শেষ হইয়াও হইল না শেষ : অবশেষে পোস্টমাস্টার

Spread the love

Postmaster-1[ছোটবেলায় কোন কোন গল্প পড়িবার সময় কোনো কোনো গল্প পড়িয়া মন খারাপ হ্ইত, কোনোটা পড়িয়া প্রবল উৎসুক্য হইত, জানিবার বড়ই ইচ্ছা হইত ইহার পর কী? আগেকার দিনের লেখকেরা সিকুয়েলের ব্যাপারটা বেশি নজর দিতেন না। ফলে, তাহারা অনেক কিছুই অর্ধেক করিয়া রাখিয়া দিতেন। সেরকমই একটি গল্প রবীন্দ্রণাথ ঠাকুরের পোস্টমাস্টার। ছোটবেলার পর মনে হইতো কেহ না কেহ একদিন আমাদের জানাইবে পোস্টামাস্টারের কি হলো, রতনেরও বা জীবনের পরণতি কি। কিন্তু, আমাদের ক্ষুদ্র মনের বাসনা কেহ পূরণ করিল না। বুয়েটে পড়িবার সময় তাই আমরা বাধ্য হলাম এই মহান দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলিয়া নেওয়ার। সে সময় আমরা অনেকগুলো গল্পই শেষ করিয়াছি। এখন ভাবছি সেগুলো এক একে প্রকাশ করিব। অবশেষে পোস্টমাস্টার এই পর্বের প্রথমটি। এটির একটি সংক্ষিপ্ত ভার্সন সিমু নাসের রস‍+আলোতে প্রকাশ করিয়াছিল। এক্ষণে সম্পূর্ণ প্রকাশ করা হইল।]

 

কয়েক দিন ধরিয়া কথাটি পাড়িবেন বলিয়া মনস্থির করিয়া রাখিয়াছেন ভারতী দেবী। কিন্তু সংসারের শেষ সময়ের ডামাডোলে কিছুতেই আর বলিতে পারিতেছেন না। পরিবারের সকলের খাওয়া-দাওয়ার পর পাচক বামুনকে পরেরদিন সকালের নির্দেশনা দেওয়া, সদর দরজা বন্ধ করা ইত্যাদি সারিয়া যখন তিনি ঘুমাইতে আসেন ততক্ষণে কর্তার এক পশলা ঘুম হইয়া ওঠে। মায়াবশত তাহাকে আর জাগ্রত করিতে ভারতী দেবীর মন সায় দেয় না। কিন্তু আজ তাহাকে বলিতেই হইবে, না হইলে বিলম্ব হইয়া যাইতে পারে।Postmaster-2

