নাইনটি সিক্স ইয়ার্স ইয়াং!!!
“হাউ ওল্ড আর ইয়্যু, স্যার?”
প্রশ্ন শুনে আশে পাশে তাকালেন যার উদ্দেশ্যে এই প্রশ্ন। তারপর প্রশ্নকর্তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “আমাকে বলছেন?”
“জি স্যার”। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে প্রশ্নকর্তা আমতা আমতা করলেন।
“বাট, আই এম নট ওল্ড। আই এম নাইনটি সিক্স ইয়ার ইয়াং!” স্মিত হাস্যে জবাব দিলেন এবার।
না, স্যারের সঙ্গে আমার এই বাতচিৎ হয়নি কখনো। তবে স্যারকে শুরুর প্রশ্নটা করলে স্যার নিশ্চিত এই উত্তর দিতেন। ৮০ বছর বয়সে পাবলো পিকাসো এভাবে এক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছেন। আর আমাদের স্যারের তো এখন শতবর্ষ হতে আর মাত্র ৪ বছর বাকী!
যার জন্য নাইনটি সিক্স ইয়ার ওল্ড না বলে নাইনটি সিক্স ইয়ার ইয়াং লিখতে হয় তার উদ্যম, উৎসাহ ও উদ্দীপনার কথা নানাভাবেই জানা যায়। যারা আমার ময়াল উপন্যাসটি পড়েছেন তারা এন স্কোয়ারের থিসিস সুপারভিশনের এক রিটায়ার স্যারের কথা জেনেছেন। ময়ালের ঐ চরিত্র আমার অতি প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর আহমেদ শামসুল ইসলাম স্যারের আদলেই গড়া (অথবা স্যারই)।
২০০৪ সালে, আশি বছর বয়সে স্যার এমন একটি কাজের সূচনা করেন যা একজন ২০+তরুণও শুরু করতে কয়েকবার ভাববে। ড. আবিদুর রহমানের সঙ্গে স্যার সেই বছর প্রতিষ্ঠা করেন জিনব – GNOBB (Global Network of Bangladeshi Biotechnologist)। উদ্দেশ্য বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা “বাংলাদেশে ডিপলি রুটেট” বায়োটেকনোলজিস্টদের একটি প্ল্যাটফর্মে একত্রিত করা। ১৬ বছরে এই কাজে স্যার প্রবলভাবে শুধু সফলই হোননি, এই প্ল্যাটফর্মকে নিয়ে গেছেন বিশ্বমানে। আমি যখন প্রথম আলো’তে বিজ্ঞান প্রজন্ম পাতা সম্পাদনা করতাম তখন একাধিকভার স্যারের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি কেমন করে তিল তিল করে এই প্ল্যাটফর্মটি গড়ে উঠেছে। আমরা ধারণা বাংলাদেশী অরিজিন অন্য কোন শ্রেণি পেশার লোকেদের এরকম সফল আর কোন বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম নেই। নানা কাজের ফাঁকে এই প্ল্যাটফর্ম নিয়মিত একটি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সের আয়োজন করে। সেরকম একটি কনফারেন্স হয় ২০০৭ সালে। সেই সময়কার বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের জন্য এই কনফারেন্স থেকে একটি পলিসি নোট তৈরি করা হয়। সবার ইনপুট নিয়ে স্যার এই নোটটি তৈরি করেন। এই নোটের ধারাবাহিকতায় দেশে বায়োটেকনোলোজি টাস্ক ফোর্স এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি (NIB) প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম শুরু হয়।
ছিয়ানব্বই বছরের এই চিরতরুণের জন্ম এখনকার ভারতের মেদিনিপুরের একটি গ্রামে। ১৯২৪ সালের ৬ আগস্ট সেটি অবিভক্ত ভারতেরই অংশ ছিল। তাঁর নানা ছিলেন ঐ শহরের প্রথিতযশা আইনজীবী। তাঁর পিতা মৌলভী মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম রাজশাহী কলেজে আরবীর লেকচারার হিসবে যোগ দিলে স্যাররা চলে আসেন রাজশাহীতে। তার আগে মেদিনীপুরে তিন বছর মিশনারী স্কুলে পড়া হয়েছে শামসুল ইসলামের। তারপর রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি থেকে ম্যাট্রিকুলেশন (এখন এসএসসি – ১৯৪১) এবং