ফেসবুক এডের ৭ অমনোযোগ
আমার পরিচিত উদ্যোক্তাদের এক বিরাট অংশের কাছে মার্কেটিং মানেই হলো ফেসবুকে পোস্ট বুস্ট করা। অনেককেই আমি ইদানীং তাদের ফেসবুক বুস্টিং নিয়ে হতাশা প্রকাশ করতে দেখি – আগের মতো রেজাল্ট পাই না! এটাই তাদের অভিযোগ। মার্ক জাকারবার্গের এই জাদুর বাক্স এখন সবাই ঠিকমতো ব্যবহার করতে না পেরে মার্ককেই দোষারোপ করে।
গত কিছুদিন ধরে তাই আমি কিছু পড়াশোনা, কিছু এরকম উদ্যোক্তা ও মার্কেটারের সঙ্গে কথা বলেছি। পেশাজীবী মার্কেটারদের সঙ্গে আমার তেমন আলাপ হয়নি। কারণ আমি জানি তারা ব্যাপারগুলো জানেন। কিন্তু আমাদের ওয়ান (উই)ম্যান আর্মি বা খুব ছোট্ট টিমের ক্ষেত্রে কয়েকপাতা পড়েই ঝাপিয়ে পড়তে হয়। অনেকের আবার সেটুকুর সময়ও হয় না। পরে আক্ষেপটা বাড়তে থাকে।
আমার সংক্ষিপ্ত আলোচনা ও কিছু পড়াশোনা (এখন পেরি মার্শালের আলটিমেট গাইড পড়ছি) থেকে মোটামুটি কিছু বিষয় বের করেছি। এগুলোকে ভুল বলতে চাই না, বরং আমার মনে হয় অমনোযোগই কারণ।
১. কেন এই সাধনা, ধীমান
শুধু মার্কেটিং নয়, যে কোন কাজের সাফল্যের প্রথম সোপান হচ্ছে Why? মানে মাপা যায় এমন ক্লিয়ার উদ্দেশ্য থাকা। মার্কেটিং মোটেই এর ব্যতিক্রম নয়। আপনি কোন উদ্দেশ্যে বিজ্ঞাপন দিতে চান সেটি জানেন তো?
উদ্দেশ্য থেকেই আপনি কৌশলটা ঠিক করতে পারবেন। ফেসবুক এডের যে তিনটে উদ্দেশ্য হতে পারে তা হলো – নিজের ওয়েবসাইটে বেশি বেশি ট্রাফিক আনা, কোন একটা পার্টিকুলার ল্যান্ডিং পেজে কনভার্সন বাড়ানো এবং/বা একবারের জন্য একটা প্রমোশন চালিয়ে কিছু সেলস যোগাড় করা। আপনার উদ্দেশ্য যদি আপনি পরিস্কার করে জানেন তাহলে আপনি দিনশেষে সেটা পূরণ হলো কিনা তা মাপতে পারবেন। শুধু তাই নয় শুরুর আগেই আপনি কোন কোন প্যারামিটার মাপবেন সেটাও ঠিক করে নিতে পারবেন।
আপনি পোস্টের নিচে ফেসবুকের প্রলোভন “১০ ডলার খরচ করে হেন/তেন করেন”-এর ফাঁদে পা দেন আর দিনশেষে হা-পিত্যেশ করেন তাহলে কী আর হবে? ভাল কথা উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পরিস্কার করা আর সঠিক লক্ষ্য ঠিক করা কিন্তু এক নয়। যেমন ধরেন এই করোনা মৌসুমে কোন এলাকার লক্ষ্য হলো কেউ মাস্ক পড়বে না। এটা খুবই পরিস্কার লক্ষ্য কিন্তু সঠিক কী? কাজে “ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না”।
২. উলুবনে মুক্তা ছড়ানো
সম্ভবত এই দিকটা উদ্যোক্তাদের একটি অংশ প্রায়শ খেয়াল করেন না। ফেসবুকে কোটি কোটি লোক। খুবই ভাল সম্ভাবনা হচ্ছে আপনার কষ্ট করে, কিউরেট করা পোস্টটা যাদের কাছে গেলে কাজে লাগতো তাদের কাছে আপনি পাঠাতেই পারলেন না। একটা ইন্টারেস্টিং পরিসংখ্যান দেখুন (পুরানো) – প্রতি মিনিটে ফেসবুকাররা মাত্র পাঁচ লক্ষ ১০ হাজার কমেন্ট, এক লক্ষ ৩৬ হাজার ফটো আপলোড এবং দুই লক্ষ ৯৩ হাজার স্ট্যাটাস দেয়! এছাড়াও ৫ কোটিরও বেশি বিজনেস পেজ প্রতিনিয়ত ফেসবুকারদের সামনে নিজের এড দেখাতে চায়। বোঝেন এবার। কীএক্টাবস্থা!
