গুগল কী করবে?
বইটি লিখেছেন জেফ জার্বিস। মনে হয় কোন এক কেউকেটা, তবে আমি আগে তার নামশুনিনি। বই এর নাম থেকে বোঝা যায় এটি একুশ শতকের অন্যতম শক্তিশালীব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গুগলকে নিয়ে লেখা। ইন্টারনেট জানে কিন্তু গুগল চেনেনা এমন লোক মনে হয় খুঁজে পাওয়া মুশ্কিল। তবুও যাদের গুগলের শুরুর দিন আরআমার কেন গুগল নিয়ে আগ্রহ তা জানতে ইচ্ছে তারা আমার আগের একটা ব্লগপোস্ট দেখে নিতে পারে ।
তা এই বইটি গুগলের ইতিহাস নয়। মূলত দুইটি ভাগে বইটি বিভক্ত। গুগলের নীতি (গুগল রুল) এবং শিক্ষা, সংবাদপত্র, মিডিয়া, বিজ্ঞাপন, ম্যানুফ্যাকচারিংইত্যাদি যদি গুগল চালায় তাহলে সেটি কেমন হবে তার একটি যৌক্তিক অনুমান (হোয়াট উড গুগল ডু)। আমার পড়া এখনো শেষ হয়নি। এখনো প্রথম পার্ট নিয়ে আছি।
জার্ভিসের লেখার একটি বড়গুণ হলো এই বইএর বিষয়বস্তুর সঙ্গে তার একটিযোগাযোগ আছে। জার্ভিস এ যুগের সে লোকগুলোর অন্যতম যারা ব্লগ লিখে, সাবাদিকতা করে, লোক আর বাযবসায়ীদের পরামর্শ দেয় এবং সর্বোপরি ইন্টারনেটযুগে আমাদের বদলে যাওয়াকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখে। সে কারণে তার এনালিসিস গুলোএকেবারে মর্মে গিয়ে পৌঁছে।
বইটি শুরু হয়েছে জার্ভিসের নিজের একটি অভিজ্ঞতা দিয়ে। ডেল কোম্পানির একটিল্যাপটপ কেনার পর বেচারা ঠিকমতো কাস্টোমার সার্ভিস পায়নি। শেষমেষ সেটি তিনিতার ব্লগে লিখেন। এরপর নানা ঘটনার মাধ্যমে ডেল কর্তৃপক্ষ তার প্রস্তাবগুলোমেনে নেয় এবং তার সমস্যাকবলিত ল্যাপটপটি বদলে দেয়। এ থেকে আস্তে আস্তে গুগলে ঢুকে পড়েন তিনি।
ইন্টারনেট আর গুগল মিলে একটি নতুন জগৎ তৈরি করছে। এ জগতের অনেকখানি আরআগের ব্যবসার নিয়ম মানে না। দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি প্রায়ইবক্তৃতা দিতে যাই। ওপেন সোর্সের বক্তৃতা হলে যেমন গুগলের কথা আসে তেমনিব্যবসার কথা হলেও সেটি আসে। ওপেন সোর্সের সুবিধা যে আমরা সবাই ভোগ করি তারউদাহরণ হিসাবে আমি গুগলের কথা বলি। গুগলের সব সার্ভার ঐ ওপেন সোর্সে চলে।একইভাবে গুগলের হোম পেজের কথা বলতে হয় তার সিম্পিসিটির জন্য। অনেকের পক্ষেবোঝা মুশ্কিল যে বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা গুগল কেমন করে করে। তার রেভেনিউ আসেতার ‘সাইড ডোর’ থেকে। আমি যখন পড়লাম এই কোম্পানি জীবনে এক ফুটো পয়সাওবিজ্ঞাপনে ব্যয় করেনি তখন প্রথমে খুব অবাক হলাম। পরে দেখলাম তাইতো কোনদিনতো গুগলের কোন এডের কথা শুনি নাই! তারপর থেকে হাসছি। আমি কেন হাসছি তাসরাসরি বলা নিষেধ তবে তারা সমঝদার তারা নিশ্চয়ই আমার হাসির কারণ বুঝতেপারছেন।
