তোমার জগৎ গড়ো – একটি খসড়া তালিকা

Spread the love

ucanআমাদের পরিবার আসলে শিক্ষক পরিবার। আমার দাদা মৌলভী আহমদ চৌধুরী শিক্ষকতা করেছেন, স্কুল তৈরি করেছেন এবং বাসায়ও একটি ঘরোয়া পাঠাগার তৈরি করেন। বাবা প্রথম জীবনে কলেজের শিক্ষক ছিলেন। খুব বেশিদিনের জন্য নয় অবশ্য (কী আশ্চর্য তার এক ছাত্রের ছেলে আমাকে খুঁজে নিয়েছিল বুয়েটে এসে)। মা’কে বিয়ে করার পর খালেদ মামা (পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হয়েছিলেন এবং দেশে ইসলামী ব্যাংকিং প্রচলণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন) বাবাকে ব্যাংকার বানিয়ে ফেলেন। আর মা তো স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন, প্রথমে অপর্ণা চরণ এবং পরে ডা. খাস্তগীর স্কুলে।

কাজে ছোটবেলা থেকেই আমাদের বাসায় একটা পড়া পড়া ভাব ছিল। আমরা বেশিরভাগ উপহারই পেতাম বই। আমাদের বাসায় আমরা কিশোর বাংলা, নবারুন রাখতে শুরু করি যখন আমি আর আমার ভাই ত্রি-ফোরে পড়ি তখন থেকে। ক্লাস ফাইভ থেকে আমাদের বাসায় ভারতীয় আনন্দ মেলা রাখা হয়। কাজে ফেলুদা, তোপসে, গোগল, টেনিদা কিংবা বুকুনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়ে যায় ছোট বেলাতেই। কুয়াশা আর মাসুদ রানা আমাদের বাসায় ঢোকে সেভেন-এইটে। সে সময় রাইফেল ক্লাবের সামনে ৫০ পয়সা দিয়ে কুয়াশা ভাড়া আনা যেত, পড়ার জন্য। ঈদি কিংবা খরচের টাকা জমিয়ে বই ভাড়া এনে পড়তে শুরু করি।

anandaপূজাবার্ষিকী আনন্দমেলার কারণে প্রফেসর শঙ্কু, দুই সমরেশ (মজুমদার ও বসু), মতিনন্দী এদের সঙ্গে যেমন পরিচয় হয় তেমনি বাংলাদেশের লেখকদের বইও আমরা গ্রোগ্রাসে পড়তে শুরু করি। anandaকুয়াশা আর মাসুদ রানার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয় জিম করবেটের রুদ্র প্রয়াগের চিতার সঙ্গে, সাপ্তাহিক বিচিত্রার কারণে পচাব্দী গাজির সুন্দরবনের বাঘের সঙ্গে লড়াইও দিব্যি দেখতে শুরু করি। সাপ্তাহিক বিচিত্রা, সন্ধানীর ঈদ সংখ্যা সবই আমাদের বাসায় কেনা হতো। বেগম তো ছিলই। ছিল চিত্রালী। শামসুর রাহমান, সৈয়দ হকের সঙ্গেও  দ্রুত পরিচয় হয়ে যায়।

পরে যখন ঢাকায় বুয়েটে ভর্তি হই তখন ক্লাস শুরুর আগে একটা লম্বা ছুটি পেয়ে যাই। তখন হাতে খড়ি হয় আগাথা ক্রিস্টির মূল লেখার সঙ্গে। যেদিন পড়তে পড়তে প্রথম আবিস্কার করি তাঁর মার্ডার ইন দ্যা ক্লাউড অনুসারে কুয়াশা ৭১, ৭২ লেখা হয়েছে সেদিন খুবই চমকিত হয়েছিলাম। চট্টগ্রাম ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং তার পাশের মিউনিসিপ্যাল পাঠাগারে আমার এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা প্রথম দেখা। প্রতিদিনই দুপুরে ভাত খেয়ে সেখানে চলে যেতাম। সন্ধ্যার দিকে ফেরৎ আসতাম।

