মাসুদ রানা ও তাঁর দপ্তর

Spread the love

আমার সাইটের ব্যানার বিজ্ঞাপনটি দপ্তর নামে একটি প্রোডাক্টের। ইদানীং অনেকেই এই প্রোডাক্টের নাম শুনেছেন। দপ্তরের উদ্যোক্তা মাসুদ রানাকে আমি অবশ্য দপ্তরের আগে থেকে চিনি। মাসুদ রানা ম্যালাদিন আগে মালয়েশিয়াতে গেছে। তারপর সেখানে গিয়ে দেখেছে বাংলাদেশের আইটির লোকেদের সেখানে সবিশেষ পাত্তা দেওয়া হয় না। তখন থেকে তার একটা জিদ হলো এমনদিন যেন আসে সেখানে সবাই মাসুদকে চিনতে পারে। কাজে প্রথমে চাকরি করে পরে ডেটাসফট মালয়েশিয়া নামে একটা প্রতিষ্ঠান সে গড়ে তোলে। এখন সেটি সেখানে বেশ বড় একটি আইটি সার্ভিস কোম্পানি। মালয়েশিয়ার লোকেরা এখন চাহিবা মাত্র মাসুদের সঙ্গে মিটিং করতে পারে না। তবে, এসব কারনে আমার সঙ্গে মাসুদের পরিচয় হয়নি। মাসুদ কেমন করে আমাকে খুঁজে নিয়েছে সেটা আমার ঠি মনে নেই, তবে শুরুটা দপ্তর নিয়ে এ নিয়ে কোন সন্দেহ নাই।
বেশ কয়েকবছর আগে মাসুদ আমাকে জানায় সে একটি সিএমএম/ইএমএস ইঞ্জিন তৈরি করতে চায়। শুনে আমি একটু চমকায়। কারণ আমাদের দেশে কোর প্রোডাক্ট নিয়ে কাজ করতে ইচ্ছুক এমন লোকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। এমনিতেই কেউ প্রোডাক্ট বানাতে চায় না। বেশির মধ্যে প্লাগ-ইন বা টেমপ্লেট। কিন্তু দেখা গেল ও ব্যতিক্রম। আমি প্রথমে পাত্তা দিই না। পরে দেখলাম না সে কী জানি একটা করছে, সত্যি সত্যি। তারপর জানলাম দপ্তর আসলে তাঁর স্বপ্ন।

মাসুদ রানা

দপ্তর আসলে অফিসের বাংলা। মাসুদের ইচ্ছে একটা পূর্নাঙ্গ দাপ্তরিক সফটওয়্যার স্যুট বানানো। তবে, সেটা সে একা একা করতে চায় না। কী করকম? একটু গভীরে যাওয়া যাক। অফিসকে ঘিরে যেসকল সফটওয়্যার প্রয়োজন দপ্তর তার সবকটি চাহিদা পূরণের জন্য একটি প্লাটফর্ম। দপ্তরের শুভ সূচনা ২০০৮ সালে মাসুদ রানার কুয়ালামপুরের আইটি কোম্পানীতে। নামকরণ নিয়েও হয় বিষদ গবেষণা। হাজারো নামের থেকে দশটি শর্ট লিস্টেড করা হয়। ১০টি নামের মধ্যে ৩টি, তার থেকে ১টি। এ যেন কঠিন অগ্নি পরীক্ষা। তবে মাথায় শুধু কয়েকটি বিষয়ই ছিল- নামটি হতে হবে সকলের মনে রাখার মতো ও ছোট, নামের বানান যেন যে কেউ নির্ভূলভাবে করতে পারে,  নামের সাথে কাজের মিল, ডোমেইল খালি থাকবে হবে ইত্যাদি, ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত “দপ্তর”। তবে নামে কী আসে যায়, কাজই আসর।

দপ্তর মূলত: একটি সিএমএস। অনলাইনের জগতে হাজারেরও অধিক সিএমএস আছে। সিএমএস হলো- ওয়েব সাইট তৈরী এবং ইকমার্স সাইট তৈরির জন্য একটি প্লাটফর্ম।

এতো এতো সিএসম থাকতে নতুন একটি সিএমএস কেন?
আমার এ প্রশ্নের উত্তরে মাসুদ বলে, “ নিশ্চই সিএমএস থেকে বেশিকিছু সুবিধা দিতে হবে। দপ্তরে অন্যান্য সিএমএস-এর সকল সুবিধাতো থাকছেই বাড়তি হিসেবে থাকছে ইএমএস। ইএমএস হচ্ছে এন্টারপ্রাইজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। এই ইএমএস এর আওতায় অফিসের যাবতীয় সফটওয়্যারের সমাধান থাকছে। অফিস অটোমেশন, ইআরপি, সিআরএ, একাউন্টিং, বিলিং, ইনভয়েজিং, ইনভেনটোরি, পে-রোল, হিউম্যান রিসোর্স সিস্টেম নিয়ে হাজারো সফটওয়্যারের সমন্বয় হচ্ছে দপ্তর”।

এমনতো আরও আছে তাই না?

