বই-পত্র : হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে
দৈনিক সংবাদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় আমি কলেজে ওঠার পরে। কারণ আমাদের বাসাতে চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী এবং দৈনিক ইত্তেফাক রাখা হতো। রাখা হতো আনন্দমেলা, কিশোর বাংলা প্রভৃতি। চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হওয়ার পর দেখলাম বন্ধুবান্ধবরা সবাই কোনো না কোনো স্যারের কাছে বাসায় পড়ে। কেমেস্ট্রির জনপ্রিয় স্যার হলেন চৌধুরী মনজুরুল হক স্যার। কোন এক অজ্ঞাত কারণে রসায়ন আমি নিজেই বুঝতে পারতাম। তাই প্রাইভেট পড়ার কথা ভাবি নাই। ল্যাব ক্লাশেও মজা পেতাম। কিন্তু অর্গানিক কেমেস্ট্রি পড়তে গিয়ে মনে হলো এটা নতুন। ক্লাসে যে স্যার পড়াতেন (নাম ভুলে গেছি, ওনাকে আমরা “হচ্ছেটা কী” স্যার বলতাম) তার পড়ানোতেও ব্যাপারগুলো খোলাসা হলো না। যেহেতু আমার নোটের ব্যাপারে আগ্রহ ছিল না তাই আমি খুঁজতে শুরু করলাম এমন স্যার যিনি নোট দেন না। অধ্যাপক গুরুপদ পালিত স্যার ছিলেন খুবই রাশভারী শিক্ষক। আমরা ভয়ই পেতাম। যখন জানলাম তিনি নোট দেন না তখন ভাবলাম ওনার কাছেই তাহলে পড়ি। আমরা চারজন একদিন রাস্তায় স্যারকে ধরলাম যে স্যার আমাদেরকে পড়ান। স্যার রাজি হলেন। কিন্তু সময় দিলেন সকাল ৭টা থেকে ৮টা!!! অন্য সময়ে তিনি পড়াবেন না।
তো, আর কি। স্যার থাকেন পারসিভাল হিলে। আমাদের আন্দরকিল্লার বাসা থেকে আমি কালুরঘাটগামী মুড়ির টিনে এসে পাহাড়ের নিচে নামতাম। তারপর স্যারের বাসায় পৌঁছাতাম। বাকী তিনজন খুব একটা নিয়মিত ছিল না। কিন্তু আমি মিস করতাম না। বেশিরভাগ দিন আমি একটু আগেই পৌঁছাতাম। আর কোনো কাজ না পেয়ে দৈনিক সংবাদ পড়তে শুরু করি। সেই আমার দৈনিক সংবাদের সঙ্গে পরিচয়। রবি, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার স্যারের বাসায় গিয়ে দৈনিক সংবাদ পড়তে গিয়ে প্রথমে কলামিস্ট গাছপাথরের সঙ্গে পরিচয় হলো। তাঁর কলাম মুগ্ধ হয়ে পড়তাম। সাইয়ীদ আতিকুল্লাহর কিছু বিশেষ প্রতিবেদন পড়তাম। তারপরই দেখলাম প্রতি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয় সংবাদ সাময়িকী। চারপাতা। ব্রডশীট। এই সাময়িকীর সঙ্গে সঙ্গে দেশের সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদদের নামধাম জানতে শুরু করলাম। বলা যায় একটা অন্য জগত আমাকে খুলে দিল সংবাদের এই সাময়িকী।
লং স্টোরি শর্ট। বুয়েটে পড়তে এসে স্বপনদা’র (স্বপন বিশ্বাস) মাধ্যমে যুক্ত হলাম বিজ্ঞান চেতনা কেন্দ্রে। সেখানে পরিচয় ফরহাদ মাহমুদ ভাই-এর সঙ্গে। ফরহাদ ভাই দৈনিক সংবাদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পাতা দেখেন। সেখান থেকেই আমার সংবাদ অফিসে যাওয়া শুরু ১৯৮৭ সাল থেকে। প্রধানত শুক্রবার যেতাম। সেখানেই একদিন একজন শান্ত সৌম্য লোককে দেখিয়ে ফরহাদ ভাই বললেন – ওনাকে চিনেন?