বুয়েটে আসার পর খুঁজে পাই বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের। সেই পর্বের গল্প আমার পাঠকেরা জানে।

আজকের গল্পটা ভিন্ন।  গত প্রায় মাসখানেক যাবৎ বেশ কিছু জায়গায় অনেক তরুনের সঙ্গে দেখা, কথাবার্তা বিনিময় হয়েছে। এদের অনেকেই দেখলাম পড়তে চায় কিন্ত তারা জানে না আসলে কোন কোন বই পড়বে, দল বেঁধে কোন সিনেমা দেখবে, কোন ভাষন শুনবে, কোন গান শুনবে। তাই ভাবলাম একটা তালিকা যদি করা যায়!

বছর দুয়েক আগে আমি কেবল এসএসসি পড়ুয়াদের জন্য একটা তালিকা বানিয়ে ছিলাম। সেটা আমি শেয়ার করছি এই আশায় যে, আমরা সবাই মিলে হয়তো এই তালিকাটাকে আরো সমৃদ্ধ করতে পারবো।

যা পড়তে পারো

anandaরবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা, শেষের কবিতা, গল্পগুচ্ছ, কাজী নজরুলের রিক্তের বেদন, জীবনানন্দের বনলতা সেন, বঙ্কিম চন্দ্রের কপালকুন্ডলা (পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছো), আল মাহমুদের সোনালি কাবিন, হেলাল হাফিজের যে জলে আগুন জ্বলে (এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়), সুকান্তের ছাড়পত্র, সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে-বিদেশে,চাচা কাহিনী, মার্কস আর এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো, তলস্টয়ের আন্না কারেনিনা, হেমিংওয়ের ফেয়ারওয়েল টু আর্মস, এরিক মারিয়া রেমার্কের অল কোয়ায়েট ইন দ্যা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট, সুভাষ মুখোপাধ্যায় অনুদিত নাজিম হিকমতের কবিতা, হুমায়ুন আহমেদের ওরা তিনজন, মধ্যাহ্ন, নন্দিত নরকে, জোৎস্না ও জননীর গল্প, মুহম্মদ জাফর ইকবালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, হাত কাটা রবিন, আমি তপু, বিজ্ঞানী সফদর আলির মহা মহা আবিস্কার, দেবী প্রসাদের বিজ্ঞান কী ও কেন, যে গল্পের শেষ নেই, ম্যাক্সিম গোর্কির মা, নিকোলাই-এর ইসপাত, আলোক্সান্দার বেলায়েভের উভচর মানুষ, হৈটি টৈটি, ম্যাক্সওয়েল ইকুয়েশন, রসুল গামজাতভের আমার জন্মভূমি ও বিভুতি ভুষনের চাঁদের পাহাড়। কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা সিরিজের – আই লাভ ইউ, ম্যান; পালাবে কোথায়, ধ্বংস পাহাড়, কুয়াশা সিরিজের কয়েকটা; রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দা সিরিজের যতগুলো যোগাড় করেত পারো। আগেকার দিনের গোয়েন্দারা কেমন করে বুদ্ধি খাটাতেন সেটা জানার জন্য কিরীটি রায় সিরিজের কতক বই জোগাড় করে ফেল, খুঁজে পেলে দস্যু মোহন বা দস্যু বনহুর সিরিজের কিছু বই যোগাড় কর।  ফেলুদা আর প্রফেসর শঙ্কুর কাহিনীগুলো যা বাদ আছে সেগুলো পড়ে ফেল।