রাজশাহী কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ( এখন এইচএসসি)। এরপর সে সময়কার সেরা শিক্ষার্থীদের মতো স্যারও পাড়ি দেন কোলকাতায়। সেখানে বোটানিতে (উদ্ভদবিদ্যা) অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেন (১৯৪৭)। ১৯৪৮ সালের জুন থেকে ১৯৫১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি বিভাগে প্রভাষক ছিলেন। তারপরই ব্রিটিশ কাউন্সিলের বৃত্তি নিয়ে পড়তে চলে যান ম্যানচেষ্টার ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে তাঁর পিএইডডি কাজের জন্য পান কুরি মেমোরিয়াল প্রাইজ। ১৯৫৫ সালে ফিরে সিন্ধু ইউনিভার্সিটিতে সরাসরি প্রফেসর হয়ে যান। সেখানেই ছিলেন ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এবং তারপর ঢাকায় এসে প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, পুরাতন বোটানি বিভাগে। ১৯৮৮ সালে স্যারের পড়ানোর আনুস্ঠানিক জীবন শেষ হয়। তবে স্যার কখনো অবসের যাননি!!!
১৯৫৫ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যে স্যারের হাতে ‘মাত্র’ ২০ জন পিএইচডি সম্পন্ন করেছে। এমএসসির সংখ্যা আমার জানা নেই। Nature, Science, SABRAO J. Japanese J Plant Breeding, J. of Heredity, Canadian J. Cytology সহ বিভিন্ন জার্নালে স্যারের প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক নিবন্ধের সংখ্যা মাত্র ১০০টি! দুইটি পাঠ্যপুস্তকও স্যার লিখেছেন!!!
১৯৮৮ সালে ঢাবির পড়ানো শেষ করে স্যার আমেরিকার টেক্সাসের অস্টিনে চলে যান পরিবারের কাছে। সেখানেও স্যার রিসার্চ এসোসিয়েট হিসাবে কাজ করেছেন ডিপার্টমেন্ট অব মলিকিউলার সেল এন্ড ডেভেলপমেন্ট বায়োলজি বিভাগে। সেখানে থাকতেই স্যার জিনবের কাজ শুরু করেন এবং পরে ২০০৮ সাল থেকে স্থায়ীভাবে দেশে চলে আসেন। স্যারের হাতেই দেশের বোটানির একটি জার্নালের সূচনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্ল্যান্ট এন্ড টিস্যু কালচারের সূচনাও স্যারের হাত ধরে। বছর কয়েক আগেও তিনি J. of PTC and Biotech-এর প্রধান সম্পাদক হিসাবে কাজ করেছেন।
ঢাবিতে স্যারের কাজ শেষ হওয়ার আগেই ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান একুশে পদকে ভূষিত করেন। এর আগেই তিনি কৃষিতে রাস্ট্রপতির স্বর্ণপদক এবং বাংলাদেশে একাডেমি অব সায়েন্সের স্বর্ণপদক পেয়েছেন।
স্যারের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে প্রফেসর ড. ইউসুফ মাহবুবুল ইসলাম অতি সম্প্রতি ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন শেষ করেছেন। তার বিষয় কম্পিউটার বিজ্ঞান। মেয়ে প্রফেসর ড. জেবা ইসলাম সেরাজ বাবার মতো জীববিদ্যার গবেষণাকে বেঁছে নিয়েছেন এবং বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগের প্রফেসর। বাকী ছেলে খালিদ ওয়ালিউল ইসলাম জেষ্ঠ্য পরামর্শক হিসাবে এপলে কর্মরত। ৫ থেকে ২৮ বছর বয়ষী ৯ জন নাতি-নাতনীকে ঘিরে স্যারের সময় কাটে।
বাংলাদেশে বিজ্ঞান গবেষণায়, বিশেষ করে জীববিজ্ঞান গবেষণায় প্রফেসর আহমেদ শামসুল ইসলাম আমাদের সবসময় প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন। আরও দীর্ধদিন তিনি আমাদের মাঝে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকুন জন্মদিনে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে এই প্রার্থনা।