কেতকী তাহার একমাত্র ননদ বিনোদিনীকে লইয়া এই বাড়িতে আসিয়াছিল। কেতকী তাহাদের বড় কন্যা। বছরখানেক হইয়াছে তাহাকে বাগবাড়ির চাটুয্যে বাড়িতে বিবাহ দিয়াছেন। কন্যা বাপের বাড়িতে আসিবে তাহাতে কোনো উৎকণ্ঠা হইবার কথা নয়। কিন্তু কেতকীর সঙ্গে ইদানীং তাহার ননদ বিনোদিনীও আসে এবং কেতকী প্রায়শ তাহার দাদার ঘরে গল্প করিতে থাকে। সেখানে বিনোদিনীও থাকে।
ভারতী দেবীর আশঙ্কা কেতকী তাহার দাদার সঙ্গে বিনোদিনীর বিবাহ দিতে চায়। ভারতী দেবীর ধারণা যে অমূলক নয়, তাহা আজ কেতকী নিজ মুখে স্বীকার করিয়াছে। বলিয়াছে বিনোদিনী দেখিতে সুন্দর, তাহাদের পালটি ঘর এবং সর্বোপরি অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাস দিয়াছে। তাহার পণ্ডিত ভাইয়ের জন্য এর চেয়ে ভালো পাত্রী আর কোথায় পাওয়া যাইবে!
কেতকীরা যাইবার পর হইতে ভারতী দেবী পণ করিয়া রাখিয়াছে, আজকে কথাটা উঠাইবেন। রাতের আহারের পর তিনি তাই সকলকে কাজ শেষ করিবার তাড়া লাগাইলেন এবং অন্যান্য দিনের চেয়ে অনেক আগে শয়নকক্ষে প্রবেশ করিলেন। ভারতী দেবীর অস্থিরতা দেখিয়া কর্তা কিছু আঁচ করিতে পারিয়াছেন। তাই তিনি বিছানায় উঠিয়া বসিলেন এবং ভারতী দেবীর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাইলেন।
‘কয়েক দিন ধরিয়া আপনাকে একটি কথা বলিতে চাহিতেছি। কথাটি আমাদের মাস্টার সম্পর্কে।’
শুনিয়া কর্তা একটু চমকাইয়া উঠিলেন। মাস্টার তাহাদের বড় সন্তান। বছর দুই আগে ডিগ্রি পাস করিয়া ডাক বিভাগে যোগ দিয়াছিল। পোস্টমাস্টার হিসেবে একটি গণ্ডগ্রামে পোস্টিং পাইয়া সেখানে চলিয়া গিয়াছিল। পোস্টমাস্টার বলিয়া গিন্নি তাহাকে মাস্টার বলিতে শুরু করে। কিন্তু দেড় বছরের মাথায় চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়া মাস্টার কলকাতায় ফিরিয়া আসে। এরপর তিনি তাহাকে জগৎপুর উচ্চবিদ্যালয়ে মাস্টারির চাকরি জোগাড় করিয়া দিয়াছেন। এক্ষণে সে স্কুল মাস্টারি এবং ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের জন্য পড়ালেখা করিতেছে। ‘মাস্টারের আবার কী হইল’- কর্তা জানিতে চাহিলেন।
‘কী আর হইবে। দিনভর মন মরা থাকে। বুবানী বলিয়াছে তাহার দাদা নাকি এখন আগের মতো হই-হুল্লোড়ও করে না।’
‘তাহার তো মাস্টারি আর নিজের পড়া আছে। হই-হুল্লোড়ের সময় কই?’ কর্তা গিন্নিকে আশ্বস্ত করিবার চেষ্টা করে। কিন্তু ভারতী দেবী বলিলেন, “আমি সেই কথা বলছি না। বলছি তাহার বিবাহের কথা। “
‘মাস্টারের বিবাহ? এখুনি? কী দরকার। তাহাকে পড়ালেখা করিতে দাও।’
‘আমার তো আপত্তি ছিল না।’ ভারতী দেবী জানাইলেন। তারপর কেতকীর ননদ বিনোদিনীর কথা বলিয়া বলিলেন, ‘আমি মাস্টারের ছোটবেলা থেকে ঠিক করিয়া রাখিয়াছি। ইন্দিরা দিদির বড় মেয়ে সুহাসিনীকে এই ঘরে আনিব। আমরা প্রস্তাব দিলে দিদি ফিরাতে পারিবেন না।’
‘ও। এই কথা।’ কর্তা জানিতে চাহিলেন,”তা তোমার ভাগনী সুহাসিনী এখন কী করে।
‘সে কি গো। তুমি ভুলিয়া গেলে কেমনে। গেল বছর না সে ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাস করিয়াছে। এখন ব্র্যার্বোনে পড়িতেছে। দিদি জানাইয়াছে, এখন কলেজ বন্ধ।’
‘সে তুমি যা ভালো মনে করো। তোমার কোনো প্রস্তাবে আমি কখনো না করি নাই।’ কর্তা আবার শুইয়া পড়িবার উদ্যোগ নিলেন। ‘তবে আগে মাস্টারের সম্মতিটা জানিয়া লইয়ো।’
কর্তার কাছ হইতে গ্রিন সিগন্যাল পাইয়া পরেরদিনই ভারতী দেবী দুর্গাপুরে দিদি ঠাকরুনের বাসায় চলিয়া গেলেন। সঙ্গে কনিষ্ঠ কন্যা বুবানীকে লইয়া গেলেন।