এখান থেকে আপনার প্রোডাক্ট কিনতে চায়, আপনাকে ভালবাসে এমন লোককে আপনি কেমন করে খু্ঁজে নেবেন? যেহেতু একটু খাটাখাটনি করতে হবে তাই এই জায়গাতে অনেকেই হাল ছেড়ে বড় একটা জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে এড ছেড়ে দেন।ফেসবুক এলগোরিদম তখন সহজে সামনে যাকে পায় তাকেই আপনার এড দেখিয়ে টাকাটা খরচ করে ফেলে। আপনার কপালে জোটে লবডঙকা। একজন উদ্যোক্তা জানালেন আগে তিনি অল্প টাকাতে ১০০ জনের কাছে পৌঁছাতে পারতেন কিন্তু সেখান থেকে ৫ জন কাস্টোমারও পেতেন না। এখন একই টাকাতে তিনি মাত্র ৩০ জনের কাছে পৌছাতে পারেন কিন্তু সেখান থেকে তিনি ২০ জন গ্রাহক পেয়ে যান! ম্যাজিকটা কী? পণ্ডিতেরা বলেন টার্গেটিং।এজন্য এনগেজিং কন্টেন্ট বানিয়ে সেটিকে অপটিমাইজ করতে হবে আপনি যেন দ্বিতীয় দলে থাকতে পারেন। হাজার হাজার লোকের কাছে না গিয়ে গুটিকয়েক আসর লোকের কাছে যাওয়ার তরিকা আপনাকে জানতে হবে।
৩. আসল ধরণই আসল
সবাই তো জানেন ফেসবুকে কয়েক ধরণের (Type) এড আপনি দিতে পারেন
• নানা সাইজের গ্রাফিক্স বা ছবি বা ইনফোগ্রাফ টাইপের কিছু
• ভিডিও (দেখেন না ক্লিকবাজরা লেখে – ভিড্যুসহ)
• কয়েকটা ছবি বা ভিডিও ক্লিপ নিয়ে কোলাজ টাইপের কিছু
• স্লাইড শো
• ক্যানভাসের ব্যবহার
• সব প্রোডাক্ট একসঙ্গে দিয়ে একটা এড, ইত্যাদি
শুধু তাই নয় প্রত্যেকটি এড আপনি হয় ডেস্কটপ, মোবাইল বা ডান দিকের সাইডবারে দেখাতে পারবেন।
এখন সব ধরণের এডের জন্য একটা কোন প্যারাসিটামল কিন্তু নাই। আপনাকে নানারকম কিছু করে কোনটার জন্য কোনটা কার্যকরী সেটা বের করতে হবে। শুরু করার সময় একটু পড়ালেখা করে নিতে হবে। যখন আপনি মোটামুটি জেনে যাবেন আপনার কোন ধরণের এড কোথায় প্লেস করতে হবে তখন আপনার সাফল্য বাড়তে থাকবে।
৪. “পাস দিছি তো”
আমি যখন ছোট ছিলাম, স্কুলে/কলেজ পড়তাম, চট্টগ্রামে আন্দরকিল্লায় রাজাপুর লেনে থাকতাম। আমাদের বাসার পেছনেই একটা খেলার মাঠ ছিল যেখানে আমরা স্কুল থেকে এসে ফুটবল খেলতাম। (আমি কেমন খেলতাম সেটা জানতে না চাওয়ায় ভাল)। তো ফুটবল খেলার সময় আমাদের এক সিনিয়র ভাইকে কোন দলই নিতে চাইতো না। কারণ – উনি বল পেলেই পাস দিয়ে দিতেন। নিজের দলের কেউ পেলো না বিরোধী দলের পায়ে গিয়ে পড়লো সেটা নিয়ে ওনার কোন দুশ্চিন্তা ছিল না। তিনি বলতেন – আমি মডার্ন ফুটবল খেলি। বল পেলে আমার কাজ হলো বল পাস করে দেওয়া। কে পেলো সেটা নিয়ে আমি ভাববো কেন?
তো, আপনিও কি সেরকম। মানে ফেসাবুকে একটা এড দিয়ে সেটার কথা ভুলে গেলেন। নিয়মিত তো বটেই, এমনকী এড শেষ হওয়ার পরও কিন্তু আপনি আর খুলেও দেখলেন না এটার তথ্যাবলী। ফেসবুক কিন্তু আপনাকে অনেক তথ্য আর ইনসাইট দেয়। আপনি তো মডার্ন ফুটবলার আপনি কেন দেখবেন? তাই না!
৫. “আমার বিক্রি তো বাড়ে না ”
পত্রিকাতে বড় বড় কোম্পানিগুলো যখন বিজ্ঞাপন দেয়, দেখবেন ওরা সবসময় বিক্রির চেষ্টা করে না। কখনো ক্রিকেট টিমকে অভিনন্দন জানায়, কখনো করোনার সময় মাস্ক পড়তে বলে (ঐ কোম্পানি কিন্ত মাস্ক বানায় না) বা বলে আপনার সন্তানকে স্কুলে পাঠান। কেন?