সত্যজিৎ রায়ের ১২-এর গল্পগ্রন্থগুলোও কিন্তু মজারনামের মত – এক ডজন গল্প, আরো এক ডজন, এবারো বারো, আরো বারো, একের পিঠে দুই (বেঁচে থাকলে এই সিরিজের পরের বইটার নাম হতো এক দশ দুই!) । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব-পশ্চিম, শহিদুল্লাহ কায়সারের সংশপ্তক, জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে, মানিক বন্দোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা, শরদিন্দুর ব্যোমকেশের সব বই, আইনস্টাইন আর ইনফেল্ডের পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাস, স্টিফেন হকিং-এর এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম, জামাল নজরুল ইসলামের কৃষ্ণ বিবর, জহরলাল নেহেরুর গ্লিম্সেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি, সত্যজিৎ রায়ের আওয়ার ফিল্ম, দেয়ার ফিল্ম, রিচার্ড ফাইনম্যানের সিওরলি ইউ আর জোকিং; চেতন ভগতের থ্রি মিসটেকস; আর কে নারায়ণের মালগুড়ি ডেইজ; বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের রস্ট্রাম থেকে, ব্রাক্ষ্মণের বাড়ির কাকাতুয়া; জাস্টিন গার্ডের সোফি’জ ওয়ার্ল্ড; প্লেটোর সংলাপ; কাহালিল জিব্রানের দ্যা প্রফেট, রিচার্ড ডকিন্সের ম্যাজিক অফ রিয়ালিটি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক বই আছে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী তোমাকে পড়তেই হবে।

যাদের সমাজ পরিবর্তনের ইচ্ছে আছে তারা পড়তে পারো হাউ টু চেঞ্জ দ্যা ওয়ার্ল্ড, প্রমিজ অব এ পেনসিল, হাউ টু স্টার্ট সামথিং দ্যাট ম্যাটার্স। যাদের উদ্যোক্তা হওয়ার খায়েশ তারা এখন থেকে ভার্জিনের মালিককে চেনো, তার বইগুলো পড়তে থাকো। যাদের আর একটু এগিয়ে এটা উদ্যোক্তাবান্ধব পরিবেশ গড়ার ইচ্ছে তাদের জন্য স্টার্টআপ নেশনস, বিজনেস মহারাজ।

তবে পড়ার সময় মনে কোন খেদ রেখো না। এখন তোমার পড়ার সময়। যা পাবে সব পড়বে। প্রতিদিন অন্তত একটি দৈনিক পত্রিকা পড়ার অভ্যাস গড়ে তোল। প্রথম আলোতে শব্দজট এবং সুডোকু মেলানোর খেলা থাকে, সেগুলোতেও অভ্যস্থ হতে পারো। শব্দজট আর সুডোকু তোমাকে ঠান্ডা মাথায় সমস্যা সমাধানে অভ্যস্থ করে তুলবে। ইংরেজি অনেক দৈনিকে প্রতিদিন শব্দজট থাকে।

যে সব সিনেমা দেখতে পারো

ব্যাটলশিপ পটেমকিন, ক্রেইনস আর ফ্লাইং, এডমিরাল ইয়ামামাটো, ব্যাটল অব বালজ, সাউন্ড অব মিউজিক, চার্লি চ্যাপলিনের সব, ইটি-দি এক্সট্রা টেরিস্টিয়াল, হোয়্যার ঈগল ডেয়ারস, গানস অব নাভারন, ওমর মুখতার, এটেনবরোর গান্ধি, টার্মিনেটর-১,২,৩, লাইফ অব পাই, ফরেস্ট গাম্প, ম্যাট্রিক্স, থ্রি ইডিয়ট। সত্যজিৎ রায়ের অপু ট্রিলজি, জয় বাবা ফেলুনাথ; সুবর্নরেখা, পদ্মা নদীর মাঝি, উত্তম –সুচিত্রার কয়েকটি, থ্রি ইডিয়ট, দামু, তারে জামিন পার, স্বদেশ, নায়ক, কোই মিল গ্যায়া । বাংলাদেশের মধ্যে জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া, হুমায়ুন আহমেদের আগুনের পরশমনি,। এছাড়া  সুপ্রভাত, মুক্তির গান, রানওয়ে, ওরা এগারোজন, বেদের মেয়ে জোৎস্না, আম্মাজান, রূপবাণ, মালকা বানু । ইরানের চলচ্চিত্রকার মাজিদ মাজিদির চিল্ড্রেন অব হেভেন, কালার অব প্যারাডাইস, সং অব স্প্যারো। এখন যে সিরিজগুলো চলছে তার মধ্যে শার্লককে রাখতে পারো এই তালিকায়। ডেভিড এ্যাটেনবোরো অনেকগুলো ডকুমেন্টারি বানিয়েছেন, কার্ল সাগানের আছে ব্লু প্ল্যানেট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিয়ে নির্মিত আরো কিছু ছবি রাখতে পারো তোমার তালিকায়।