দুই ভগ্নির কী আলাপ হইয়াছে, তাহা আমরা জানিতে পারিলাম না। তবে দিন দুই পরে মাস্টার তাহার পরীক্ষার পড়া পড়িতে যাইয়া পুস্তকের মধ্যে একটি ছবি আবিষ্কার করিল। মাস্টারের মাথা প্রখর। এটি যে তাহার আদরের ভগ্নি বুবানীর কাজ তাহা সে বুঝিতে পারিল। ছবির সুন্দর, সহাস্য মুখ এবং বিনুনি দোলানো মেয়েটিকে তাহার কেমন জানি চেনা চেনা মনে হইল। বুবানীকে ডাকিয়া জিঙ্গাসা করা মাত্রই সে কহিল, ‘সে কি দাদা! তুমি হাসি দিদিকে চিনিতে পারিতেছ না। বড় মাসিমার মেয়ে গো। দেখেছ কত সুন্দর হয়েছে। কেমন টিকোলো নাক।’

তাই তো। মাস্টারের মনে পড়িল হাসিকে সে গ্রামে যাওয়ার আগে শেষ দেখিয়াছিল। কিন্তু হাসির ছবি তাহার কাছে কেন?

বুবানীর মুচকি হাসি দেখিয়া মাস্টার সকলি আন্দাজ করিতে পারিল। যত্ন করিয়া ছবির দিকে তাকাইতে গিয়া তাহার জানি কী হইল। মাস্টারের হাতের ছবিতে হাসির সহাস্য মুখটি ক্রমশ বিলীন হইয়া গেল। সেখানে ফুটিয়া উঠিল এক গ্রাম্য বালিকার দুষ্টুমী-মাখা মুখ। মুখটি ক্রমশ জোরে জোরে পড়া পড়িতে শুরু করিল। মাস্টার দেখিল একটি একঘরের বাড়ি। সেখানে সে জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকিতেছে। আর একটি কোমল হাত তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া দিতেছে, মাথায় পট্টি বাঁধিয়া দিতেছে। মনের অজান্তে মাস্টারের হাত নিজ কপাল স্পর্শ করিল!
পরেরদিন সকালে তোলা জলে স্নান করিবার সময় মাস্টারের চোখ জলে ভরিয়া উঠিল। তাহার মনে হইল তাহাকে দিয়া নদী থেকে জল আনানোর কাজটি করা ঠিক হয় নাই। না জানি বালিকার কত কষ্ট হইয়াছে! স্কুলে পড়াইবার কালেও মাস্টারের মানসপটে বারবার একটি মুখ ভাসিয়া উঠিল।

দিন কয়েক পরে কেতকী বাড়িতে আসিয়া দাদার অবস্থা দেখিয়া হই হই করিয়া উঠিল। তাহার পণ্ডিত দাদার কী হইয়াছে? বুবানীর কাছ থেকে সুহাসিনীর কথা শুনিয়া সে রাগিয়া উঠিল। ভাবিল, মায়ের সঙ্গে তর্ক করিবার পরিবর্তে দাদাকেই খোলা মনে জিজ্ঞাসা করা যাক, তাহার কাহাকে পছন্দ? বিনোদিনী না সুহাসিনী? দাদার পছন্দকেই সে মানিয়া লইবে।
কেতকী তাহার কনিষ্ঠ ভগ্নিকে সঙ্গে লাইয়া দাদার কক্ষে প্রবেশ করিল। টেবিলের ওপর দাদা কী জানি পড়ালেখা করিতেছে।
দুই ভগ্নির জোরাজুরিতে মাস্টার যাহা বলিল, তাহা শুনিবার জন্য কেতকী বা বুবানী কেহই প্রস্তুত আছিল না। মাস্টার তাহার পোস্টমাস্টার জীবনের সকল ঘটনা দুই ভগ্নিকে খুলিয়া বলিল।
তাহার একাকী জীবনের বালিকার উপস্থিতি, তাহাকে পড়ানোর কথা এবং তাহার অসুস্থতার সময় সেই গ্রাম্যবালিকার একনিষ্ঠ সেবার কথা বর্ণনা করিয়া মাস্টার ঘোষণা করিল যে, তাহার হৃদয় ওই গ্রাম্য বালিকা দখল করিয়া রাখিয়াছে। সেইখানে হাসি বা বিনোদিনীর জন্য কোনো জায়গা নাই!
দুই বোন প্রথমে হতবাক হইলেও দাদাকে তাহারা গভীরভাবে ভালোবাসে। কাজেই তাহার মনোবাসনা পূরণের জন্য তাহারা কাজ করিবে স্থির করিল। মা ও বাবার কাছে বিষয়টি উপস্থাপনের জন্য তাহারা স্বীয় স্কন্ধে দায়িত্ব তুলিয়া লইল।
ইহার পরবর্তী ঘটনা দ্রুত ঘটিয়া গেল। কর্তার সায় থাকায় শেষ পর্যন্ত মায়ের মনও গ্রাম্য বালিকার প্রতি ঢলিয়া পড়িল। স্থির হইল কেতকী ও বুবানীকে লইয়া মাস্টার আগামী রবিবার গন্ডগ্রামে যাইবে। তাহাদের সঙ্গ দিবার জন্য কেতকীর বরও সঙ্গে যাইবে।