যাকগে, বই-এর কথায় আসি।গুগলের ১০টি সোনালী নীতিরকথা সবাই জানে। জার্ভিস সেগুলোকে সামনে এনেছেন। সঙ্গে অন্য অনেকপ্রাসঙ্গিক কথা। ভাল লেগেছে জার্ভিস আমার একটি কথা, যা আমি বলে বেড়াই, তারসঙ্গে একমত হয়েছেন জোর গলায়। ‘Do mistakes well’ ঠিকভাবে ভুল করো। আমরাসবাই সফল হতে চাই, ঠিক কাজটাই করতে চাই কিন্তু কখনো ভুল করতে চাই না। আমিবলি আমাদের নতুন প্রজন্মকে সাফল্যের সঙ্গে ফেইল করার সুযোগ দিতে হবে। নতুবা আমরা সাকসেস স্টোরি পাবো না। একটি ছড়াও বানিয়েছি
উদ্যম আর উদ্ভাবনে মনকে উদার করো
একটি গুগল পাওয়ার তরে হাজর গুগল গড়ো।
জার্ভিস প্রায় সুর মিলিয়ে ভুলের কথা বলেছেন। ভুল না করলে এগুনো যাবে না এই সময়ে। কারণ ঠিক কোনটিতে আপনি সফল হবেন সেটা কে জানে।
এরপরে জার্ভিস জোর দিয়েছেন নেটওয়ার্কিং-এ। এ যুগে টিকে থাকার অপর নামনেটওয়ার্ক – সামাজিক, ব্যবসায়িক কিঞবা কাস্টোমার কেয়ার। চোখ কান খোলা রেখেনিজের রেভিনিউ খুঁজতে হবে। সোজা রাস্তায় সেটি নাও আসতে পারে। এ জন্যনেটওয়ার্ক করতে হবে। বেশ কিছু ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। এর মধ্যেজুকারবাগের আর্ট কোর্সে গ্রেড ভাল করার গল্পটিও আছে। সেখানে গুরুত্বপূর্ণহলো এতে কেবল একা জুকারের গ্রেড ভাল হয়নি, ক্লাসের সবার গ্রেড ভালহয়েছে। জানিয়েছেন ফিলিপিনো প্রেসিডেন্ট এসত্রাদাকে উৎখাত করার সময় কীভাবেমোবাইল ফোনের এসএমএস কাজে লেগেছে। আমার মনে পড়লো বাগেরহাটের প্রত্যন্তএলাকার একটি গ্রামের লোকেরাও নিজেদের একত্রিত করতে এখন এসএমএস ব্যবহার করে।
জনগণের যে প্রযুক্তি জনগণ তৈরি, উন্নয়ন, বিকশিত করে, সে ওপেন সোর্সের প্রতিগুগলের আস্থার কথা জার্ভিস লিখেছেন। লিখেছেন প্রযুক্তির নির্বাচনে যেন ভুলনা হয়।
আরো বলেছেন এখন সংগঠিত হওয়ার জন্য তথাকথিত সংগঠন লাগে না। এই সময়ের এইজায়গাটিতেই আমার সবচেয়ে বেশি আশা। বছর দুই আগে ব্রিটিশ কাউন্সিলের একটি জরিপের কথা মনে পড়ছে। সেখানে আমাদেরনতুন প্রজন্ম পরিবর্তনের জন্য কাজ করতে যেমন আগ্রহের কথা বলেছে তেমনিএখনকার রাজনীতির প্রতি অনাগ্রহের কথাও বলেছে। তথ্যপ্রযুক্তি আমাদেরসংগঠনবিহীন সংগঠিত হওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে। সংগঠিত হওয়ার নতুন এই সুযোগ, আমি নিশ্চিত, নতুন প্রজন্মকে নতুন রাজনীতির সংগঠন গড়ে তুলতে উৎসাহিত করবে।আমাদের দেশেও ফেইসবুক-আর ব্লগে ক্যাম্পেইন চালিয়ে যে সমাবেশ আর আন্দোলন করাযায় সেটা আমরা এরমধ্যে দেখেও ফেলেছি।
ইন্টারনেটদুনিয়ায় একটি বড় শক্তি – সম্মিলিতের শক্তি। একটা সময় ছিল যখন সংগঠিতহতে হলে সংগঠন করতে হতো, এখন সেটা লাগে না। যাদের মনে আছে তারা জানেন, ফিলিপিনো প্রেসিডেন্ট এসত্রাদার পতনের জমায়েতটি হয়েছে এক ঘন্টায় এবং সবাইকেডাকা হয়েছে মোবাইল ফোনে, এসএমএসে!
