৫০০ কোটি ডলারের সাধ ও সাধ্য
২০২১ সালের মধ্যে তথ্যপ্রযু্ক্তি খাতে রপ্তানীর একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেটি মাত্র ৫০০ কোটি ডলার (৫ বিলিয়ন ডলার)। শুনতে অনেক শোনালেও আমি খুব হিসাব করেই মাত্র শব্দটি লিখেছি। কারণ এই অংকটি এখনকার যে বিশ্ববাজার তার একশতাংশেরও কম। ২০১১ সালেই এই বাজার মাত্র ৬৭৭ বিলিয়ন ডলারের ছিল।
তার মানে সাধটা মোটেই আকাশ ছোঁয়া নয়।
তাহলে সেটা ছুঁতে হলে আমাদের কী কী করতে হবে?
উত্তরটা আমার দেওয়ার কথা না। কারণ আমি সচরাচর এনালিসিস করি না। আমি মূলত কামলা শ্রেণীর লোক, ঘাটে-মাঠে দৌড়াইতে পছন্দ করি। তবে, গত ক’দিন ধরে এই নিয়ে কিছু লোকজনের সঙ্গে কথাবর্তা বলতে শুরু করেছি। কিছু আগের অভিজ্ঞতা আছে। এখন মনে হচ্ছে একটা হোয়াইট পেপার লেখা দরকার। যৌথভাবে আমার সঙ্গে লেখার জন্য কয়েকজনকে অনুরোধ করবো।
আপাতত কয়েকটা বিষয় সামনে আনতে চাই।
১. কতো লোক চাই? কতো প্রোগ্রামার চাই? কতো বিগ ডেটা এনালিস্ট চাই? কতো কলসেন্টার এজেন্ট চাই?
এ প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে কয়েকটা বিষয় আগে জেনে নিতে হবে। বর্তমানে আমাদের দেশে প্রায় ৩৫ হাজার কর্মী রয়েছে আইটি/আইটিইএস খাতে (আমি এরপর থেকে সাধারণভাবে এটিকে আইটি বলবো)। তাদের সম্মিলিত অবদান বছরে ৩০০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানী। এটিকে আমরা বাড়াতে চাচ্ছি প্রায় ১৭ গুন। সাদামাটাভাবে বললে তাহলে ৩৫,০০০ গুন ১৭ বা প্রায় ৬ লক্ষ লোকের দরকার হবে। প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের ওতো লোক আছে কী না? বা আমরা বানাতে পারবো কী না আগামী ৫ বছরে। লোকের সংখ্যা কমে আসবে যদি আমরা ভ্যালুচেনের উপর দিকে উঠতে পারি। সেটা কতো শতাংশের জন্য সম্ভব? সেটার একটা হিসাব দরকার।
এই ৬ লাখের মধ্যে কমপক্ষে ২৫% হতে হবে কল সেন্টার কর্মী। কেন? কারণ ওটা হবে শুরুর ধাপ। বিশেষ করে বিপিওতে বড় জায়গা নিতে হলে আমাদের কলসেন্টারে ভাল দখল থাকা দরকার। ফিলিপাইনের কথা ধরা যাক। ২০১৪ সালে ফিলিপিনে আইটি খাতে মোট কর্মীর সংখ্যা মাত্র ১০ লক্ষ যা কী না তাদের মোট চাকরীজীবীদের ২.৩%। এদের মধ্যে ৬৪% বা ৬ লক্ষ ৪০ হাজারই কাজ করে কলসেন্টারে, মানে ভয়েস ব্যবসাতে। তাদের আইটিখাতের কর্মীদের গড় বার্ষিক আয় ৮৮৪৯ ডলার (৮৩০১-১৭৩৮৩)। তারমানে ৫০০ কোটির স্বপ্ন পূরণ হতে হলে ভয়েসকে বাদ দেওয়া যাবে না। যাবে না দুইটা কারণে – একটা হলো লক্ষ্যটা বড় বলে এবং এখানে যোগ্যতার মাপকাঠিটাও সহজে অর্জনযোগ্য।
সহজে? দাড়ান, দাড়ান।
আমরা বরং বাকোর সহ-সভাপতি ওয়াহিদ শরীফের অভিজ্ঞতা শুনি। আগামী ৯ মাসের মধ্যে তার নতুন প্রায় ১৪০০ কলসেন্টার কর্মী লাগবে। সবাই লোকাল মার্কেটের জন্য। মানে বাংলায় কথা বলবে। কিন্তু “ওরা টাকাকে বলে টায়া, পাসওয়ার্ডকে বলে প্যাচওয়ার্ড”। তাহলে কেমনে তিনি বাড়বেন? কে ভেবেছিল বাংলাভাষাতে শুদ্ধভাবে কথা বলতে পারে এমন লোক পাওয়া আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হবে?
দ্বিতীয়টি হল গার্মেন্টস-এর অভিজ্ঞতা। চীনাদের গড় মজুরী বেড়ে যাওয়ায় গার্মেন্টসগুলো বালাদেশে আসছে, আসবে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে আরো ৪০০০ নতুন গার্মেন্টস এসে পড়বে বাংলাদেশে। ইয়ে, ঐ মজুরীর সমস্যা। ঠিক একইভাবে ফিলিপিনেরও গড় মজুরী বাড়ছে এবং ওদের ইন্টারনেট প্রজন্ম ভ্যালুচেনের ওপর দিকে যেতে চাচ্ছে। সেটার রেজাল্ট হবে ভয়েস মার্কেট সেখান থেকে সরবে। কোথায় যাবে? যারা রেডি থাকবে তাদের কাছে যাবে। ভিয়েতনাম উঠেপড়ে লেগেছে। ওরা বছরে মাত্র ৬টা করে নতুন আইটি পার্ক বানাচ্ছে এসব বিবেচনা করে। ভিয়েতনাম গার্মেন্টসে আমাদের সঙ্গে পেড়ে ওঠে নাই আমাদের গার্মেন্টস উদ্যোক্তাদের জন্য। কিন্তু আইটিতে ওরা জানে আমাদের উদ্যোক্তার সংখ্যা নেহায়েৎ কম।
ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরাম এর পাশাপাশি আর একটা বিষয় বিবেচনা করছে সেটি হলো ভয়েস সার্ভিসের অটোমেশন। কিন্তু “বুকের বাম দিকে ব্যাথা হলে ১ চাপুন আর ডান দিকের ব্যাথা হলে ২ চাপুন” এর অভিজ্ঞতা কিন্তু সুখকর নয় কোন দেশেই। কাজে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের আরো অনেক চড়াই উৎরাই পার হতে হবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে ভয়েস সার্ভিস মোটেই মাঠে মারা যাচ্ছে না।
বাকোর একটা প্ল্যান আছে ২০২১ সালের মধ্যে বিপিও খাতে ২ লক্ষ লোকের চাকরী দেওয়া। সেই লোক কি পাওয়া যাবে? ইংরেজির কথা কি লিখবো?
আচ্ছা। এবার ধরা যাক আইটি গ্র্যাজুয়েটের কথা। নতুন যে, ৫ লক্ষ ৬৫ হাজার কর্মীর যদি ১০% আইটি গ্র্যাজুয়েট হয়, তাহলে সংখ্যাটা দাড়ায় ৫৫ হাজার। কিন্তু আগামী ৫ বছরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরই হবে ৪৫ হাজার। এদের মধ্যে বিদেশে চলে যাবে কতো?
২. ফ্রিল্যান্স আউটসির্সিং কী করবে এই ইকুয়েশনে?
প্রশ্নটা কঠিন। কিন্তু উত্তরটা সহজ। ৫০০ কোটি ডলারের ১০ শতাংশও যদি ফ্রিল্যান্সিং থেকে আসে তাহলে সেখানে আমাদের কতো লোক লাগবে? আমাদের এভারেজ আয় কতো? সেটা দিয়ে ভাগ করলেই এটা বের হবে!!!
এই চিত্রের অন্য দিক হলো আমাদের আইটি কোম্পানিগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। কিন্তু ইদানীং অনেকেই চারকি করতে চায় না, ফ্রিল্যান্সিং করতে চায়। আচ্ছা, ভারতের ইনফোসিসে যে কর্মীটি ১২ হাজার রুপীতে চাকরি করে সে কি ফ্রিল্যান্সিং করে ৪০ হাজার রুপী কামাতে পারে না? তাহলে সে তা করে না কেন?
এই প্রশ্নগুলোর জবাবও খুঁজতে হবে।
এ গেল জনশক্তির একটা অংশ। ২০২১ সাল নাগাদ ভাল মানের লোক তৈরি করার ক্ষেত্রে আমরা কতোদূর সফল হবো?
যাক গে, এই লেখায় আমি কোন উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি না। আগামী ক’দিন আমি আমার প্রশ্নগুলো লিখতে থাকবো। তারপর উত্তর খোঁজা যাবে।
আপাতত স্বপ্নটা থাক।