যা যা শুনতে পারো

রবীন্দ্রণাথ ঠাকুর, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, অতুল প্রসাদ আর ডিএল রায়ের যতো গান শুনতে পারো। শুনতে থাকো এরিক ক্ল্যাপটন, বব মার্লি, বব ডিলানের যতো গান পাও, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের যতো গান খুজে পাও, সোলসের প্রথম দিকের এলবামগুলো, রেনেসা আর আজম খানের গান। শুনতো পারো ফেরদৌস ওয়াহিদ আর হাবীবের গান। কবীর সুমন আর নচিকেতার গানও শুনতে পারো। বিশেষ ভাবে শুনো কবীর সুমনের তিনি বৃদ্ধ হলেন আর তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা (এটি শহীদ কাদরির কবিতা নিয়ে গান)।  দরজা খুলে কারো দেখা পাও কী না সে চেষ্টাতেও দোষ নেই যেমন নেই তুমি যেমন আছো তেমন যদি থাকতে চাও। শুনতে পারে বেটোফেনের সিম্ফনি, রবি শংকর আর বিসমিল্লাহ খানের সেতার, ওস্তাদ জাকির হোসেনের তবলা আর চৌরাশিয়ার বাশি। রবার্ট ক্লেডারম্যনের পিয়োনোতে বাখ আর মোৎজার্টের কিছু সুরের একটা ক্যাসেট পাওয়া যেত আমাদের সময়ে, এখনো পাও কী না খোজ নিতে পারো।

যে সব বক্তৃতা পড়তে/শুনতে পারো

হযরত মুহম্মদ (সা:)-এর বিদায় হজ্জ্বের শেষ ভাষন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষন,মার্টিন লুথার কিং-এর আই হ্যাভ এ ড্রিম,জন এফ কেনেডির ভেবো না দেশ তোমাকে কী দিয়েছে ভাবো তুমি দেশকে কী দিতে পারো, দ্যা গলের ফ্রান্স হ্যাজ লস্ট এ ব্যাটল বাট হ্যাজ নট লস্ট দ্যা ওয়ার, স্টিভ জবসের স্টে হাংরি স্টে ফুলিশ,আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গের বক্তৃতা, হাউজ অব কমন্সে চার্চিলের আই হ্যাভ নাথিং টু ওফার বাট ব্লাড, টয়েল, টিয়ার্স এন্ড সোয়েট, ১৯৬৪ সালে কোর্টে নেলসন মান্দেলার আমি শাদাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে, আমি কালোদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে।

মনে রেখ, এই তালিকাটি কোন বিশেষ তালিকা নয়। এটি আমার ব্যক্তিগত পছন্দের পড়া, শোনা আর দেখার তালিকা।

তুমি তোমার মত করে তালিকাটিকে সাজিয়ে নিও। এই পড়া-দেখা-শোনা তোমার জগৎকে আলোকিত করবে।

তোমার জীবনের সেকেন্ড ডিফারেন্সিয়াল নেগেটিভ হোক।

 

3 Replies to “তোমার জগৎ গড়ো – একটি খসড়া তালিকা”

  1. বই- তাজউদ্দিন আহমেদ এর ডায়েরি,
    সিনেমা- pursuit of Happines.
    বাদ গিয়েছে।

Leave a Reply