২.
গণ্ডগ্রামের নদীর ঘাটটির একটি পরিবর্তন মাস্টার লক্ষ করিল। ঘাটের সামনে যেখানে পারানির কড়ি আদায় করা হচ্ছে, সেখানে একটি দোচালা ঘর উঠিয়াছে। কড়ি দিয়া পার হইবার সময় বাড় মোড়ল মাস্টারকে চিনিতে পারিয়া বলিল, কী পোস্টমাস্টার। আমাদের মনে পড়িল নাকি? স্মিত হাসিয়া মাস্টার তাহার ভগ্নিদের লইয়া গ্রামের পথে রওনা হইয়া গেল। দ্রুত তাহারা পোস্ট অফিসের দিকে চলিয়া গেল। কিন্তু দেখা গেল পোস্ট অফিস বন্ধ। আশপাশেও কাহাকে দেখা গেল না।
দূরের বাড়িগুলোর দিকে যাইবার জন্য বুবানী পরামর্শ দিল। তাহারা সকলে দ্রুততার সঙ্গে মূল গ্রামের দিকে রওনা হইল। পথিমধ্যে মাস্টার তাহার প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করিল। রাস্তার বিভিন্ন গাছের সঙ্গে পরিচয় করাইয়া দিল।
গ্রামে ঢুকিবার মুখে তাহাদের ঘোষপাড়ার বাদল ঘোষের সঙ্গে দেখা হইয়া গেল। মাস্টারকে দেখিয়া বাদল ঘোষের মুখখানি আনন্দে ভরিয়া উঠিল। সে কহিল, আমি জানিতাম, খবর পাইলে আমাদের পোস্টমাস্টার নিজে আসিবে। তা তোমার সঙ্গে এরা কারা।
বাদল ঘোষের কথা শুনিয়া আগন্তুক দলটি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িল। কী খবর, কিসের খবর আর তার সঙ্গে মাস্টারেরই বা কী সম্পর্ক। কাহারো মুখে কোনো কথা সরিল না। কতক সময় পরে কেতকীর বরের মুখ দিয়া প্রথম কথা বাহির হইল, ‘কোন খবরের কথা বলিতেছেন, কাকা? আমরা তো কলকাতা থেকে আসিয়াছি।’
‘আমি রতনের বিবাহের কথা বলিতেছি। আজ তো তাহার বিবাহ।’ বাদল ঘোষ জানাইলেন। খবরটি তাহারা জানে না শুনিয়া তিনি কিছুটা বিস্মিত হইয়াছেন।
বাদল ঘোষের কথা শুনিয়া মাস্টার দাঁড়ানো অবস্থা হইতে বসিয়া পড়িল। বুবানী তাহাকে ধরার চেষ্টা করিল। আর কেতকী অবাক হইয়া বাদল ঘোষের কাছে বলিল ‘রতনের বিবাহ! কাহার সঙ্গে!!’
‘এই যে, মাস দুয়েক আগে যে নতুন পোস্টমাস্টার আসিয়াছে, তাহার সঙ্গে।’

2 Replies to “শেষ হইয়াও হইল না শেষ : অবশেষে পোস্টমাস্টার”

Leave a Reply