আমার নানান বক্তৃতায় আমি এই বই থেকে জানা জুকারবার্গের গল্প বলি। আর্ট কোর্সেরপরীক্ষার সপ্তাহখানেক আগে জুকারবার্গ আবিস্কার করে এই কোর্সে তার পক্ষেপাস করা সম্ভব হবে না (সে সময় সে একটি নতুন কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় যুক্তছিল)। কিছুক্ষন ভেবেচিন্তে জুকারবার্গ বিখ্যাত আর্টিস্টদের বিভিন্নশিল্পকর্মের ছবি গুগল করে ডাউনলোড করে। তারপর সেগুলোকে একটি কমনস্পেসেআপলোড করে, প্রত্যেক ছবির নিচে একটি টেক্সট বক্স। তারপর তার ক্লাসের সববন্ধুদের ই-মেইল করে জানায় যে, সে একটি টিউটোরিয়াল তৈরি করেছে, সবাই মিলেসেখানে নিজেদের জানা জ্ঞান জাহির করতে পারে!!! ফলাফল – পরীক্ষা শেষে কোর্সটিচার ক্লাসে এসে বলেছেন পুরো ক্লাসের গ্রেড অন্য যে কোন বারের চেয়ে ভালহয়েছে। জুকারবার্গ নিজে ভাল করেছে সবার ভাল করার মধ্য দিয়ে!
প্রথম অংশে, গুগল রীতি, জেফ কয়েকটি অধ্যায়ে বিষয়গুলো আলোচনা করেছেন।প্রত্যেকটি সাব-হেডিং-এর মধ্যে এসেন্সটা খুঁজে পাওয়া যায়। মূল আলোচনাযেহেতু, ব্যবসা, তাই সেটি মুখ্য থাকে সবসময়। আমি কিছু সাবহেডিং এখানেউল্লেখ করছি —
তোমার সবচেয়ে খারাপ কাস্টোমার তোমার বন্ধু
তোমার সবচেয়ে ভাল কাস্টোমার তোমার পার্টনার
লিংক সবকিছু বদলে দেয়
সেরা যা পারো তা করো আর বাকীটুকু লিংক করো
ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভাবো
যদি তুমি সার্চেবল না হও, তাহলে তুমি নাই
তোমার গ্রাহক তোমার এড এজেন্সি
ছোট হল এখন নতুন বড়
মুক্ত সোর্সে যোগ দাও
ফ্রী ইজ এ বিজনেজ মডেল
লাইফ ইজ বেটা!
বি হনেস্ট
ডোন্ট বি ইভিল, ইত্যাদি।
প্রত্যেকটি সাব-হেডে জেফ বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন। কখনো গল্প বলেছেন ( একাজটি সবচেয়ে বেশি করেছেন।আমি প্রায়শ ভাবি আমাদের বিজনেজ স্কুল গুলোতেকেন খালি কেস স্টাডি পড়ায় না, খালি খালি কতগুলো নিরস থিউরি পড়ে কী লাভ –কেবল বইপূর্ণ গর্দভ তৈরি হওয়া ছাড়া। সম্ভবত এ কারণে আমাদের বিজনেজগ্রাজুয়েটদের প্রথম লক্ষ্য হয় কর্পোরেট চাকুরি কিংবা চাকুরির উন্নতি।কিন্তু হার্বাডের ওরা আগে নিজে কিছু করার চেষ্টা করে, না পারলে চাকরিখুঁজে।) কখনো উদ্ধৃতি দিয়েছেন। কখনো এনালজিখুঁজেছেন। জুকারবার্গের গল্প কয়েক জায়গায় বলা হয়েছে। বিশেষ করে তারচাছাছোলা কথাবার্তা আর স্যান্ডেল পড়ে সম্মেলনে আসার কথা।
বইএর প্রায় প্রতিটি লাইনে চিন্তার এবং না-চিন্তার খোরাক আছে। সব কিছুমেনে নিতে হবে এমন নয়। কারণ সবাই গুগল নয়। কারো কারো নাম স্টিভ জবস, এপল।কাজে জেফ শেষে এপল আর জবসের কথাতে এসেছেন। গুগল যদি হয় ছড়িয়ে দাও, খুলে দাওতাহলে জবস হবে তার উল্টো। তারপরও তার সাফল্য কম নয়। জেফ বলছেন এর কারণ হলো – এপল হলো এপল, জব হলো জব!