‘না’ বলার পর উনি বললেন -ওনার নাম আবুল হাসনাত এবং উনিই সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা করেন। ততোদিনে সাহিত্য সামিয়কী না পড়লে আমার ভাত হজম হতো না। এই পাতাতে আনিসুজ্জামান স্যার, যোবায়দা মির্জা, জাহানারা ইমামের স্মৃতিকথা আমাকে এমনভাবে আপ্লুত করেছে যে সেই থেকে স্মৃতিকথা, আত্মচরিত হয়ে গেছে আমার পড়ার প্রিয় বিষয়! সংবাদে আমি যুক্ত ছিলাম ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত। কাজে মাঝে মধ্যে হাসনাত ভাই-এর সঙ্গে দেখা ও কথা হতো। স্যার না ডেকে কেন ভাই ডাকতাম সেটা অবশ্য বলতে পারবো না। মাঝে মধ্যে উনি জিঙ্গেস করতেন অমুক লেখাটা পড়েছি কিনা। পড়ালেখা কেমন হচ্ছে। পরে পাস করে যখন বুয়েটে জয়েন করেছি তখন খুশি হয়েছেন। সংবাদের পর ভোরের কাগজ ও প্রথম আলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাওয়ার পর হাসনাত ভাই-এর সঙ্গে দেখা হতো না। দেখেছি উনি সংবাদ ছেড়ে কালি ও কলম নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন। মাত্র কয়েক বছর আগে একদিন প্রথম আলো’র সম্পাদক মতিউর রহমানের অফিস কক্ষে ওনাকে দেখে সালাম দিলাম এবং আশ্চর্য হয়ে দেখলাম ওনার আমার নাম মনে আছে। আমি যে প্রথম আলো’র বিজ্ঞান পাতাটা দেখতাম এটাও জানেন। বললাম সেটা আর বের হয় না কিন্তু আামি প্রথম আলোতেই এখন পূর্ণকালীন কাজ করি। এরপর আরও কয়েকদিন দেখা হলো মতি ভাই-এর রুমে। ততোদিনে জেনেছি মতি ভাই-আর হাসনাত ভাই ছোটবেলা থেকে বন্ধু। তারপর একদিন মতি ভাই ছিলেন না। সেদিন অনেকক্ষণ ওনার কথা শুনেছি।
এর মধ্যে আমি বাংলাদেশের প্রাইভেট সেক্টরের সূচনা যাদের হাতে তাদের নিয়ে একটা কাজ করতে শুরু করেছি। সেটার জন্য পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী পিয়ারু সর্দার সম্পর্কে জানতে গিয়ে তার সম্পর্কিত একটা বই পড়ি। সেখানে জানলাম গেল শতকের পঞ্চাশ ও যাটের দশকের পুরোটা সময় জুড়ে হাসনাত ভাই ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভাবলাম ঐ সময়কার দিনলিপি নিশ্চয়ই তিনি লিখবেন।
তিনি ঠিকই লিখেছেন। কিন্তু তার পরপরই দ্রুত ওপারে চলে যাবেন সেটা ভাবিনি। এই বছরের শুরুতে তাঁকে নিয়ে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ এবং তার স্মৃতি কথা “হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে” কিনেছি। তাঁকে নিয়ে অন্যদের স্মৃতিচারণ দ্রুত পড়া হলেও অফিসে টুক টুক করে হারানো সিঁড়ির ছাবির খোঁজ নিচ্ছিলাম। পরে মার্চ মাসে করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকা এবং সেখান থেকে বাসায় কোয়ারেন্টিনে থাকার সময় এই চমৎকার স্মৃতি কথাটা আমার পড়া হলো। ষাটের দশকের প্রতি আমার দৃর্বলতা আছে। আগের দুর্বলতার কারণ ছিল ঐ সময়ে বাঙ্গালীর স্বাধীনতা আন্দোলন একটা পরিণতির দিকে যাচ্ছিল। সেটার কুশীলবদের সম্পর্কে যতো বেশি সম্ভব জানা। আর এখন তরুণদের নিয়ে কাজ করি বলে মাঝে মধ্যে মনে হয় সে সময় একটা কঠিন ভবিষ্যতের কথা জেনেও আমাদের মেধাবী ছেলেমেয়েরা কঠিন পথটাকেই বেছে নিতেন কেন? তাদের প্রেরণার উৎস কী ছিল? সেই সময়ের উজ্জ্বল তারুণ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় যেমন ঝাপিয়ে পড়তেন তেমনি তারা ১৯৭১ সনে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। তাঁরা ও তাদের অভিভাবকরা জানতেন কী দুর্গম পথ তারা বেছে নিচ্ছেন। এখন তো সেই তুলনায় তরুণদের সামনে সুযোগ বেশি, সহজও সেগুলো এভেইল করা। তাহলে কেন তারা সেই সুযোগগুলো কাজে লাগায় না?
হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে পড়া শুরু করার সময় আমার অবচেতন মনে এই চিন্তাটাই প্রচ্ছন্ন ছিল। লেখক আবুল হাসনাত ঠিকই আমার মনের এই প্রশ্নের উত্তর অনেকখানি দিয়েছেন।
বই-এর ভূমিকাতে তিনি লিখেছেন, “আমার জীবন কোন অর্থেই বর্ণময় নয়। সাধারণ ও আটপৌরে”। কিন্তু এটা মেনে নেওয়া মুশ্কিল। কারণ যে সময়ে তিনি স্কুল ও কলেজে পড়েছেন এবং পড়তে পড়তে নিজের একটা জগত গড়েছেন সেটা মোটেই কোন আটপৌরে জীবন নয়। “তবে প্রত্যক্ষ করেছি এদেশের মানুষের সংগ্রাম ও বিজয়। এই বিজয় আত্মশক্তিতে বলিয়ান হয়ে বাঙ্গালি জাতিকে স্বজাত্যবোধে উদ্দীপিত করেছে। জাতীয় বিকাশ ও শিল্প সাহিত্যের প্রতিটি ক্ষেত্রকে করে তুলেছে দীপিত”।
লেখক বাঙ্গালির মহান বিজয়ের কাহিনী দিয়েই এই স্মৃতিতর্পন শুরু করেছেন। তারপর তিনি আগ-পিছু করেছেন সময়ের। যুদ্ধদিনের কথা বলতে গিয়েই তিনি তার ছোটবেলার স্মৃতি থেকে অধুনা সময়ে এসে শেষ করেছেন। আমি যেমনটা আশা করেছি সেরকমই তিনি ১৯৭১ পর্যন্ত সময়কালকেই বেশি ধারণ করেছেন। স্বাধীনতা উত্তর কালের প্রায় ৫০ বছর সময়টা সেভাবে তুলে আনেননি। পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে হাসনাত ভাই হয়তো আরও একটি স্মৃতিকথা লেখার কথা ভেবেছিলেন যেখানে স্বাধীনতা উত্তরকালের বাংলাদেশ নিয়ে বিস্তৃত লিখবেন। সেখানেও তার অমূল্য অভিজ্ঞতা।
হাসনাত ভাই তার অভিজ্ঞতাগুলো সহজভাবে লিখেছেন। যুদ্ধ যাওয়ার ঘটনাবলী কিংবা ১৯৭১ সাল জুড়ে ভারতে দেশের জন্য কাজ করার বর্ণনাতে কোন অতিরঞ্জন নেই। যা ঘটেছে সেটাই বলেছেন। আমার ভাল লেগেছে কারণ তিনি যখন ঘটনার বর্ণনা করেছেন তখন নিজের ভাবনা সেটার সঙ্গে জুড়ে দেননি। কিন্তু বেশরিভাগ ঘটনার ব্যাপারে নিজের উপলব্দি আলাদা করে যুক্ত করেছেন। সেই কারণে এটি এক সময় ইতিহাসের জন্য জরুরী হবে বলে আমার ধারণা।
ষাটের দশকে বাংলা একাডেমিতে রবীন্দ্রনাথের ‘রক্ত করবী মঞ্চায়নের যে ডিটেইল বর্ণনা তিনি দিয়েছেন সেটি আমি কয়েকবার পড়েছি। বোঝার চেষ্টা করেছি সাংগঠনিক কাজগুলো কেমন করে হয়েছে। মজা পেয়েছি যখন কিনা তারা কয়েকজন গিয়ে গভর্নর মোনায়েম খাঁকে বলেছেন রক্ত করবী হচ্ছে একজন হতাশ রাজার কাহিনী! এই বলে পারমিশনটা পেয়েছেন। রক্ত করবী নাটকের মঞ্চায়নের সময় আলোক প্রক্ষেপের বর্ণনা শুনে মনে হয়েছে তখনকার ‘নিধিরাম সর্দার’রা যতো কস্ট করে চমৎকার সব বিষয় করতেন তার তেমন কিছুই অনেক যন্ত্রপাতি দিয়ে আমরা করতে পারি না।
হাসনাত ভাই সংবাদে তার থাকা সময়টার কথাও বিস্তারিত লিখেছন। ৭১ সনে সংবাদ কার্যালয় পাকিস্তানী বর্বররা জ্বালিয়ে দিয়েছিল। শহীদ সাবের ভিতরেই ছিলেন! সংবাদের মালিক আহমেদুল হকের কথাও তিনি বলেছেন। কেমন করে দৈনিক সংবাদ ধীরে ধীরেে প্রগতিশীল বাংলাদেশের মুখপত্র হয়ে ওঠে সে কথাও উঠে এসেছে।
বইটি বিশাল। ৩২৪ পৃষ্ঠার বই। জার্নিম্যান বের করেছে। আবুল হাসনাত আমার জানামতে বাংলাদেশের সেরা সাহিত্য সম্পাদক। সেজন্য হয়তো এই লেখার কোন সম্পাদক ছিল না। থাকলে বইটা আর একটু গোছানো হতো। তবে অগোছালো আত্মজীবনীই মনে হয় ভাল।
পড়ার জন্য খুবই ভাল একটা বই।
আমার রেটিং – ৯/১০।
[আমার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন টুইটার, লিংকডইন, ইউটিউব বা ফেসবুকে]
One Reply to “বই-পত্র : হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে”