নেলসন ম্যান্ডেলার বাড়িতে
কাল কাল মানুষের দেশে
ঐ কাল মাটিতে
নেলসন ম্যান্ডেলা তুমি
অমর কবিতার অন্তমিল!”
যে দেশে অনেকগুলো অফিসিয়াল ভাষা সেখানে প্রয়োজনের তাগিদেই ইশারা ভাষার প্রচলন হয়ে যায় বেশি। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গ শহরে ঘুরতে গেলে আপনি এরকম অনেক দৃশ্য দেখবেন ট্যাক্সি ভাড়া করার ক্ষেত্রে। কেও যদি তার ডানহাতের তর্জনি আকাশের দিকে তুলে ধরে তাহলে ট্যাক্সি ড্রাইভার বুঝতে পারে তিনি জোহানেসবার্গের মূল শহরে যেতে চান। কেও যদি আকাশে বৃত্ত আকে তাহলে তার গন্তব্য ‘ডাউন টাউন’। এসবই আমরা শুনছিলাম যখন আমরা যাচ্ছিলাম সোয়েটোতে। আমরা মানে ১৯টি দেশের চল্লিশজন এপিসি সদস্য। জলবায়ু পরিবর্তন এবং তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক একটি কর্মশালায় অংশ নিতে আমরা জড়ো হয়েছি দক্ষিণ আফ্রিকাতে। ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে। আর একমাত্র ছুটির দিনটাতে দেখতে ছুটেছি নেলসন ম্যান্ডেলার বাড়ি!
জোহানেসবার্গের যেখানে আমরা ছিলাম সেখান থেকে সোয়েতো যেতে প্রায় ৪০ মিনিটি সময় লাগে। ভ্যানে বসে আমরা শুনছিলাম আমাদের গাইড রোজার বর্ণনা। রোজা বলছিল এখনো দক্ষিণ আফ্রিকায় কোন পরিবার পাওয়া যাবে না যারা বর্ণবাদের শিকার হয়নি! রোজার বাবা ১৩ বছর গৃহবন্ধী ছিলেন।
স্বাধীনতা চত্ত্বর
আমাদের প্রথম যাত্রা বিরতি হয় সোয়োতোর স্বাধীনতা চত্ত্বরে। বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রাম যখন ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে তখন, ১৯৫৫ সালের, ২৬ জুন, বিভিন্ন বর্ণগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ হাজার নরনারী, জোহাসেনবার্গ শহর থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে ক্লিপটাউনে জড়ো হোন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বর্ণবাদ বিরোধী, স্বাধীনতা ও সাম্যের একটি সনদ তৈরি করা। দ্বিতীয় দিন পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করার আগেই ১০টি মূল ধারা বিশিষ্ট সনদে স্বাক্ষর করেন সবাই। এই সনদই দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদোত্তর নতুন সংবিধানের ভিত্তি।
স্থাপত্যের বর্ণনা আমি খুব একটা দিতে পারি না। এখন সেখানে আছে একটি শিখা অনির্বাণ, ২০০৫ সালে এই শিখা প্রজ্জ্বলন করা হয়েছে। সৌধের ওপরটা খোলা, ফলে রোদ সবসময় এক ধরণের আলোছায়া তৈরি করে। আমাদেরকে দেখে এগিয়ে এলেন একজন আফ্রিকান। আফ্রিকাতে এতো বেশি জাতিসত্ত্বা যে তিনি কোন জাতিসত্ত্বার সদস্য সেটি বোঝা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিনি নাক দিয়ে বাশি বাজালেন। দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় সংগীত এবং অন্য একটি সুর। উদ্দেশ্য সাহায্য। বর্ণবাদ বিলুপ্তির পর, দক্ষিণ আফ্রিকাতে কালোদের অবস্থার উন্নতি হচ্ছে বটে তবে একটি সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় আরো অনেকদিন লাগবে। চত্বরে কিছু হস্তশিল্প সামগ্রী বিকিকিনির হাট।
স্বাধীনতা চত্বর থেকে আমরা হেক্টর (দক্ষিণ আফ্রিকার মতিয়র) মিউজিয়াম হয়ে চলে আসলাম একটি আবাসিক পল্লীতে, পশ্চিম অর্লেন্দো। যেখানে আমরা নামলাম সেখানেই বিশপ ডেসমন্ড টুটুর বাড়ি। মাত্র ১০০ গজের মধ্যে দুইজন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী থাকেন এটা ভাবতেই কেমন জানি শান্তি শান্তি লাগে।
বাইরে থেকে দেখে খুব একটা সুবিধা করা গেল না কারণ দেয়াল যথেষ্ঠ উঁচু। এরপর আমরা হাটতে হাটতে চলে গেলাম ৮১১৫ নং নাকানে স্ট্রীটে। ঐটি মান্ডেলার বাড়ি। ১৯৪৬ সালে প্রথম স্থ্রী ইভলিন টকোকে নিয়ে ঐ বাড়িতে ওঠেন আফ্রিকার কালমানুষের নেতা। ১৯৫৭ সালে টকো তাকে ছেড়ে যায়। ১৯৫৮ সালে বিয়ের পর উইনি সে বাড়িতে উঠে আসে।
মিউজিয়াম
কর্নার প্লট। এখন এটি একটি মিউজিয়াম। আশেপাশের বাড়িগুলোর মতো একতলা, ছোট বাড়ি। চারপাশে লোহাড় বেড়া। মূল ভবনে ঢোকার আগে একটি টিকেট ঘর আর রেস্ট রুম। তবে, এগুলো পরে করা হয়েছে। মূল ভবনটি খুবই ছোট। আমার আন্দাজে ৭০০-৮০০ বর্গফুট হবে। কিচেন ছাড়া ৩টা রুম। রুমগুলো খুবই ছোট। খাট বসানোর পর সামান্য জায়গা । মাঝখানে খাবার ঘর হয়ে সব রুমে যাওয়া যায়।
সবগুলো ঘরের দেওয়ালে এখন বিভিন্ন ছবি আছে। ম্যান্ডেলার পারিবারিক ছবি। বেশ কিছু দুর্লভ ছবিও আছে। আছে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া সম্মানসূচক ডিগ্রীর সার্টিফিকেট।
দেওয়ালের কয়েকটি স্থান ফাঁকা। ভালমতো দেখলে বোঝা যায়, সেখানে গুলির দাগ। কয়েকটি দাগ দেখে আমার গুলির দাগ মনে হলেও গাইড বললেন সেগুলো ককটেল মলোটোভের দাগ। মাঝখানের রুমে (যেটিকে আমি খাবার ঘর বলছি) একটি দেয়াল তুলেছিলেন ম্যানডেলা। পুলিশের আর সাদাদের গুলিবর্ষনের সময় দেয়ালের পেছনে আশ্রয় নিতো সবাই। তবে, এটি তার ঘর হলেও ম্যান্ডেলাকে প্রায় পালিয়ে বেড়াতে হতো, পুলিশের ভয়ে। ১৯৬২ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে তাই খুব বেশিদিন তার এখানে থাকা হয়নি।
ম্যান্ডেলা জেলে থাকার সময় দুই মেয়ে জেনি আর জিনদিকে নিয়ে সেখানে থাকতেন উইনি। সে সময় শাদারা এবং পুলিশ একাধিকবার বাড়িটি জ্বালিয়ে দেয়। পরে, আর একটু দূরে উইনি আর একটি ঘর তৈরি করেন।
ম্যান্ডেলার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি উভয় ক্ষেত্রে এই বাড়িটিই ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষদের আশা-ভরসার স্থল। ১৯৭৬ সালের ছাত্র বিক্ষোভ (যে বিক্ষোভের প্রথম শহিদ হেক্টর) উৎস আর তরুণ আফ্রিকানদের আলাপ আলোচনার স্থান।
মুক্তির পর
১৯৯০ সালে জেল থেকে মুক্তি পাবার পর ম্যান্ডেলা এই বাড়িতেই আসেন এবং ১১ দিন অবস্থান করেন। ১৯৯৭ সালে জাদুঘর করার জন্য তিনি বাড়িটি সোয়েতো হেরিটেজ ট্রাস্টকে দিয়ে দেন।
১৯৯০ সালের দিনটির কথা তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন – “সেদিন রাতে আমি উইনিকে নিয়ে ৮১১৫ পশ্চিম অর্লেন্ডোতে পৌছাই। এরপর আমি বিশ্বাস করি যে আমি কারাগার থেকে বের হয়েছি। আমার জন্য ৮১১৫ হলো আমার পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু, আমার মানসিক ভুগোলের এক্স চিহ্নিত বিন্দু। ”
ফেরার সময় এক চমৎকার অনুভুতি নিয়ে ফিরেছি।
কতো গভীরভাবে ভালবাসলে মাত্র ৮০০ বর্গফুটের একটি বাড়িতে থেকে একটি দেশকে আমুল বদলে দেওয়া যায়!!!
নেলসন ম্যান্ডেলা, তোমাকে সালাম।
[আমার ক্যামেরার ব্যাটারি ফুরিয়ে যাওয়ায় নিজে কোন ছবি তুলতে পারি নাই। ছবিগুলো তুলেছেন উন্নয়ন কর্মী ফারজানা আখতার]
One Reply to “নেলসন ম্যান্ডেলার বাড়িতে”
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.
নেলসন ম্যান্ডেলার মতো মানুষ আমাদের দেশে বড় বেশি প্রয়োজন। গুণিজন বলেন এমন মানুষ নাকি শতাব্দিতে একজন আসেন। আমার একান্ত চাওয়া হল পরবর্তী ম্যান্ডেলা যেন বাংলাদেশের মাটিতে জন্মগ্রহণ করেন।