দুই ভাগের পর জেফ একটি কমেন্টারি তৈরি করেছেন জেনারেশন জি – মানে গুগলপ্রজন্ম নামে। এবং সবশেষে আলোচনাটি টেনে নিয়ে নিয়েছেন তার ব্লগে।
দ্বিতীয় অংশে ইউটোপিয়া অংশের একটি শিরোনাম হলো – ইউনাইটেড স্টেট অব গুগল।গুগল প্রজন্মের লোকেরা যদি রাজনীতির নিয়ামক হয় তাহলে কেমন হবে। এ অংশটিতেসম্ভবত আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় আশার আলো। মুক্ত চিন্তা, যুক্ত থাকারমানসিকতা সমৃদ্ধ রাস্ট্রনায়ক স্বভাবতই রাস্ট্রকে বদলে দিতে পারবে। যেমনভাবে ইন্টারনেট আর গুগল আমাদের চিন্তার জগৎকে পাল্টে দিচ্ছে।
আমরা যারা পরিবর্তনের প্রত্যাশী তাদের তো বটে, যারা সেটি চান না, তাদের সবাইকে আসলে এই বই পড়তে হবে।
সবার সেকেন্ড ডিফারেন্সিয়াল নেগেটিভ হোক।
11 Replies to “গুগল কী করবে?”
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.
স্যার মাফ করবেন। স্পেসিং এর জন্য পড়তে একটু অসুবিধা হয়। এটা ঠিক করে দিলে ভালো হবে।
অনেক ভালো লাগলো স্যার। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ্! 🙂
ভালো লাগলো মুনির ভাই
At last! Someone with the insight to solve the prmoleb!
স্যার, ২য় পার্টের অপেক্ষায় থাকলাম 🙂
অনেক ভালো লাগল লেখাটা,ইচ্ছে করছে এখনি বইটা পড়তে বসে যাই, ২য় অংশের অপেক্ষায় রইলাম 🙂
Felt so hopeless looking for answers to my qutisione…untsl now.
২য় পর্বের অপেক্ষায় রইলাম। আমাদের দেশে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কত কেস স্টাডি পড়ায় জানিনা, তবে এমআইএসটি’তে অনেক কেস স্টাডি পড়ানো হয়। Strategic Management ক্লাস নিয়েছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির ড. হরিপদ ভট্যাচার্য, উনি শুধু কেস স্টাডিই পড়িয়েছিলেন, কেস স্টাডি পড়াতে গিয়ে যতটা দরকার থিওরি পড়িয়েছিলেন। আমাদের বিজনেস স্কুল গুলোতে অনেক অনেক কেস স্টাডি পড়ানো দরকার, থিওরিতো সবসময়েই বোরিং।
স্যার ২য় পার্ট পাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। এপার্ট থেকে যা পেলাম তা হল ‘ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভাবো’ , ‘ফ্রী ইজ এ বিজনেজ মডেল’
Web hosting কিওয়ার্ডের গুগল এ্যডওয়ার্ডের ভ্যালু এর আগে দেখলাম ১২ ডলার সামথিং আর ‘Free web hosting’-এর ভ্যালু দেখলাম ৪৩ ডলার প্লাস !!!
how could I get this book..pls help me..I just read the article