মাসুদ “আছে। তবে এটি ব্যতিক্রম এ জন্য যে, সকল এপ্লিকেশন শুধু দপ্তর টিমই ডেভেলপ তৈরি করবে না। যেকোন পিএইচপি (লারাভেল) ডেভেলপার, সফটওয়্যার কোম্পানী এপ্লিকেশনগুলো তৈরি করতে পারবে। দপ্তরের মার্কেটপ্লেসে আপলোড করে যেকেউ তার ব্যবসাটা করে নিতে পারবে। আমরা সারা পৃথিবীতে নিয়ে যাবো দপ্তরের সকল এপ্লিকেশনগুলো”।

মানে অন্যান্য সিএমএসের মতো দপ্তরের ইঞ্জিন ব্যবহার করে যে কেউ একটি এপ্লিকেশন বানাতে পারবে, তারপর সেটি দপ্তরের মার্কেটপ্লেসে দিয়ে দেবে। এটুক বুজলেও আমি কিন্তু এর ব্যবসা মডেলটা বুজি নাই। কারণ দপ্তর একটি ফ্রি ও ওপেনসোর্স প্লাটফর্ম। বিভিন্ন মডিউল ক্রয় করে সবাই দপ্তরে ইনস্টল করে কাজ করতে পারবে অনায়াসেই। দপ্তর অনলাইন বেইজ। অফলবাইনে ব্যবহার করা যাবে। অফলাইন ও অনলাইনে সিনক্রোনাইজের ব্যবস্থাও রয়েছে। রয়েছে একাধিক কোম্পানীর কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার সু-ব্যবস্থাও।

মাসুদ রানার কাছ থেকে জানলাম এর মধ্যে ব্যাপারগুলো ভাবা হয়েছে বেশি –

  • দাম বিশেষ করে বাংলাদেশের কথা মাথায় রেখে স্বল্পমূল্যে সকল অফিসে যাতে দপ্তরের সব এপ্লিকেশনগুলো ব্যবহার করা যায় সেই ব্যবস্থা।
  • সিকিউরিটির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা।
  • কাষ্টমাইজের ব্যবস্থা।
  • সাপোর্ট – আফটার সেলস/সাপোর্ট দিতে পারে। ক্লায়েন্ট নিজ পছন্দের ডেভেলপার দিয়ে তাঁর কাস্টমাইজেশনের কাজ করতে পারবে।

গত কয়েকবছর ধরে মাসুদ রানা ছোটাছুটি করছে ঢাকা-কুয়ালালামপুর। এর মধ্যে একটি ছোট টিমও তৈরি হয়েছে দেশে। মূল কাজগুলো হয়েছে মালয়েশিয়ায়। এখন ফোকাস ঢাকাতে। জানলাম এরই মধ্যে ওরা নিন্মোক্ত কিছু এপ্লিকেশন বানিয়ে ফেলেছে :

  • একাউন্টিং : একাউন্টিং, বিলিং, ইনভয়েজিং, ইনভেনটোরির সুন্দর ভাবে তৈরি করা হয়েছে। যেকোন ছোট-বড় কোম্পানী চাইলে অফিসের হিসাব-নিকাশ রাখার জন্য দপ্তর একাউন্টিং খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে। বাংলাদেশী টাকার এর মূল্য ১২ হাজার টাকা।
  • এইচআর : পে-রোল, হিউম্যান রিসোর্স সিস্টেম। একটি অফিসের স্টাফ এটেনডেন্স, বেতনের হিসাব সব যাবতীয় সল্যুউশন আছে এই এইচআর সিস্টেমে। এর মূল্য ২৪ হাজার টাকা।
  • আইএমএস : ইনষ্টিটিউট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম। স্কুল/কলেজের যাবতীয় অটোশেনের জ;ন্য দপ্তর আইএমএস। বাংলাদেশ সরকারের ১৮টি গুরুত্বপূর্ণ ক্রাইটেরিয়া নিয়ে সহজ ওয়েবসাইটটিও পাওয়া যাবে এই দপ্তর আইএমএস এ। মূল্য ৪০ হাজার টাকা। । তবে মাসুদ রানা সকল স্কুল কলেজের জন্য ফ্রিতে বিতরণ করা চেষ্টা করছে। তবে স্টুডেন্ট প্রতি চার্জ মাসিক ১০/১৫ টাকা।

দপ্তরের আরো একটি মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে টেমপ্লেট। এই মুহুর্তে কোর দপ্তরে ৪টি টেমপ্লেট বিল্টইন আছে। আরো ৪টি টেমপ্লেট মার্কেটপ্লেসে সাজানো আছে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।

আমার ধারণা মাসুদ রানা নিরবে নিভৃতে একটি অনেক বড় কাজ শুরু করেছে। আমাদের দেশে ডিজিটাইজেশন কিন্তু পুরোপুরি সফল হবে না যতোদিন না আমাদের দাপ্তরিক কাজকর্ম ডিজিটাইজ হবে না। কিন্তু সেজন্য কোটি টাকা দামের সফটওয়্যারের দরকার নাই। আমাদের দরকার দপ্তরের মতো আমাদের দেশীয় কিন্তু ইন্নত প্রোডাক্ট।

মাসুদ রানার মতো আমিও বিশ্বাস করি বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের দপ্তরেই একদিন দপ্তর ব্যবহৃত হবে।

 

 

Leave a Reply