কারণ হলো যে সমস্ত সেলসপার্সন দেখা হলেই আপনাকে কিছু ‘গছিয়ে’ দিতে চায় তাদেরকে কি আপনি পছন্দ করেন? না কি সম্ভাব্য সকল উপায়ে তাকে এড়িয়ে চলেন।
পেলেন তো আপনার কৌশল!
৬. কাস্টোমারের কী লাভ
এটা সাধারণ বিষয়। আপনার প্রোডাক্ট কাস্টোমার কিনবে যদি আপনি কোন ভ্যালু এড করতে পারেন। আপনার ভ্যালু প্রপোজিশন যদি আপনার এড থেকে লোকে ধরতে না পারে তাহলে আপনার অবস্থা হবে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার মতো।
একবার এক লোক হোজ্জার কাছে এসে বললো – মোল্লা সাহেব, সমরখন্দে আমার যে বোন থাকে তার কাছে একটা চিঠি লিখে দেন।
হোজ্জা বললেন – কিন্তু আমার যে পায়ে ব্যাথা?
লোকটি অবাক হয়ে বললো – আরে মোল্লা! আপনি তো হাত দিয়ে লিখবেন। পায়ের ব্যাথাতে সমস্যা কী?
হোজ্জা তখন গম্ভীর হয়ে বললো – আমার হাতের লেখা সবাই পড়তে পারে না। কাজে আপনার বোনকে ঐ চিঠি আমারই পড়ে শোনাতে হবে। কিন্তু পায়ের ব্যাথার জন্য এখন আমি এখন সমরখন্দে যেতে পারবো না।
৭. ‘সাতটা টুপি হবে?’
একবার এক লোক দর্জির কাছে এক টুকরা কাপড় নিয়ে গেল। বললো – এটা দিয়ে আমাকে একটা টুপি বানিয়ে দেন।
দর্জি বললেন – তথাস্তু।
ফিরতে গিয়ে লোকটার মনে হলো – আরে কাপড় তো মনে হয় বেচে যাবে। তাড়াতাড়ি দর্জির কাছে গিয়ে বললো – আচ্ছা এই কাপড়ে কি দুইটা টুপি হবে? হলে আমাকে দুইটা টুপি বানায় দেন।
দর্জি বললেন – আচ্ছা।
একটু পর লোকটির আবার মনে হলো তিনটে হতে পারে্ …
এভাবে কয়েকবার এসে শেষ পর্যন্ত সাতটিতে রফা করে তিনি ফিরে আসলেন।
পরদিন টুপি আনতে গেলে দর্জি তাকে সাতটি আঙ্গুলে পড়া যায় এমন টুপি ধরিয়ে দিলেন।
লোকটির অবাক জিঙ্গাষু দৃষ্টির জবাবে দর্জি জানালেন – ঐটুকু কাপড় দিয়ে সাতটা মাথার টুপি হয় না, সাতটা আঙ্গুলের টুপি হয়।
অনেক সময় আমাদের বাজেটের স্বল্পতা থাকে। কিন্তু সাধ থাকে অনেক – আমরা সবই করতে চাই। ফলাফল হয় আঙ্গুলের টুপি।
টাইট বাজেটে কাজ করার সময় এটাও মাথায় রাখা দরকার।
তো শেষমেষ কী দাড়ালো?
দাড়ালো যে ফেসবুক এড আগের মতো কাজ করে না এটা বলার আগে উপরের বিষয়গুলোতে মনোযোগী হওয়া। দুইভাবে হতে পারেন। একটা হলো নিজে নিজে ফেসবুক ব্লগ, বই ইত্যাদি পড়ে পড়ে চেষ্টা করে করে নিজেকে তৈরি করা।
আর একটা হলো আমার পদ্ধতি। নিজে একটু পড়ালেখা করে যে জানে তার কাছ থেকে বাকীটুকু শিখে নেওয়া। তারপর প্র্যাকটিসে নেমে নিজেকে উন্নত করা।
‘চাকরি খুজব না চাকরি দেব ‘ ও ‘মুনির হবসবন ডট কম’ থেকে আমরা জারিফ হাসানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি ফেসবুকের এসব বিষয় নিয়ে আমাকে একটু এগিয়ে দিতে। জারিফ রাজি হয়ে একটি চারদিনের কয়েকঘন্টার কোর্স করাবে বলেছে। আমি ভাবলাম একা আমি শিখি কেন? আরও যারা আগ্রহী তারা যোগ দিক।
এ জন্যই নতুন এই কোর্স। আগ্রহীরা নিবন্ধন করতে পারেন। তার আগে দেখে নেবেন আপনার আকাঙ্খার কিছুটা হলেও মিটবে কিনা।
আপনার জন্য শুভ কামনা।
[আমার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন টুইটার, লিংকডইন, ইউটিউব বা ফেসবুকে]
One Reply to “ফেসবুক এডের ৭ অমনোযোগ”