদের ১০ হাজার পিস শার্ট রপ্তানি করে প্যারিসের একটি প্রতিষ্ঠানে। আয় হল ১ কোটি ৩০ লক্ষ ফ্র্যাংক।
বাংলাদেশ টেলিভিশনে রিয়াজ গার্মেন্টস-এর একটি বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। হাতে আকা একটা ছবি দেখা যায় কিছুক্ষণের জন্য আর পেছনে কথা। রিয়াজ দেশের বাজারের জন্যও শার্ট বানায়। আরও ছিল জুয়েল, প্যারিস আর বৈশাখী গার্মেন্টস।
বিজ্ঞাপন নিয়ে আলাপ আলোচনা, উৎসাহ উদ্দীপনার ভেতর দিয়ে জানা গেল এই উদ্যোগের পেছনের ব্যক্তিটির নাম নুরুল কাদের, নুরুল কাদের খান। বঙ্গুবন্ধু হত্যাকান্ডের পর কেবিনেট সেক্রেটারির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে অজ্ঞাতবাসে চলে যান এবং ফিরে এসে এই গার্মেন্টসের প্রতিষ্ঠা করেছেন।
যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে সুখদেবের নাইন মান্থ টু ফ্রিডম ডকুমেন্টারিটা দেখেছেন তারা নুরুল কাদেরকে দেখেন শুরুতে। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন পাবনার জেলা প্রশাসক। যুদ্ধকালীন সময়ে মুজিবনগর সরকারের অন্যতম কর্মী, স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম সংস্থাপন সচিব।
১৯৭৭ সালে দেশে ফিরে নুরুল কাদের ভাবেন কীভাবে শিল্পায়ন করা যায়। সে সময় কোরিয়ান দাইয়ু কোম্পানির চেয়ারম্যান কিম উ চং-এর সঙ্গে তার দেখা, পরিচয় এবং আলাপ হয়। কোরিয়ানদের তখন মাথায় বাড়ি। মার্কিন মুলুকের সেই সময়কার বিধাতা পুরুষ রিচার্ড নিক্সন এমএফএ নামে একটা জিনিস করেছেন। যার ফলে কোরিয়ার মত দেশগুলো আমেরিকাতে গার্মেন্টস পন্য রপ্তানীতে কোটার সম্মুখীন হয়। দাইয়ুর চেয়ারম্যান তাই খুঁজছিলেন এমন কোন দেশ যেখানে এখনো শার্ট তৈরি একটা শিল্প হয়ে ওঠেনি। কিম উয়ু চঙ্গের প্রস্তাব বিবেচনা করে নুরুল কাদের একটি জয়েন্ট ভেঞ্চার করার কথা ভাবলেন। তার ভাবনার পেছনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে তার মা ও বোনেরা। দেশের মেয়েদের সেলাই-ফোড়াই দক্ষতাকে যদি সমন্বিত করা যায় তাহলে হয়তো একটা কিছু করা যায়। কাজে দাইয়ুর সঙ্গে তার আলাপ।
ঠিক হল শতভাগ রপ্তানীমুখী গার্মেন্টস গড়া হবে। ১৯৭৮ সালের ৪ জুলাই নুরুল কাদেরের সঙ্গে দাইয়ু কর্পোরেশনের ঐতিহাসিক চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়। ঠিক হল নুরুল কাদের করবেন সকল আর্থিক বিনিয়োগ আর দাইয়ু দেবে জ্ঞান-সহায়তা। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে তৈরি হবে ঐ গার্মেন্টস।
তো, একটি শতভাগ রপ্তানীমুখী গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল কই পাবেন নুরুল কাদের? কাজেই ঐ বিজ্ঞাপন।
তখনকার উদ্যমী তরুণ কেবল সরকারি চাকরিতে নিজেদের ভবিষ্যত ভাবেননি। তারা নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। কাজে নুরুল কাদের পেয়ে গেলেন তার কাঙ্খিত ১৩০ জনকে। ঐ ১৩০ জন ছয়মাস পরে ফিরল দেশে। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে গড়ে উঠলো দেশ গার্মেন্টস। ৬ লাইন, ৬০০ কর্মী আর বছরে ৫০ লক্ষ পিস শার্ট তৈরির সক্ষমতা। তের লক্ষ ডলারোর মোট বিনিয়োগ। এক লক্ষ ২০ হাজার পিস শার্ট জার্মানীর এমএনআর কোম্পানির কাছে রপ্তানী করে দেশ শুরু করলো তার শার্ট রপ্তানীর ব্যবসা।
সেই ১৩০ জনের মধ্যে ১১৮ জনই পরবর্তী সময়ে নিজেরাই উদ্যোক্তা হিসাবে গড়ে উঠেছন। তাদের প্রথম পূঁজি যোগান দিয়েছে তাদের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মী বাবারা। কারও দেওয়া ৮৪ হাজার টাকা দিয়ে গড়ে উঠেছে আজকের বিশাল সব গ্রুপ যেখানে মাত্র দশ সহস্রাধিক লোক কাজ করে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি, ভবিষ্যত এবং আকাশরেখা সবই পাল্টে দিয়েছিল ১৯৯৭৮ সালের ঐ বিজ্ঞাপন।
আইবিএ গ্র্যাজুয়েট, বুয়েট গ্র্যাজুয়েটটরা যদি সে সময় ঐ বিজ্ঞাপনে সাড়া না দিতেন তাহলে হয়তো আমরা আমাদের আজকের ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির উদাহরণ তৈরি করতে পারতাম না।
এ জাতি বড়ই দুর্ভাগা কারণ এখানে ব্যবসা, উদ্যোগকে দেখা হয় বাঁকা চোখে। মুনাফালোভী, মুনাফাখোর ইত্যাদি শব্দ কেবল এই দেশেই আছে। যে কোন খারাপ কাজকে তুলনা করা হয় বাণিজ্যের সঙ্গে। যেমন –ঘুষ বাণিজ্য, গ্রেপ্তার বাণিজ্য। এখানে একজন উদ্যোক্তা যার অধীনে ২৩জন প্রকৌশলী চাকরি করে তার বিয়ের বাজারে দাম নেই। কিন্তু ঐ ২৩ জন প্রকৌশলীর অনেক দাম।
আমি যখনই ভাবি এসময়কার ছেলে-মেয়েরা কেবল বিসিএসের কথা ভাবে, কোচিং সেন্টার আর লাইব্রেরিতে বসে সোমালিয়ার মুদ্রা আর উগান্ডার আইসিটি মন্ত্রী স্টিভ জবসের নাম মুখস্ত করে তখনই ১৩০ জন টগবগে তরুণ-তরুণীর মুখ আমার সামনে ভেসে ওঠে। আর আমি দেখতে পাই একজন টগবগে সরকারি চাকরি ছেড়ে দেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাকে, যিনি বাংলাদেশের তরুণদের একটি নতুন আকাশের ঠিকানা দিয়ে গেছেন।
স্যালুট আমার নায়ক, নুরুল কাদের খান।
2 Replies to “একটি বিজ্ঞাপন ও একটি নতুন যুগের সূচনার গল্প”
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.
Nice article.This was the inception of the largest source of foreign currency and the fuel of economy RMG.Hats off to the legend Nurul Kader Khan.